দর্শক যা চাইবে তা দেখাতে হবে কেন?

গাজী রাকায়েত
| আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:২২ | প্রকাশিত : ১১ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৩৪

গাজী রাকায়েত। দেশের গুণী অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা ও চিত্রনাট্যকার। ছোটপর্দার পর বড়পর্দায়ও প্রতিভার সাক্ষর রেখে চলেছেন। প্রথম চলচ্চিত্র ‘মৃত্তিকা মায়া’ দিয়েই ২০১৩ সালে ১৭টি বিভাগে জিতেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অপরদিকে সদ্যই টিভি নাটক নির্মাতাদের সংগঠন ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি হয়েছেন। নির্মাণের পাশাপাশি নাটক, চলচ্চিত্র তথা সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা কর্মকা-ে এখন সক্রিয় গাজী রাকায়েত। ঢাকাটাইমস -এর সঙ্গে আলাপে বলেছেন অনেক কথা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শাহজালাল রোহান

আপনার সম্পর্কে জানতে চাই। নাট্যজগতে যুক্ত হলেন কিভাবে?

আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ায়। পিতা আবদুল আউয়াল গাজী এবং মাতা বিলকিস বেগম। বাবা মঞ্চনাটক করতেন। অভিনয় তার ভালো লাগত। আমি বাসার পাশে গেন্ডারিয়া ফায়ার সার্ভিসের কাছে পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে একটি মঞ্চনাটকে প্রথম বৃদ্ধের চরিত্রে অভিনয় করি। ১৯৮৩ সালে এসএসসি পরীক্ষার পর বন্ধুর সঙ্গে বেইলি রোডে নাটক দেখতে যাই। ১৯৮৮ সালে বুয়েটে ভর্তির পর আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘তোমরাই’ এবং নাগরিক নাট্যাঙ্গনের ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’ নাটকটি দেখার পর সিদ্ধান্ত নেই নাটকে অভিনয় করব। এভাবেই শুরু হয়। সেই ধারাবাহিকতায় এখন এসবের সঙ্গে সাংগঠনিকভাবেও জড়িত আছি।

পুরান ঢাকায় এখন যাওয়া হয়?

নতুন প্রজন্মের অনেকেই মনে করে, পুরনো মানেই ‘সেকেলে’। তারা মনে করে, পেছনে যা কিছু খারাপ তাই ‘সেকেলে’। সবকিছু আসলে খারাপ বা সেকেলে নয়। তবে পুরান ঢাকা সেই আগের মতো নেই। অনেক বদলে গেছে। তারপরও মাঝেমধ্যে যাই। ভালো লাগে।

কিছুদিন আগে ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি হয়েছেন। কতটা কী করতে পেরেছেন? তিন মাসের মতো হলো আমরা নির্বাচিত হয়েছি। আসলে যারা কাজ করে তারা এমনিতেই করে। তাদের কাজের ধরনই আলাদা। পয়েন্ট আউট করে তারা কাজ করে। তাদের কোনো প্রতিশ্রুতি দরকার হয় না। এমনিতেই কাজ করে। এই কয়দিনে আমরা পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে একত্রিত করে একটা অ্যাসোসিয়েশনে রূপান্তর করেছি। নাম ফেডারেশন অব টেলিভিশন প্রফেশনালস অরগানাইজেশন (এফটিপিও)। প্রতিটি পেশাজীবী সংগঠনের চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদকরা এর সদস্য থাকবেন। অগোছালো ভাব দূর করে গোছালোভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করা যাবে এর মাধ্যমে। এই অ্যাসোসিয়েশনের ব্যানারে আগামী ২ ডিসেম্বর মহাসম্মেলন হবে। তিনজন মন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন সেখানে। আমাদের সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দিনব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।

এই মহাসম্মেলনের উদ্দেশ্য কী? চলমান মিডিয়ায় যে অরাজকতা চলছে, অনিয়ম চলছে এগুলি সবার জানা উচিত। এককভাবে সবার কাছে গিয়ে বলার চেয়ে সাংগঠনিক পথে এগুলে ভালো হয়। এতে ফলাফল তাড়াতাড়ি আসে। তাই এফটিপিও গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশের সব ডিরেক্টর মিলিত হয়ে যেন সমস্যা মোকাবেলা করতে পারি, সে বিষয়ে মতবিনিময়ও হবে। সম্মেলন উদ্বোধনের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রতিনিধি যারা আছেন, বিজ্ঞাপন প্রতিনিধিও থাকবে, সব সংস্থার প্রতিনিধিরা মিলে আলোচনা হবে। সন্ধ্যায় থাকবে সাংস্কৃতিক আয়োজন। সব মিলিয়ে মিডিয়ায় যে অস্থিরতা রয়েছে সে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে। সভাশেষে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা থাকবে। যেখানে জেমস পারফর্ম করবে।

