কেউ দায় নেবেন না?

আরিফুর রহমান
| আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ১৭:৩৪ | প্রকাশিত : ১৬ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:০৭

বন্ধু দিলীপকে মাঝেমধ্যে মনে পড়ে খুব। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একসঙ্গে পড়তাম আমরা। খুব ফুর্তিবাজ ছিল। ওই অল্পবয়সে হৈচৈ করে মাতিয়ে রাখত সারা ক্লাস। হঠাৎই ক্লাসে অনুপস্থিত দিলীপ। কি হয়েছে দিলীপের? বন্ধু-বান্ধবেরা আমরা সব অস্থির। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, দিলীপ পরিবারসহ দেশান্তর হয়েছে। গ্রামে আমাদের বাড়িটা যেখানে তার সামনে বিরাট ফসলের মাঠ। অনেকটা বিস্তৃত। মাঠ যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে তারপরের গ্রাম কুলধর। দিলীপদের গ্রাম। ছোটবেলায় নৌকায় করে কত গিয়েছি আমরা। দিলীপের কাকা, নিমাই কাকাকে তো আমরা নিজেদের কাকা বলেই জানতাম। ইউনিয়ন পরিষদে চৌকিদার ছিলেন নিমাই কাকা। খুবই আমুদে। সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। আমাদের সব অনুষ্ঠানে হাজির থাকতেন। নিমাই কাকার ডাক পড়তো সবখানে, নানা কাজে। খাকি পোশাক পরতেন। নিমাই কাকা দেশান্তর হননি, দেশেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুর খবরে স্বজন হারানোর বেদনায় আমরা কেঁদেছি, ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। নিমাই কাকার মতোই পাশের গ্রামের অরবিন্দু কুমার মৃধা বা ঠাকুরদাস কীর্তনিয়াদের সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক।

নাসিরনগর বা গোবিন্দগঞ্জে যখন জাতিগত বা সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘু বিবেচনা করে আক্রমণ করে সংখ্যাগরিষ্ঠরা তখন আসলেই চমকে উঠি। নিন্দা জানানোর ভাষা খুঁজে পাই না। এও কি সম্ভব! চোখে ভেসে ওঠে বন্ধু দিলীপ বা নিমাই কাকার মুখ। একজন মানুষ স্রেফ ধর্মের পার্থক্য খুঁজে কোনো ধর্মই অন্য ধর্মাবলম্বীর ওপরে আঘাতের বিষয়টি সমর্থন করে না। তাহলে যারা ঘটনা ঘটাচ্ছেন, ঘটালেন তাদের উদ্দেশ্য কি? সংখ্যালঘুদের ওপরে আমক্রণ করে কী বার্তা তারা দিতে চায়? এই ঘটনায় কার লাভ? নাসিরনগর বা গোবিন্দগঞ্জের ঘটনায় সরকার বা আওয়ামী লীগের কি কোনো লাভ হয়েছে? নিশ্চয়ই না। সরকার বা সরকারি দল যে এর পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারে না, এটি পরিষ্কার। বিশেষ স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী জমি দখল, সম্পত্তি লুট বা অন্য কোনো কারণে এই ঘটনার জন্য দায়ী। তাহলে কঠোর হাতে স্বার্থান্বেষী চক্রকে দমনে বাধা কোথায়? এখানেই সংশ্লিষ্টদের দায়-দায়িত্বের প্রশ্ন চলে আসে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নাসিরনগরের ঘটনায় শুরুতেই প্রশাসনকে কঠোর হতে বলতে পারতেন প্রাণীসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হক। তার দোটানা মনোভাব দুষ্কৃতকারীদের উৎসাহ জুগিয়েছে, একথা আমরা বলতেই পারি। ব্যক্তিজীবনে তিনি যত সৎই হোন না কেন, তার অহঙ্কারী মনোভাবের কথা কে না জানে?

