অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-৭

আলম রায়হান
| আপডেট : ২৭ নভেম্বর ২০১৬, ১৩:১৪ | প্রকাশিত : ২৭ নভেম্বর ২০১৬, ১০:৫৬
ছবি: আমেনা বেগমের সঙ্গে তার মগবাজারের বাসায়

কর্নেল ফারুক-রশিদকে জড়িয়ে প্রশ্ন করার কারণে খোন্দকার মোশতাক আহমেদের রোষাণলে পড়ে সাপ্তাহিক জনকথায় আমার অবস্থা তখন খুবই নড়বড়ে, পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাওয়া আর কি! কিছু দিনের মধ্যে অবস্থা এমন দাঁড়ালো, আমি জনকথা ছাড়ি অথবা জনকথা আমাকে ছাড়ায়! পরিস্থিতি যাই দাঁড়ায়, ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলো অনিবার্য। এর আলামত হিসেবে ইব্রাহিম ভাই আমার সঙ্গে একেবারে ফর্মাল সম্পাদক হয়ে গেলেন, অনেকটা ভরা নদী হঠাৎ শূন্য হয়ে যাবার মতো। অতিপ্রিয় ইব্রাহিম ভাই হয়ে গেলেন প্রায় অচেনা মানুষ!

অথচ, এর আগে অফিসে এসেই সম্পাদকের প্রথম কাজ ছিলো, আমার সঙ্গে নিদেন পক্ষে আধা ঘণ্টা আলাপ করা। বিভিন্ন বিষয়ে তিনি ব্রিফ করতেন, পরামর্শ দিতেন। আমার কথাও শুনতের মনে দিয়ে। শ্রোতা হিসেবে তিনি অদ্বিতীয় বলে আমি আজও মনে করি। কিন্তু খোন্দকার মোশতাকের অতি সামান্য ভুরু কুঁচকানীতে পেশার প্রথম প্রতিষ্ঠান ছাড়া অনিবার্য হয়ে গেলো। তবে ইব্রাহিম ভাই নিজে থেকে ছাড়তে বললেন না। কেবল পরিবেশ এমন হলো যে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! অবশ্য মায়েরা কখনো কাঁদার জন্য সন্তানকে ছেড়ে দেয় না। বরং কাদাঁর অবস্থা হলে কাছে টেনে নেন, কান্না থামাবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান উল্টো; হাসার অবস্থায় থাকলে কাছে টানে, কাঁদার আলামত দেখলে ছেড়ে দেয়। কারণ, একমাত্র মা ছাড়া আর সবকিছুই চলে লাভ-লোকশানের হিসাবে। প্রতিষ্ঠান তো সব সময় বসেই থকে লাভ-লোকশানের খাতা নিয়ে!

ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি- দশার আগে জনকথা সম্পাদক ইব্রাহিম ভাই হঠাৎ এক দিন এসে বললেন, আমরা সাব-লেট অফিস ছেড়ে দিচ্ছি; ডিআইটি এক্সটেনশন রোডে অফিস নিয়েছি। সপ্তাহ খানেকের মধ্যে অফিস স্থান্তর হলো। সেই সময়ের বাস্তবতায় আকর্ষণীয় অফিস। নতুন অফিসে লোকজনের পদচারণা বাড়লো। আলম মাসুদসহ নতুন করে লোক নিয়োগ দেয়া হলো। বাড়লো চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুকসহ অনেকের আনাগোনা। পরবর্তীতে ফারুক-রশিদদের অর্থায়নে দৈনিক মিল্লাতের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব¡ নিয়েছিলেন চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুক। কিন্তু এর আগে তিনি সাপ্তাহিক জনকথায় নিয়মিত লিখতেন এবং সে লেখা সম্পাদনার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো আমাকে। কিন্তু এ লেখা ছিলো খুবই নি¤œমানের ও আওয়ামী বিরোধী বিষোদগারে ভরপুর। এ বিষয়ে ইব্রাহিম ভাইর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, আরে জোড়াতালি দিয়ে চালাও; আমাদের লোক! ইব্রাহিম ভাইর ইঙ্গিত বুঝে এ নিয়ে আর কথা বাড়াইনি। সবমিলিয়ে জনকথা সে এক রমরমা অবস্থায়। কে জানে অদৃশ্য কোন লাভের হিসাব মিলিয়েছিলেন জনকথার মালিক কাম সম্পাদক ইব্রাহিম রহমান, যা কিনা এখন বিবেচিত হয় মিডিয়ার আনসিন ইনকাম হিসেবে। অনেক মিডিয়া নাকি এ ধরনের ইনকামেই চলে। কারো কাছে আবার মিডিয়া জরুরি হচ্ছে নতুন করে ইনকামের চেয়ে আগেকার লুটের টাকা রক্ষা করার জন্য, হোক তা শেয়ার বাজার লুট বা অন্যকিছু।

নিজস্ব অফিসে আসার আগে থেকেই ইব্রাহিম ভাই প্রতি সপ্তাহে পত্রিকা ছাপার দুই দিন আগে মগবাজারে আমেনা বেগমের বাসায় যেতেন। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে গেছেন একাধিকবার। সে সময়ে আমেনা বেগমের বয়সের ভার থাকলেও ততটা ভারাক্রান্ত ছিলেন না। তুলনামূলকভাবে তার স্বামী ছিলেন বয়সের ভারে বেশ কাহিল, খুবই ভদ্রলো। অনেক গল্প করতের আমাদের সঙ্গে। আপ্যায়ন করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে, চা-মিষ্টি এগিয়ে দিতেন নিজেই। উচ্চ মাত্রায় বহুমুত্র রোগের কারণে নিজে মিস্টি না খেতে পারার কষ্ট হয়তো আমাদের খেতে দেখে মিটাতে চাইতেন। এদিকে এন্তার জ্ঞান দেবার পাশাপাশি পত্রিকার নানান দিক নিয়ে অনেক খিস্তিখেউর করতের আমেনা বেগম। ঘন্টাখানেক পর একটি ভাজকরা চেক ইব্রাহিম ভাইর হাতে দিতেন। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জানলাম, এটি পত্রিকার প্রডাকশন ব্যয় হিসেবে প্রতি সপ্তাহের বরাদ্ধ। তবে টাকার অংক জানতাম না, এ নিয়ে আমার কোন আগ্রহও ছিলো না। সীমা লংঘন করে অজানাকে জানার কৌতুহল আগাগোড়াই আমার কম। বিশেষ করে, মালিকদের বিষয়ে কখনো খোঁজ খবর নেয়ার তাগিত বোধ করিনি কখনো।

পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে আমেনা বেগমের নাম পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ছাপা হতো। পৃষ্ঠপোষক শব্দের নানান অর্থ নিয়ে শাহ মোয়াজ্জম হোসেন একদিন আমার সঙ্গে অনেক ফান করেছেন স্বভাবশুলভভাবে। তার বাক্য প্রয়োগ অস্তরি হলেও আমার কাছে স্বস্তির বিষয় ছিলো, প্রতি সপ্তাহে নিয়মিত প্রডাকশন কস্ট নিয়ে সম্পাদকের চিন্তা করার ধকল থেকে মুক্তি। কিন্তু চরম অস্বস্তিতে পড়লাম আমেনা বেগম স্বাক্ষরিত চেকে প্রদত্ত অর্থের মূল উৎস ঘটনাচক্রে জানান পর। জেনে বিস্মিত ও ব্যথিত হয়েছি, বঙ্গবন্ধুর খুনী চক্র মুখোশ হিসেবে বেছে নিয়েছিলো আমেনা বেগমকে। আমাদের দেশের রাজনীতিকরা কতই না এমিবা প্রজাতির!

আমেনা বেগম এক সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সমারিক জান্তার ফাঁসির মঞ্চ থেকে রক্ষা করার জন্য পুরো পূর্ব পাকিস্তানের ৫৫ হাজার বর্গ মাইল চষে বেড়িয়েছেন। সে সময় কেবল বঙ্গবন্ধু নয়, আওয়ামী লীগের নেতারা ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে, না হয় হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক। সামরিক শাসকের রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করার অদম্য সাহস দেখিয়েছিলেন আমেনা বেগম, আর পাকজান্তা নারীর সঙ্গে অতটা আশোভন আচরণ করেননি যতটা করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে মতিয়া চৌধুরীসহ অনেক নারীর সঙ্গে।

তখন বাঙ্গালীদের শ্লোগান ছিলো, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা-মেঘনা-যমুনা! আর এর বিপরীত শ্লোগান ছিলো, তোমার আমার ঠিকানা আমেনা বেগমের...! আদি রসাত্মক শব্দটি উচ্চারণ না করাই ভালো। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কাজ করতে গিয়ে এতোটাই বিপদে ছিলেন যে ব্যক্তি সেই আমেনা বেগমই হয়ে গেলেন, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর খুনি ফারুক-রশিদদের ক্যাশিয়ার। মিডিয়াসহ নানান পেশার লোকদের বিভিন্ন অংকের টাকা হস্তান্তর করার দায়িত্ব ছিলো আমেনা বেগমের। গবেষকরা হয়তো আরো গভীরে গিয়ে চিহ্নিত করতে পারবেন, ৭৫-এর খুনী চক্রের টাকায় বাংলাদেশে কত কি হয়েছে, বা হচ্ছে!

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মাইটিভি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :