মানিকগঞ্জে আর্সেনিক-ঝুঁকিতে শিক্ষার্থীসহ লাখো মানুষ

প্রকাশ | ২২ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:৩৫ | আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:৫৯

মঞ্জুর রহমান, মানিকগঞ্জ থেকে

মানিকগঞ্জে মারাত্ম¡ক আর্সেনিক-ঝুঁকিতে রয়েছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ কয়েক লাক্ষ মানুষ। জেলার হরিরামপুর, শিবালয় ও সিংগাইর উপজেলায় শতকরা ৬০ ভাগ নলকূপের পানিতে পাওয়া গেছে অতি মাত্রায় আর্সেনিক। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ওই জেলায় সর্বশেষ আর্সেনিকের জরিপ হয় ২০০৬ সালে। এরপর আর কোনো জরিপ না হওয়ায় তাদের আশঙ্কা, জেলায় আর্সেনিকের পরিস্থিতি গুরুতর, যা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

এদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাব অনুয়ারী, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত জেলায় আর্সেনিক রোগী পাওয়া গেছে ২৩৬ জন।
সম্প্রতি (গত বুধবার) শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের পাঁচধারা গ্রাম এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় এক যুগ আগে রোকেয়া বেগম (৬০) নামের এক বৃদ্ধা আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হন। প্রথমে তার বাম হাতের তালুতে ফুসকা পড়ে। এরপর তা দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। একই গ্রামের সফিয়া বেগম (২৬), বিলকিস আক্তার (৫০) ও সামছুন নাহার (৩৫) দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে আছেন।

এদিকে পাশের ঈশাখাবাদ গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় মজনু খান প্রায় সাত বছর আগে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হন। একই নলকূপের পানি খেয়ে সুফিয়া বেগম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার এই রোগে আক্রান্ত হয়। মজনু খান ধারদেনা করে ও এলাকাবাসীর সহায়তায় প্রায় ১২ লাখ টাকা খরচ করে ঢাকায় গিয়ে উন্নত চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। এখন তার তিন শতক ভিটেবাড়ি ছাড়াা আর কিছুই নেই। অন্য দুজন কে নো চিকিৎসা পাচ্ছে না।

একই এলাকার সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের ছাত্র রানা ম-ল, তার মা রিনা সুলতানা ও বাবা চুন্নু মন্ডল দীর্ঘদিন ধরে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঈশাখাবাদ গ্রামের অনেক নারী-পুরুষ এই রোগে আক্রান্ত। এ পর্যন্ত তাদের খোঁজ নিতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কর্মী আসেননি।

তাদের অভিযোগ, ওই এলাকায় কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীকে বারবার বিষয়টি জানালেও কোনো পরামর্শ দিতে আসেননি তিনি। একাধিকবার তাকে ফোন করলে ওই স্বাস্থ্যকর্মী তার ফোন বন্ধ করে রাখেন। স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গেলে চিকিৎসকরা তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। কোনো পরামর্শ দেন না তারা।

শিবালয় উপজেলার শিমুলিয়া ইউনিয়নের পাঁচধারা গ্রামের মৃত হাসমত আলীর স্ত্রী রোকেয়া বেগম (৬০) বলেন, তিনি ১২ বছর আগে আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হন। এরপর তিনি স্থানীয় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও  পরে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন। কিন্তু কোনো ফল না পেয়ে পরে চিকিৎসা নেওয়া ছেড়ে দেন। দীর্ঘদিন চিকিৎসা না হওয়ায় এখন তার দুই পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আর্সেনিকের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অন্য সব রোগীর সঙ্গে কথা বলে একই তথ্য জানা যায়।

এদিকে উপজেলার ফেচুয়াধারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নলকূপটিতে ০.০৮ মিলিগ্রাম আর্সেনিক থাকলেও ওই নলকূপের পানি খাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। হরিরামপুর উপজেলার কচুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝিটকা পোদ্দার বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ জেলার মোট ৮৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপন করা নলকূপের পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। যার মাত্রা ০.০৬৬ মিলি গ্রাম থেকে ০.৩০৫ মিলিগ্রাম পর্যন্ত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে আর্সেনিকযুক্ত গভীর নলকূপ বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিলেও বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা না করায় শিক্ষার্থীরা আর্সেনিকযুক্ত পানি খাচ্ছে। এতে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে তারা।

ফেচুয়াধারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবিউল আলম বিশ্বাস বলেন, তিনি নিজেও জানেন না এই বিদ্যালয়ের নলকূপের পানিতে আর্সেনিক রয়েছে।

একটি সূত্রে জানা গেছে, মানিকগঞ্জ জেলায় ৩০৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিইডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৮৩টি নলকূপে অতিমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় ৭৯টির মধ্যে আর্সেনিক পাওয়া গেছে ১৫টিতে, ঘিওর উপজেলায় ৪৭টি নলকূপের ১১টি, সাটুরিয়া উপজেলায় ৪৩টি নলকূপের মধ্যে ১৬টি, শিবালয়ে ১১টির মধ্যে ১টি, সিংগাইরে ৪৪টির মধ্যে ১৬টি, হরিরামপুরে ৫২টির মধ্যে ৯টি, দৌলতপুরে ৩৩টির মধ্যে ১৫টি নলকূপে অতিমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এসব  নলকূপ ৫০০ থেকে ৬০০ ফুট গভীরে স্থাপন করা হয়।

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মহসীনুজ্জামান খান জানান, মানিকগঞ্জে সর্বশেষ আর্সেনিকের জরিপ হয়েছে ২০০৬ সালে। এরপর আর কোনো জরিপ হয়নি। এতে এই জেলায় আর্সেনিক মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

মহসীনুজ্জামান খান বলেন, এই রোগ থেকে রক্ষায়  শিবালয় উপজেলার আরুয়া, উলাইল ও শিবালয় ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ১২০টি  অগভীর নলকূপ বসানোর কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আর্সেনিক ও লৌহ দূরীকরণ প্ল্যান্ট রয়েছে এগুলোতে।

মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. ইমরান আলী বলেন, মাঠপর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালনা করার সময় আর্সেনিক রোগ সম্পর্কে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে সচেতন করছেন মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। (স্বাস্থ্য বিভাগের) হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে জেলায় আর্সেনিক রোগীর সংখ্যা ছিল ১৭৫। ২০১৬ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩৫।  
এদিকে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে মানিকগঞ্জ জেলায় সর্বশেষ ২০০৬ সালে আর্সেনিক জরিপ চালানো হয়। ওই সময় ১ লাখ ১৩ হাজার ৩১৮টি নলকূপের পানি পরীক্ষা করা হয়, যার মধ্যে  ৩৮ হাজার ২৭টি নলকূপের পানিতে অতিমাত্রায় আর্সেনিক পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি আর্সেনিক পাওয়া যায় জেলার হরিরামপুর, শিবালয় ও সিংগাইর উপজেলার নলকূপগুলোতে।

তবে পরীক্ষার মাধ্যমে শিবালয় উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশ রুরাল ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সেনিটেশন প্রজেক্টের (ইজডঝঝচ) মাধ্যমে আইরন ও আর্সেনিক রিমোবাল প্ল্যান্টযুক্ত অগভীর নলকূপ বসানোর কাজ চলছে।

এ ব্যাপারে মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপন জানান, শুধু আর্সেনিক নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের সব ধরনের রোগীর সুচিকিৎসায় বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। যেকোনো রোগের চিকিৎসাসেবা নিতে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সেখানে অবহেলা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

(ঢাকাটাইমস/২১অক্টোবর/মোআ)