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগে কোন্দল আছে কি নেই তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হেভিওয়েট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ওবায়দুল মুক্তাদির চৌধুরী ও তার পারিষদ কি ঘটনা মোকাবিলা করতে পেরেছেন? যদি পারতেন, তাহলে দফায় দফায় নাসিরনগরে সংখ্যালঘুরা আক্রমণের মধ্যে পড়তো না, এটি নিশ্চিত। সেখানকার ঘটনায় কার লাভ হয়েছে সেটি জানি না, তবে লোকসান হয়েছে মানবতার। এই অন্যায়, এই অনাচার কঠোরভাবে মোকাবিলা করতে হবে সরকারকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গণতান্ত্রিক শক্তি যে কার্যত দুর্বল তা আবারো প্রমাণ হয়েছে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, শচীন দেব বর্মণের জন্ম যেখানে, সেখানে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই উত্থান কেন? বিভিন্ন সময়েই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির এই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা আমাদের অবাক করে। আমরা বিস্মিত হই, সেখানকার গণতান্ত্রিক শক্তি মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকে। এসব কিসের লক্ষণ!

গোবিন্দগঞ্জে আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের চারজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন। তবু কেউ দায় নিচ্ছে না। এই ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন মামলা হবে না? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই এটা প্রয়োজন। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তোষণ করে চলার নীতি যদি কেউ অনুসরণ করেন তাহলে জনগণ কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নেবে। চিনিকলের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে বেআইনি বাড়িঘর উঠল কি করে? আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন তখন কি করছিল? চিনিকল কর্তৃপক্ষ কি শুরু থেকে বিষয়টির সঙ্গে জড়িত ছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। একতরফাভাবে নিরীহ, সহজ-সরল সাঁওতালদের দায়ী করার চেষ্টা ভবিষ্যতে ভালো ফল নাও দিতে পারে।

সাঁওতালরা তাদের জমি ফেরত চায়। এটি তো কোনো অন্যায় দাবি নয়। ১৯৬৫ সালে গোবিন্দগঞ্জে চিনিকলের জন্য জমি অধিগ্রহণ করার সময় আইনেই এই নিয়ম রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, আখ চাষ ছাড়া অন্য কাজে অধিগ্রহণ করা জমি ব্যবহৃত হলে যাদের জমি তাদেরকে তা ফেরত দেওয়া হবে। ২০০৪ সাল থেকে চিনিকলই বন্ধ। অতএব, সাঁওতালরা তো কোনো অন্যায্য দাবি তোলেননি। জমি ফেরত চাইতে গিয়ে যদি প্রাণ হারাতে হয় তাহলে তো সেটি ভয়ানক কথা। এই অন্যায়ের উপযুক্ত বিচার রাষ্ট্রকে করতে হবে। রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে, অপরাধী যেই হোক তার কোনো রং নেই।

একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী বলেছেন, ভুমিদস্যুরা সাঁওতালদের ব্যবহার করে জমি দখল করতে চেয়েছিল। প্রশ্ন, জমি কিন্তু একদিনে দখল হয়নি। কয়েকশ বাড়িঘর করতে অনেক সময় লেগেছে। চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তখন বসে বসে আঙুল চুষেছে? কার ইঙ্গিতে? দায়িত্ব নিয়ে কথা বলা উচিত। বেসরকারি চিনিকল যখন বিশাল মুনাফা করছে তখন সরকারি চিনিকলগুলো শত শত কোটি টাকা লোকসান গুনছে। কার টাকা এগুলো। জনগণের করের টাকা। আমি তো মনে করি গোবিন্দগঞ্জের চিনিকলের লোকসানের হিসাব-নিকাশও এখন প্রকাশ্যে আনা দরকার। সাঁওতাল হত্যার বিচার চাই। যাদের কারণে চিনিকলের লোকসান ও জনগণের টাকার নয়ছয় তাদের দায়ও পরিষ্কার হোক। ভর্তুকির এই টাকা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন কিংবা শিক্ষা, স্বাস্থ্যখাতে সঠিকভাবে ব্যয় হোক। চিনিকলের নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হোক। কেউ কি দায় নেবেন না?

আর বন্ধুহারা হতে চাই না। দিলীপরা যেন আর দেশান্তরী না হন।

লেখক: সম্পাদক, ঢাকাটাইমস এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

রাজপাট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা