গণশুনানি: বাপ-দাদার সম্পত্তিতে পুনর্বাসন চায় সাঁওতালরা

গাইবান্ধা প্রতিনিধি, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ২২:৪৭ | প্রকাশিত : ২২ নভেম্বর ২০১৬, ২২:৪৫

গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের সাঁওতালদের ওপর হামলা, লুটপাট ও বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মঙ্গলবার একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয়, রংপুর বিভাগীয় ও গাইবান্ধা জেলা কমিটির নেতারা জয়পুর ও মাদারপুর সাঁওতাল এলাকা পরিদর্শন করেন। এসময় তাদের উদ্যোগে মাদারপুর মিশন গির্জার সামনে এক গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়জন সাঁওতালের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। তারা হচ্ছেন রাফায়েল হাসদা, বারনা টুডু, রিনা মাইতি, কৃষ্ণ মুরমু, ববিতা মুরমু ও বারনা মুরমু।

গণশুনানিতে সাঁওতালরা বলেন, ১৯৬২ সালে আখ চাষের জন্য গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার সাহেবগঞ্জ এলাকায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের কাছ থেকে এক হাজার ৮৪২ একর জমি রংপুর চিনিকলের আওতায় অধিগ্রহণ করা হয়। তখন থেকে এসব জমিতে উৎপাদিত আখ চিনিকলে সরবরাহ করা হচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন ওইসব জমিতে মিল কর্তৃপক্ষ আখ চাষ না করে বেআইনিভাবে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে লিজ দেয়। তারা লিজ নেয়ার পর ওইসব জমিতে তামাক, ধান, শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের আবাদ করতে থাকে। এছাড়া এসব জমিতে ১২টি পুকুর খনন করে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালীরা। সাঁওতালদের দাবি, ১৯৪০ সালের রেকর্ড অনুযায়ী তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দিতে হবে।

তারা আরও বলেন, স্থানীয় প্রভাবশালী লোকজন মিলের জমিতে আখ চাষ না হওয়ায় দুই বছর আগে বাপ-দাদার জমি ফেরত দেয়ার কথা বলে জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলনে নামানো হয় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোকজনকে। গোবিন্দগঞ্জের সংসদ সদস্যের মদদে সাপামারা ইউপি চেয়ারম্যান আদিবাসী ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি শাকিল আকন্দ বুলবুল, কাটাবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রফিক, আদিবাসী ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান বাপ-দাদার জমি উদ্ধারের কথা বলে সাঁওতালদের সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম এলাকার ইক্ষু খামারের জমিতে চলতি বছরের ১ জুলাই বসতি স্থাপনে সহযোগিতা করে। এসময় আন্দোলন এবং জমি ফেরত দেয়ার নামে সাঁওতালদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা নেয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তারা সাঁওতালদের সঙ্গে বেঈমানি করে তাদের উচ্ছেদের ব্যাপারে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে সহযোগিতা শুরু করেন। পরে তারাই ৬ নবেম্বর বসতবাড়িতে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট করে তাদের উচ্ছেদ করে। এসময় পুলিশ বিমল কিসকু (৪০), চরন সরেন (৫০), দ্বিজেন টুডু (৩৫), মাজিয়া হেমব্রম (৫০) সহ চারজন সাঁওতাল সম্প্রদায়ের লোককে গ্রেপ্তার করে। ওই হামলা এবং সংঘর্ষের ঘটনায় শ্যামল সরেন ও মঙ্গল টুডু (৫০) নামে দুজন নিহত হয়। আহত একজন সাঁওতাল পরে মারা যান।

সাঁওতালারা গণশুনানিতে আরও দাবি জানান, তাদের পিতৃপুরুষের জমিতেই পুনর্বাসন করতে হবে, ঘটনার সাথে জড়িত দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, বেআইনিভাবে উচ্ছেদে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সেই সাথে তারা আরও বলেন, সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামারের জমি ছাড়া, সরকারি কোনো খাস জমিতে তাদের পুনর্বাসন করার উদ্যোগ তারা কখনই মেনে নেবে না।

গণশুনানিতে সাঁওতালদের বক্তব্য শোনেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও মো. শামছুল হক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুল, সাংগঠনিক সম্পাদক বায়েজিদ আব্বাস, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার নাদিয়া চৌধুরী। এসময় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিনিধি দলের সাথে ছিলেন, গাইবান্ধা জেলা শাখার আহ্বায়ক মুক্তিযোদ্ধা মাহমুদুল হক শাহজাদা, সদস্য সচিব আমিনুর জামান রিংকু, রংপুর সাংগঠনিক সম্পাদক মানিক সরকার এবং রংপুর বিভাগীয় কমিটির সদস্য মুশফিক রাজ্জাক প্রমুখ।

গণশুনানি শেষে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক উপস্থিত সাংবাদিকদের জানান, এই গণশুনানির পরিপ্রেক্ষিতে একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরসহ সংশি¬ষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, চিনিকলের নামে অধিগ্রহণকৃত জমি চিনিকল কর্তৃপক্ষ ২০০৪ সালে আখ ছাড়া অন্যান্য ফসল চাষ এবং পুকুর খনন করে মৎস্য চাষ করার জন্য যে লিজ প্রদান করেছিল, তা তারা করতে পারেন না। তিনি দাবি জানান, চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে অবশ্যই সাঁওতালদের কাছে গৃহীত জমি তাদের ফিরিয়ে দিতে হবে। এছাড়া সাঁওতালদের পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং তাদের হামলা ও উচ্ছেদের জন্য দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি জানান তিনি।

সাঁওতালদের বিক্ষোভ

গণশুনানী শেষে সাঁওতালরা তাদের বাপ-দাদার জমি ফিরিয়ে দেয়া, উচ্ছেদকৃত জায়গায় অবিলম্বে পুনর্বাসন, ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, উচ্ছেদ ও হামলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মাদারপুর মিশন গির্জা এলাকায় বিক্ষুব্ধ সাঁওতালরা তাৎক্ষণিক মিছিল করে। মিছিলটি ওই এলাকার পার্শ্ববর্তী সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে।

মিল কর্তৃপক্ষের ধান কাটার সিদ্ধান্ত

সাহেবগঞ্জ ইক্ষু খামার এলাকায় বসতি স্থাপনকারি সাঁওতালরা জমিতে যে আমন ধান চাষ করেছিল তা কাটার জন্য সাঁওতালদের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ফলে জমির পাকা ধান ঝরে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনা মোতাবেক মিল কর্তৃপক্ষ তা কেটে নিয়ে তালিকা মোতাবেক সাঁওতালদের মধ্যে বন্টন করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সামাদ, পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম, চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আব্দুল আউয়াল, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুল হান্নানসহ কৃষি বিভাগ, ভূমি অফিস ও সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্মের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার সরেজমিনে ধান ক্ষেত এলাকা পরিদর্শন করেন।

এব্যাপারে জেলা প্রশাসক আব্দুস সামাদ বলেন, গোবিন্দগঞ্জের উপজেলা ভূমি অফিস ও কৃষি বিভাগের সরেজমিন তদন্তে জানা গেছে, সাঁওতালদের বসতি এলাকায় ৪৫.৫০ একর জমিতে আমন ধান চাষ করা হয়েছে। এরমধ্যে এ পর্যন্ত ৩০ একর জমির ধান এখন কাটার উপযোগী। আরও ১৫.৫০ একর জমির ধান এখনও পাকার অপেক্ষায়।

তিনি বলেন, কৃষি বিভাগের বক্তব্য অনুযায়ী যে সমস্ত জমির ধান পেকেছে তা চার থেকে পাঁচ দিন পরে কাটলেও কোনো ক্ষতির আশংকা নেই। সেজন্য সাঁওতালদের সাথে যোগাযোগ করা হচ্ছে যেন তারা তালিকা প্রদান করে ওই সময়ের মধ্যে ধান কেটে নিয়ে যায়। এসময়ের মধ্যে ধান কাটার ব্যাপারে সাঁওতালদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে মিল কর্তৃপক্ষ নিজের উদ্যোগে ধান কেটে নেবে বলে তিনি জানান।

(ঢাকাটাইমস/২২নভেম্বর/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :