ফিরে দেখা ভয়াল ১২ নভেম্বর

ইকরামুল আলম, ভোলা
| আপডেট : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:২১ | প্রকাশিত : ১২ নভেম্বর ২০১৬, ০৮:১৫

আচমকা এসে আঘাত হানে। মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ ও প্রাণহীন করে দেয় দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উপকূলীয় এলাকা। এরপর শুধু লাশ আর ধ্বংসস্তূপ। অনুন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে সে খবর দেশবাসীকে জানতে লেগেছে অনেকটা সময়। তত দিনে চারপাশে শুধু লাশের গন্ধ। পত্রিকায় শিরোনাম হয় ‘গাছে গাছে লাশ ঝুলছে, মেঘনা নদীতে লাশের মিছিল’।

আজ সেই ভয়াল ১২ নভেম্বর! বাংলাদেশের ইতিহাসের এক শোকাবহ দিন। ১৯৭০ সালের এই দিনে পুরো উপকূলবাসীর জীবনে নেমে এসেছিল এক মহাদুর্যোগ। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় গোর্কি ও জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় উপকূলীয় জেলাগুলো।

১২ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিমিষে তলিয়ে গিয়েছিল উপকূলীয় অঞ্চলের বাড়িঘরসহ মাঠের ফসল। আগ্রাসী স্রোতের তোড়ে ভেসে গিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ ও গবাদি পশু। পুরো উপকূল পরিণত হয়েছিল বিরান ভূমিতে। মেঘনায় ছিল লাশের মিছিল।

জলোচ্ছ্বাসের পর থেকে দেড় মাস পর্যন্ত উপকূলের আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ছিল লাশের গন্ধে। গত ৪৬ বছরে উপকূলে যে কয়টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, তার মধ্যে সত্তরের বন্যাটি সবচেয়ে ভয়াবহ ও হিংস্র ছিল বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

সত্তরের হ্যারিকেনরূপী জলোচ্ছ্বাসের সময় ঝড়টি উপকূলীয় দ্বীপজেলা ভোলা, পার্শ্ববর্তী বরিশাল, বরগুনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, বাগেরহাট, খুলনাসহ ১৮টি জেলায় আঘাত হানে। তৎকালীন তথ্যপ্রযুক্তি আজকের মতো এত উন্নত ছিল না বলে উপকূলে কোনো মানুষই ঝড়ের পূর্বাভাস পায়নি।

যখন জলোচ্ছ্বাস হানা দেয়, কেউ গাছের ডালে, কেউ উঁচু ছাদে আশ্রয় নেয়। কিন্তু তাদেরও বেশির ভাগের রেহাই মেলেনি। ঘূর্ণিঝড় গোর্কির আঘাতে প্রাণ যায় অনেকের। যারা ১৪-১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস থেকে প্রাণে রক্ষা পায়, তাদের অভুক্ত থাকতে হয় চার-পাঁচ দিন। সেই ভয়াবহ দিনের কথা এখনো মনে দাগ কেটে আছে প্রত্যক্ষদর্শীদের। ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও কান্না থামেনি উপকূলীয় এলাকার স্বজনহারা লাখো মানুষের।

রমজান মাসের সেদিন সকাল থেকেই মেঘে আচ্ছন্ন ছিল পুরো উপকূলীয় জেলাগুলো। দুপুরের পর থেকে আস্তে আস্তে বাতাস বইতে থাকে। বিকেলের দিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, সন্ধ্যায় বাতাসের বেগ আরো বাড়ে। রাত আড়াইটার দিকে মেঘনা-তেতুঁলিয়া ও বঙ্গোপসাগরের জলোচ্ছ্বাসের পানি ১৪ ফুট উঁচুতে উঠে বেড়িবাঁধের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোটা জেলা ডুবিয়ে দেয়। এ সময় ভোলা শহরের সদর রোড ৩ থেকে ৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে যায়। ‘পানি আইতাছে’ বলে চিৎকার দিয়ে শহরের আশপাশ থেকে বহু নারী, পুরুষ ও শিশু ছুটোছুটি শুরু নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। ভোলা শহরের কালিনাথ রায় বাজারের তৎকালীন অগ্রণী ব্যাংকের দোতলায়, সদর রোডের বরিশালের দালান এবং ভোলা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে পারে সামান্য কিছু মানুষ।

১৩ নভেম্বর ভোরে পানি যখন নামতে শুরু করে, পানিতে ভেসে যায় অগণিত মানুষের লাশ। বিভিন্ন গাছের মাথায় ঝুলতে দেখা যায় মানুষের মৃতদেহ। চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। গোটা উপকূল তছতছ করে দেয় গোর্কি। মৃত্যুপূরীতে পরিণত হয় ভোলাসহ উপকূলীয় জনপদ।

লাশের গন্ধের কারণে এক মাস ধরে মেঘনা-তেতুঁলিয়া নদীতে মাছ ধরা বন্ধ রেখেছিলেন উপকূলের জেলেরা।

ওই জলোচ্ছ্বাসে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণ যায়। মনপুরা উপজেলার ২৬ হাজার মানুষের মধ্যে ২৪ হাজার জনই পানিতে ভেসে যায়। তাদের কাউকেই আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভোলা শহর ছাড়াও দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, লালমোহন ও চরফ্যাশন উপজেলার অনেক বাড়ি রয়েছে যেখানে একজন লোকও বাঁচেনি।

স্বজন হারানো সে সময়ের পূর্বদেশ পত্রিকার রিপোর্টার বর্তমানে ভোলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক বাংলার কণ্ঠের সম্পাদক হাবিবুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, স্যাটেলাইটে বিভিন্ন দেশের আবহাওয়া অফিস বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের তীব্রতা দেখে পাকিস্তান সরকারকে তা জানিয়েছিল, কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তা গুরুত্ব না দিয়ে কোনো সংকেতই পাঠায়নি পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে। এ কারণে এত জানমালের ক্ষতি হয়েছে বলে আজও বিশ্বাস করেন তারা।

তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল ও অনুন্নত ছিল বলে গোর্কি-দুর্গত অঞ্চলে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করতে অনেক সময় লেগেছিল। এমনও এলাকা ছিল যেখানে মানুষের পৌঁছাতে বেশ কয়েক দিন লেগে গেছে। ফলে মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি আরো বেড়েছে।

ভোলার টিঅ্যান্ডটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ায় ওই সময়ে দেশ ও বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে ভোলায় ঝড়- জলোচ্ছ্বাসের তা-বলীলার খবর কেউ জানতে পারেনি। চার দিন পর পুলিশ ওয়ারলেসের মাধ্যমে ঢাকার মগবাজার টিঅ্যান্ডটিকে জানালে তারা পত্রিকা অফিসে ম্যাসেজটি পৌঁছে দেয়।

পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘ভোলার গাছে গাছে লাশ ঝুলছে, মেঘনা নদীতে লাশের মিছিল’ শিরোনামে সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হলে বহির্বিশ্ব তখন জানতে পারে।

(ঢাকাটাইমস/১২নভেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :