মানিকগঞ্জ হাসপাতালে কেবল ‘নেই নেই’

প্রকাশ | ২৭ অক্টোবর ২০১৬, ০৮:৫১

মঞ্জুর রহমান, মানিকগঞ্জ থেকে

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার মহাদেবপুর এলাকার আবুল কাশেম তার অসুস্থ মা ছবেরুন খাতুনকে নিয়ে এসেছেন সদর হাসপাতালে। অনেকদিন ধরে তার মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। এর আগে উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়েও সুফল পাননি। তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ মাকে নিয়ে আসেন সদর হাসপাতালে।

এই চিকিৎসালয়ে আনার পর চিকিৎসকরা ছবেরুন খাতুনকে সিটিস্ক্যান করার পরামর্শ দেন। কিন্তু এই হাসপাতালে তার কোনো ব্যবস্থা নেই। পরে তাকে যেতে হয় মুন্না মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে।

এই হাসপাতালে আসা রোগীরা ছবেরুনের মতই প্রয়োজনীয় সেবা না পেয়ে বিপাকে পড়ছেন। এরপর দালালদের মাধ্যমে তারা ছুটছেন বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে। এই হলো মানিকগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালের বর্তমান চিত্র।

সম্প্রতি এটি ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য সেবা আগের মতই আছে। আড়াইশ শয্যার হাসপাতাল চলছে ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে।

প্রতিষ্ঠাকালীন ২৫ শয্যার হাসপাতাল ছিল জেলা কালেক্টরেট অফিসের সামনে। ১৯৮৪ সালে সেখান থেকে সরিয়ে তা নেয়া হয় শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায়, শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ৫০। ১৯৯৯ সালে হাসপাতালটি হয় ১০০ শয্যার।

মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য জাহিদ মালেক স্বপন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটি ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। পহেলা অক্টোবর ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে আটতলা ভবনের এই হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবা উদ্বোধন করেন প্রতিমন্ত্রী নিজে।

উদ্বোধনের দিন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, হাসপাতালটি আড়াইশ শয্যার হওয়ায় মানিকগঞ্জবাসী আরও উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবে। এই হাসপাতালে সব ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি ধাকবে। হাসপাতালে জনবল সংকট আছে জানিয়ে দ্রুত লোকবল নিয়োগ দেয়ার কথাও জানান প্রতিমন্ত্রী।

তবে আড়াইশ শয্যার হাসপাতালটি এখনও চলছে আগের ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই। হাসপাতাল চালাতে দরকার ৫৮ জন  চিকিৎসক। আর সেবিকা (নার্স) দরকার ৮০ জন। কিন্তু বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছে ৪০ জন ও সেবিকা রয়েছে ৫২ জন। হাসপাতালের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীসহ সব মিলিয়ে থাকার কথা ১৩৭ জন কর্মী। কিন্তু আছে ৩৫ জন।

প্রয়োজনের তুলনায় চিকিৎসক, সেবিকা ও  কর্মচারী না থাকায় হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

হাসপাতালে যে ৪০ জন চিকিৎসক রয়েছে তাদের মধ্যে সিনিয়র ও জুনিয়র কনসালটেন্ট যথাক্রমে ১০ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট রয়েছে ১০ জন ও মেডিকেল অফিসার রয়েছে ২০ জন। এর মধ্যে গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছে সর্বোচ্চ ছয়জন, হৃদরোগ ও সার্জারি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন তিনজন, মেডিকেল ও অর্থপেডিক বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন দুইজন করে এবং চক্ষু, নাক-কান ও গলা আর রেডিওলজিস্ট বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন একজন করে। এছাড়া এনেসথেসিস্ট বিশেষজ্ঞ রয়েছেন একজন। আর বাকি ২০ জন রয়েছেন মেডিকেল অফিসার।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয় না বললেই চলে

হাসপাতালে মাথা, পেট ও বুকের রোগ নির্ণয়ের জন্য একটি সিটিস্ক্যান থাকার কথা থাকলেও এখনো আনা হয়নি। স্পাইনাল কর্ড  বা পেটের টিউমার পরীক্ষার জন্য এম আর আই (ম্যাগনেটিক, রেজুনেন্স ও ইমেজিং) নেই দীর্ঘ দিন ধরেই। পূর্ণ একটি ব্লাড ব্যাংক থাকার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত তা করা হয়নি। পাঁচটি এক্সরে মেশিন থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র একটি।

আড়াইশ শয্যার হাসপাতালে ডিজিটাল এক্সরে মেশিন নেই-এটা মানতে পারছেন না রোগীরা। এ কারণে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে আসা রোগীদের ছুটতে হচ্ছে আশপাশে গড়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিকে।

হাসপাতালে দুইটি সরকারি অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও একটির চালক আছেন, অন্যটির নেই। এ কারণে মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালে জরুরি রোগী আসলে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ঢাকায় নিয়ে যেতে হয়। খুব বেশি সমস্যা দেখেন না আরএমও, দেখছেন সিভিল সার্জন।

হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার লুৎফর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, লোকবল সংকট ও যন্ত্রপাতি না থাকায় চিকিৎসা সেবা কিছুটা ব্যাহত হলেও পুরোপুরি থেমে নেই। যে পরিমাণ চিকিৎসক আছে তাদের মাধ্যমেই এই হাসপাতালের বৈকালিক সেবা চালু করা হয়েছে।

এই চিকিৎসা কর্মকর্তা বলেন, এখানে সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চিকিৎসা দেয়া হয়। সেবা নিশ্চিত করতে সকাল নয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গরিব রোগীদের জন্য একটি তহবিল করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জের সিভিল সার্জন ইমরান আলী সংকটের কথা স্বীকার করেছেন। ঢাকাটাইমসকে তিনি বলেন, ‘ ৫০ শয্যার হাসপাতালের জনবল দিয়ে আড়াইশ শয্যার কার্যক্রম চলছে। এতে রোগীদের সেবা ব্যাহত হচ্ছে।’

সিভিল সার্জন বলেন, ‘সম্প্রতি আড়াইশ শয্যার হাসপাতালের কার্যক্রম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক হাসপাতালের জনবল দ্রুত নিয়োগ দেয়াসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আশা করি খুব দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হবে।’

এদিকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ‘লোকবল নিয়োগ করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি প্রয়োজন। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আমরা এখন অনুমতির অপেক্ষায় আছি। অনুমতি পেলেই লোকবল নিয়োগ দেওয়া হবে।’

চিকিৎসার কাজে ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘এই মুহূর্তে কোন যন্ত্রপাতি মজুদ নেই। বিদেশ থেকে উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আমদানির প্রক্রিয়া চলছে। দ্রুত পেয়ে যাবো। আমরা যে সব যন্ত্রপাতি দেবো তাতে উন্নতমানের চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হবে।’

ঢাকাটাইমস/২৭অক্টোবর/ডব্লিউবি