আপনাদের সংগঠনে না এসে অনেকে আলাদা সংগঠন করছে? যারা আলাদা সংগঠন করছে তারা করতেই পারে। সেটি ক্লাবের মতো করে। যা হতেই পারে। কিন্তু সেটা ডিরেক্টরস গিল্ডের মতো প্যারালাল কোনো বিষয় নয়। সেখানে তারা আড্ডা দেয়। কোনো কাজ হয় না। ইদানীং অনেকে এটা করছে। সবচেয়ে বড় কথা আমরা ডিরেক্টরস গিল্ড নির্বাচনের তিন মাসের মাথায় একটি ফেডারেশনে করতে পেরেছি। এটাই অনেক বড় বিষয়। এটাই মূল সংগঠন।

বলছিলেন মিডিয়ার নৈরাজ্য নিয়ে। আন্দোলনও করতে চান। নৈরাজ্যটা আসলে কী নিয়ে? এককথায় যদি বলি এ লড়াই বাঁচার লড়াই। টিকে থাকার লড়াই। কারণ হচ্ছে বর্তমানে টেলিভিশনে বিদেশি ডাবিং করা সিরিয়ালগুলো খুব জোরালোভাবে চলছে। এখন প্রতিটি চ্যানেলে যদি দেড় থেকে দুই ঘণ্টা ডাবিং করা বিদেশি সিরিয়াল চালায়, তবে কী অবস্থা হবে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির। কত কলাকুশলী বেকার হবে ধারণা করতে পারছেন? ৫০০ থেকে ৬০০ শিল্পীর ওপর এ আঘাত আসবে। এখানকার সবার একটি ক্ষোভ বিদেশি ডাব করা সিরিয়াল বন্ধ করতে হবে। যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আমরা জানিয়েছি। এটিএন বাংলা অলরেডি ঘোষণা দিয়েছে, তাদের ওখানে বিদেশি সিরিয়াল চলবে না।

এ সবের জন্যই ফেডারেশনের মাধ্যমে আন্দোলন ও বড় ধরনের কাজগুলো করতে চাই আমরা। সম্মিলিতভাবে কাজ করতেই এটি করা হয়েছে। যার মাধ্যমে আমরা একটা বিশাল আন্দোলনের ডাক দিচ্ছি। সেটি হচ্ছে চলতি মাসের ৩০ তারিখে বাংলাদেশের সব শিল্পী-কলাকুশলী শহীদ মিনারে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ জানাব। এখন সবকিছু মিলে ডিরেক্টররাই বিপদে পড়েছে। তাই সংগঠনগুলোকে একত্রিত করেছি। সবার সঙ্গে বসেই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে।

আপনারা বিদেশি সিরিয়াল কেন বন্ধ করতে বলছেন? প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকার প্রবণতা কম কেন? প্রথমে আমি বলতে চাই ভারতে অথবা বিদেশের কয়টি ডাবকৃত সিরিয়াল বা নাটক চলে। সেখানে না চললে আমাদের দেশে কেন চলবে? তারপরে টেলিভিশন কখনো বাণিজ্যিক মাধ্যম না। এটি হতে পারে না। এটি বাণিজ্যিক প্রডাক্টের নাম হতে পারে না। তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য সে যা কিছু তাই করতে পারে না। দর্শক ডিমান্ড করবে আর তাই আপনাকে চালাতে হবে কেন? দর্শকদের চাহিদায় চলবে সিনেমা, যা টাকা দিয়ে দেখবে। টেলিভিশন হচ্ছে আমার পরিবার নিয়ে দেখব। সেখানে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান হবে, সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে অনুষ্ঠান থাকবে। তা প্রচার না করে বিদেশি ডাবকৃত সিরিয়াল কেন চলবে? দেশে শিক্ষার হার এখনো কম। প্রকৃত মানের শিক্ষিত হতে হলে একজনকে সংস্কৃতিমনা হতে হয়। উন্নয়নশীল দেশে টেলিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এখানে পাবলিক যা চাইবে তা দেখাবেন কেন? আপনার ছোট বাচ্চা যদি আগুনে হাত দিতে যায়, আপনি কি দিতে দিবেন? দিবেন না। তেমনি আমি আমার নিজস্ব সংস্কৃতি ও নিজেদের ইন্ডাস্ট্রিই ভালোভাবে গোছাতে পারিনি, এর ভেতরে অন্য দেশের একটি বিষয় নিয়ে যা বানাবে, তা আমাদের দেখাতে হবে কেন? এটা কিসের লক্ষণ। তারপরও যেগুলো দেখানো হয়, সেগুলো কেন শিক্ষামূলক নয়? কেন সংস্কৃতিধর্মী নয়? বাংলাদেশের নাটক আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। এর জন্য দায়ী কে? এগুলো না গুছিয়ে অন্য কিছু শুরু করবেন কেন? এ জায়গাটা নিয়েই আমার আপত্তি। অত কথা বুঝি না, বিদেশি সিরিয়াল প্রচার বন্ধ না হলে আমরা না খেয়ে মারা যাব। এটা আমার বেঁচে থাকার প্রশ্ন। এখন সেই আগের যুগের মতো একটি চ্যানেলের ওপর ভিত্তি করে নেই আমাদের ইন্ডাস্ট্রি। এটা বুঝতে হবে।

বিদেশি সিরিয়ালের বিরুদ্ধে সোচ্চার আপনি। আমাদের টিভি নাটক আসলে কেমন হচ্ছে? অল্প টাকা দিয়ে বলে, নাটক নির্মাণ করুন। সব ঠিক করে দিবেন আপনারা, আর বলবেন ভালো হয় না। এটা ভুল। মাত্র ২০ হাজার টাকার কাজ আর একটা ২০ লাখ টাকার কাজ, কোনটি ভালো হবে? আমাদের নির্মাণের ক্ষেত্রে সবই ভালো আছে, তবে কিছু অগোছালো ভাব দূর করতে হবে। নির্দিষ্ট নিয়মে আসতে হবে। এই বিষয়ে ৩০ তারিখের কর্মসূচিতে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

আপনাদের বিরোধিতায় দর্শকের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হওয়ার শঙ্কা থেকে যায় কি না? কী কারণে ক্ষুন্ন হবে? আপনি বিদেশি কিছু দেখবেন, সিডি কিনে দেখুন। ইউটিউবে দেখেন। বিভিন্ন মাধ্যম আছে তা থেকে বিদেশি যা ইচ্ছা তাই দেখেন। টেলিভিশনে কেন? টেলিভিশন একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। আপনার বাসায় একটি দিন টেলিভিশন বন্ধ থাকলে, বাসায় থাকতে পারেন কি না দেখেন। যে টেলিভিশন একটি জাতিকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। এর প্রভাবে ১০ বছরে একটি জাতি ঘুমিয়ে যেতে পারে। সেই টেলিভিশনকে অবহেলার চোখে দেখা হচ্ছে। আবারও বলছি টেলিভিশন একটি বাণিজ্যিক মাধ্যম নয়। দর্শক যা চাইবে, তা দেখাতে হবে এমন নয়। যে বিজ্ঞাপনের ব্যবসা করে সে তো চাইবেই কোটি কোটি টাকা ব্যবসা হোক। তার কাছে সংস্কৃতিই কি, দেশই কি! দর্শক তো চাইবেই। তাই বলে সব দেখাতে হবে? প্রাপ্ত বয়স্ক ছবি দেখার জন্য সবাই পাগল থাকে, তাই দেখাতে হবে? আমাদের যখন অশ্লীল ছবির সময়টা ছিল তখন দেখছে না। চারদিকে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি ছিল। এগুলো তো দেখতে চাইবে। টেলিভিশনে যা দেখাবেন তাই দেখবে দর্শক। প্রাপ্ত বয়স্ক ছবি দিলে তো সারা দিন দেখবে, আপনি কী দিবেন দেখতে?

নির্মাতা হিসেবে, সংগঠক হিসেবে এখন বেশি ব্যস্ত। অভিনয়ে সেভাবে পাওয়া যাচ্ছে না। কী বলবেন? অভিনয় তো করছি। শুটিং করছি। তবে আমি মাসে ১০ দিনের বেশি শুটিং করি না। সর্বশেষ ‘চন্দ্রমুখী কথা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছি। নিজের ছবিরও কাজ চলছে। শিক্ষকতা নিয়েও ব্যস্ততা আছে। ওয়ার্কশপ নিয়েও অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। সামনের বছরে আমার নিজের পরিচালিত ছবি ‘গোর’ শুরু করব।

নতুন যারা কাজ করছেন, তাদের উদ্দেশে কী বলবেন? শিখে অভিনয় করো। মঞ্চনাটক করো। গুরুজনদের সম্মান দিয়ে অভিনয় করো। তাহলে ভালো কিছু করতে পারবে।

(ঢাকাটাইমস/১১নভেম্বর/এসজেআর/এজেড/এমএইচ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিনোদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিনোদন এর সর্বশেষ

যেভাবে সালমান খানের বাড়িতে গুলি চালানোর ছক কষা হয়

শিল্পী সমিতির নির্বাচনে এফডিসিতে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞায় পরিচালকদের তীব্র ক্ষোভ

নির্বাচনে পীরজাদা হারুনকে বয়কট করলেন চিত্রনায়িকা শিল্পী

বাসার কেয়ারটেকারের কাছে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন নির্মাতা হিরণ

শিল্পী সমিতির নির্বাচন: ইশতেহার নিয়ে যা বললেন নিপুণ

তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকী: মিনা পাল থেকে যেভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কবরী

শিল্পী সমিতির নির্বাচনে ভোটার ছাড়া প্রবেশ নিষেধ, থাকবে মোবাইল কোর্ট

নির্মাতা হিরণের আকস্মিক মৃত্যুতে অপমৃত্যু মামলা

বাইকে বসে গুলি চালানো হয় সালমান খানের বাড়িতে! ভিডিও প্রকাশ

নিউইয়র্কে প্রদর্শিত হবে ইভান মনোয়ারের শর্ট ফিল্ম ‘প্যাসেঞ্জার’

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :