বইঃ আমার কথা
‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’
সৈয়দ আবুল হোসেন বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘আমার কথা’। এই বইয়ে তিনি নিজের চিন্তা, কর্মকান্ড, মূল্যবোধ, নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে লিখেছেন। এটি পড়লে তাকে যারা পুরোপুরি চিনেন না তাদের সুবিধা হবে। বইটি ‘ঢাকাটাইমস২৪ডটকম’ ধারাবাহিকভাবে ছাপছে। আজ পড়ুন বইটির প্রথম অধ্যায় ‘নারীর ক্ষমতায়ন ও বাংলাদেশ’
নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সময় এসেছে নারীকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। এ বিষয়টা মাথায় রেখেই আমাদের এগোতে হবে। কেউ যদি মনে করেন নারীকে অবহেলিত রেখেই সমাজের ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব- সেটা কখনও চিন্তা করাও উচিত হবে না। কারণ পুরুষের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে নারীর অবদান। তাই এই নারীসমাজকে এখন আর পেছনে থেকে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজে না লাগিয়ে তাদেরকেও সামনের দিকে নিয়ে এসে সরাসরি কাজে লাগাতে হবে। সম্মানের আসনে জায়গা করে নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। কোনো নারী যাতে নির্যাতিত না হয়- সেটা দেখতে হবে। নারীর সহযোগিতা ছাড়া কোনো জাতি যোগ্য নাগরিক পায় না। তাই নারীর ক্ষমতায়ন মানেই জাতির ক্ষমতায়ন। পবিত্র কোরানে আল্লাহ্ বলেছেন : নারীদের রয়েছে বিধি মোতাবেক অধিকার। যেমন আছে তাদের ওপর (পুরুষদের) অধিকার। [সূরা আল-বাকারা ২(২২৮)]
আমাদের দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের প্রধান নারী। প্রধানমন্ত্রীও নারী। বিরোধীদলের নেতাও নারী। অপর একটি বড় রাজনীতিক দলের প্রধানও নারী। তিনিও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলের নেত্রী ছিলেন। স্পিকারও নারী। বাকি আছে একজন নারী প্রেসিডেন্ট করার। সেটাও হয়তো যেকোনো সময় হয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশের শীর্ষ-পর্যায়ে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এখন সচিব, বিচারপতিও নারী আছেন। এছাড়াও বিভিন্ন সেক্টরে নারীরা ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছেন। সেনাবাহিনী ও পুলিশেও নারীরা ভালো করছেন। একটা সময় এ অবস্থা ছিল না। অনেক কষ্ট করেই আমাদের এখানে আসতে হয়েছে। আমাদের সমাজের নারীর ক্ষমতায়নের ব্যাপারে অনেকেই বিস্মিত হয়। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি কৌতূহলী জিজ্ঞাসার সম্মুখীন হতে হয় বিদেশে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর যথাযথ মূল্যায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে আসছেন। অতীতের কোনো সরকার বাংলাদেশের রাজনীতিক ইতিহাসে ও গণতন্ত্রের ধারাবাহিক ইতিহাসে নারীর ক্ষমতায়নে এবং নারীর মূল্যায়নে এমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। শেখ হাসিনা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন নারীর ক্ষমতায়নে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়েছেন। এর পরের বার কেবিনেট এবং একসময় স্পিকার হিসেবে নারীর যোগ্যতার প্রমাণ তুলে ধরলেন। নারীর ক্ষমতায়নে অবদান রাখায় যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ‘গ্ল্যামার’-এর বিচারে বর্ষসেরা নারী মনোনীত হয়েছেন- শেখ হাসিনা।
২০০৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ হাসিনার সরকার নারী উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ শুরু করেন। বাংলাদেশ সরকারের ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫), যেখানে জাতীয়, মাঝারি পর্যায়ের উন্নয়ন-পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ২০২১ সাল (ভিশন ২০২১ নামেও পরিচিত) নাগাদ একটি মধ্য আয়ের রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলায় অঙ্গীকারবদ্ধ, নারীকে রাজনীতিক ও আর্থনীতিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করাকে নারীর ক্ষমতায়নের প্রধানতম চালিকাশক্তি হিসাবে বিবেচনায় আনা হয়েছে। শেখ হাসিনা নারীর কার্যকর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উদ্যোগ, মাতৃত্ব ও স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১, নারীর প্রতি সহিংসতা দমন, অকাল এবং বাল্যবিবাহের সমাপ্তি, রাজনীতি, প্রশাসন এবং নিরাপত্তায় প্রভৃতিতে নারীরা উল্লেখযোগ্য।আমি মনে করি, আমরা ইতোমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছি। আমরা আমাদের সমাজকে ক্ষমতায়ন করেছি, আর এ সমাজের মাধ্যমে নারীরাও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের শক্তিশালী অর্থনীতিতে নারীদের ভূমিকা রয়েছে। আমরা সরকারি কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধি করছি, যেখানে নারীরা নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা নারীদের নির্দেশনায় বহু প্রকল্পও আরম্ভ করেছি। আমাদের অবকাঠামো, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা কার্যক্রমের উন্নয়নে নারীদের ভূমিকা রয়েছে, এমনকি আমাদের সামরিক বাহিনীতেও নারীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিশেষ করে, পোশাকশিল্পে নারীদের অবদান অপরিসীম। নারীরা তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠন করছে এবং বলিষ্ঠ ও শিক্ষিত এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলছে, যাঁরা দেশকে ভালবাসেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জানেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং নির্মাণকাজ চালিয়ে নিতে পারেন, সর্বোপরি, সহায়তা দিচ্ছেন একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে।
লিঙ্গ-সমতা স্থাপনের অন্যতম নিয়ামক রাজনীতিক ক্ষমতায় নারী-পুরুষের আনুপাতিক অবস্থান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সারাবিশ্বে সৃষ্টি করেছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। বিশ্ব আর্থনীতিক ফোরাম প্রকাশিত গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৩ অনুযায়ী, ১৩৬টি দেশের মধ্যে লিঙ্গবৈষম্য নিরসনে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৫তম, যা ১০ বছরে এগিয়েছে ১১ ধাপ। অন্যদিকে শুধু রাজনীতিক ক্ষমতায়নে নারীর অংশগ্রহণের বিষয় বিবেচনায় বাংলাদেশের স্থান পৃথিবীর মধ্যে অষ্টম। যা ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে দুই নেত্রীর রাজনীতিক ক্ষমতায় থাকা এবং সংসদে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০ শতাংশে পৌঁছানোর কারণে সম্ভব হয়েছে।
অবশ্যই সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, নারীরা তাদের নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের দেশ গঠন করছে এবং বলিষ্ঠ ও শিক্ষিত এক ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলছে, যাঁরা দেশকে ভালবাসেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে জানেন, উন্নয়ন প্রক্রিয়া এবং নির্মাণকাজ চালিয়ে নিতে পারেন, সর্বোপরি, সহায়তা দিচ্ছেন একটি শিক্ষিত প্রজন্ম গঠনে।
আমি আগেও বলেছি, নারীরা হচ্ছে দেশের আত্মা ও শক্তি। এর অর্থ হচ্ছে, একজন নারীর রয়েছে আবেগময় বোধশক্তি, দয়ালু হৃদয়, উদার মন, প্রবল উচ্চাকাক্সক্ষা এবং দূরদর্শী মূল্যবোধ। বাংলাদেশের নারীরা দেশের জীবন-যাপন পদ্ধতিতে অভ্যস্ত এবং তারা আমাদের সমাজের মূল সংস্কৃতিকে ধারণ করে, যা অনেক মানুষ চিন্তাও করতে পারে না। মা-বোন ছাড়া কোনো ব্যক্তি কি বাঁচতে পারে? মেয়ে অথবা স্ত্রীর স্নেহ-মমতা ছাড়া কোনো ঘর কি চিন্তা করা যায়? নারী ছাড়া কোনো সমাজ কি এগিয়ে যেতে পারে? সম্ভব নয়।
আর্থিক সমৃদ্ধায়নে বাংলাদেশের অগ্রগতিতে নারীদের কী ভূমিকা তা অনুধাবনের জন্য অমর্ত্য সেনের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। অর্মত্য সেনের মতে, নানা আর্থসামাজিক ও রাজনীতিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের পক্ষে অভাবনীয় আর্থিক সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে মূলত নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতির জন্য। ‘অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি, ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশন্স’ (২০১৩) প্রবন্ধে অমর্ত্য সেন বলেছেন, “বাংলাদেশের বেগবান নারী-আন্দোলন, সক্রিয় এনজিও-কার্যক্রম ও বেইজিং-পরবর্তী বিশ্ব-নারী-উন্নয়ন এজেন্ডার প্রভাবে নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ সরকারের নারী উন্নয়ন নীতি ও তা বাস্তবায়নের কার্যকর কৌশলের লক্ষ্যে যে ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে বাংলার নারীজীবনে এক নীরব বিপ্লবের সূচনা ঘটে, যাকে বিশ্বব্যাংক আখ্যা দিয়েছে ‘হুইসপার টু ভয়েসেস’ (২০০৮)।”
সুতরাং এটি সহজে অনুমেয় যে, নারীরা আমাদের সমাজের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের আসন ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছে। আজ আমরা যে অবস্থানে আছি, এ অবস্থানে কখনও আসতে পারতাম না, যদি না-থাকত নারীদের অবদান। আমাদের আত্মবিশ^াসী, উচ্চাকাক্সক্ষী এবং বিশ^াসী মা-বোনদের অনেক অবদান রয়েছে বাংলাদেশের এ অবস্থানে আসার পেছনে। আমাদের বোনেরা দৃঢ়চেতা, কাজের প্রতি নিষ্ঠাবতী, উন্নয়নের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধেও আমাদের নারীদের অবদান ছিল অবিস্মরণীয়।
আমি সবিনয়ে বলতে চাই, হে পুরুষ, একটু বিবেচনা করুন, নারীরা আমাদের সমাজের অর্ধেক। অযথা তাদের পেছনে লাগলে আপনাকে নেতৃত্বের পদ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। কারণ, নারী আপনার ঘর এবং সন্তানের সবচেয়ে নিকটে অবস্থানকারী একটি অনিবার্য গোষ্ঠী।
বাংলাদেশের নারীদের সক্ষমতার ওপর আমার দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস আছে। তাদের কৃতিত্ব ও সাফল্য তাদের পক্ষ হয়ে কথা বলে এবং সকল সন্দেহ, সংশয় এবং অবিশ্বাস দূর করে দেয়। নারীর ক্ষমতায়ন সরকার সব ক্ষেত্রেই করতে চায়। আসলে না করে উপায় নেই। সরকার মনে করে, দেশের প্রতিটি কোম্পানির এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা বোর্ডে নারী-সদস্য রাখা আবশ্যক। অতএব আমি সবিনয়ে বলতে চাই, হে পুরুষ, একটু বিবেচনা করুন, নারীরা আমাদের সমাজের অর্ধেক। অযথা তাদের পেছনে লাগলে আপনাকে নেতৃত্বের পদ থেকে বঞ্চিত হতে হবে। কারণ, নারী আপনার ঘর এবং সন্তানের সবচেয়ে নিকটে অবস্থানকারী একটি অনিবার্য গোষ্ঠী।
নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে লোকজন আমাকে জিজ্ঞেস করে। উত্তরে আমি বলি, প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্ধেক সদস্য হবে নারী। কোম্পানিগুলোর অর্ধেক গ্রাহক হচ্ছে নারী এবং ঠিক তেমনিভাবে সরকারি সংস্থার নিয়ম-নীতির অর্ধেক প্রভাব পড়ে নারীদের ওপর। তা হলে, এটা কি ন্যায়বিচার? আমরা পুরুষরা অর্ধেক জনগোষ্ঠী হয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব! এটি যথার্থ হবে না। সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ যত নিবিড় হবে উন্নয়নও হবে তত টেকসই ও বিস্তৃত। সারাবিশ্ব এখন নারীদের ক্ষমতায়নের সুফল ভোগ করছে। অনেক নারী এখন বিশ্ব-নেতৃত্বে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়াও মালালা, অ্যাঞ্জেলা মার্কেল, হিলারি ক্লিনটন, মিশেল ওবামা, সোনিয়া গান্ধী, অং সান সুচি, ক্রিস্টিনা ফার্নান্দেজ, দিলমা রুসেফ, অফরাহ উইনফে, শেরি স্যান্ডবার্গ ও ইন্দ্রা নুয়ি ছাড়া আরও অনেক প্রভাবশালী নারীর কথা বলা যায়।
আমরা আধুনিক ও প্রাচীন ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাব, মায়ের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বিখ্যাত ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন বহু মানুষ এবং বহু নারী নিজের কৃতিত্বে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছেন। নারীদের বহু অবদান আছে বদান্যতায়, মহত্ত্বে এবং দানশীলতায়। মনে পড়ে আমার বেগম রোকেয়ার কথা। ’৪৭-পরবর্তী সময়ে বাংলার নারী-জাগরণের সূচনায় যাঁদের অনবদ্য অবদান সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করতে হয় তাঁদের মধ্যে সুফিয়া কামাল, নূরজাহান বেগম প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। তাঁরা সম-অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে এনজিও-ভিত্তিক নারী-আন্দোলনের বিশাল ক্ষেত্র উন্মোচিত করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব-নেত্রীবর্গের মধ্যে ইন্দিরা গান্ধী, মাদার তেরেসা, রানি ভিক্টোরিয়া, জোয়ান অব আর্ক, অ্যান ফ্রাংক, মার্গারেট থ্যাচারসহ আরও অনেকের কথা বলা যায়।বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম পর্যায় ছিল দারিদ্র্য দূরীকরণের চেষ্টা। আশির দশকে গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে গ্রামীণ নারীরা চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করে উপার্জনের পথ খুঁজে পায়। পরবর্তী সময়ে ব্র্যাক ও অন্যান্য এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে শুরু করে। গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে ২৬ মিলিয়নের মতো দরিদ্র মানুষ উন্নয়নের পথ খুঁজে পায়।৩৪ এ ঋণগ্রহীতাদের ৯৭ শতাংশের অধিক নারী, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কারণে ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দারিদ্র্য হ্রাসের বার্ষিক হার ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে : ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টি দূর করে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, শ্রীলঙ্কাসহ সব দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের আর্থিক সমৃদ্ধিতে জাতি বহুলাংশে নারীদের কাছে ঋণী।
আমরা ইতোমধ্যে নারীর ক্ষমতায়নের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে ফেলেছি। আমরা আমাদের সমাজকে ক্ষমতায়ন করেছি, আর এই সমাজের মাধ্যমে নারীরাও ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়েছে। আজকের মহিয়সী ও সফল নারীরাই আগামী দিনের নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা জোগাবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে নারীশিক্ষার অকল্পনীয় অগ্রগতি, প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গসমতা-স্থাপন এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অধিক অংশগ্রহণের ধারাবাহিকতায় নারীর প্রজনন-হার অর্ধেকের বেশি হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে শিশুমৃত্যু-হার ৭২ শতাংশ নেমে এসেছে। এ সাফল্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু অনুকরণীয় দৃষ্টান্তই স্থাপন করেনি, বরং সহস্রাব্দ উন্নয়ন-লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনে প্রথম স্থান অধিকার করে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন প্রতিবেদন (২০১১) অনুযায়ী, বাংলাদেশে নারীশিক্ষার হার (১৫ থেকে ২৪ বছর) ৭৮ শতাংশ, যার বিপরীতে পুরুষের শিক্ষার হার ৭৫ শতাংশ। এটি বিশ্বে একটি অন্যতম অর্জন।
বৃষ্টি সম্পর্কে বলা হয়, বৃষ্টি যেখানেই পড়ে সেখানে প্রাচুর্য সৃষ্টি করে। বৃষ্টি স্নেহ ও মায়া-মমতার প্রতীক। এমন বোধ আমরা নারীতে দেখতে পাই। আমাদের একটা বিষয় মনে রাখা উচিত- “Wherever you find a great man, you will find a great mother or a great wife standing behind him- or so they used to say. It would be interesting to know how many great women have had great fathers and husbands behind them.”
আমাদের দায়িত্ব নারীদেরকে নিরাপদ কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া, যাতে তারা তাদের সর্বোচ্চ সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে। অন্যকথায়, বৃষ্টির পানিতে ভালো ফসল ফলাতে হলে অবশ্যই মাটির ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে কাজের এমন পরিবেশ তৈরি করা, যাতে নারীরা ইজ্জত, সম্ভ্রম ও নারীত্ব বজায়ে রেখে তাদের সম্ভাবনাকে বিকশিত করতে পারে। মেধার মূল্যায়ন, সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং তাদের জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ করার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
এরকম পরিবেশ দিতে পারলে, আমি বিশ্বাস করি যে, নারীরা সবকিছুই করতে সক্ষম হবে। এটা অলৌকিক কিছু নয়- এটাই বাস্তবতা। নারীরা সাধারণত কাজকর্ম ও দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি প্রফেশনাল, তাই কোনো কাজে তারা যত আন্তরিক পুরুষেরা তত আন্তরিক হতে পারে না। তাদের এ অন্তর্নিহিত ক্ষমতাকে আমাদের কাজে লাগাতে হবে।
আগামীকাল কাল থাকছে - 'অধ্যায়ন, লেখালেখি ও নেতৃত্ব'
আরও পড়ুন - ‘সাফল্যের স্বর্ণদ্বার’ , ‘ঐক্যবদ্ধ শক্তি সাফল্যের মেরুদণ্ড’ ‘পদ্মা সেতু’, `বিজয়চিহ্ন 'V' প্রকাশে ভিন্নতা', ‘উন্নয়ন ও অগ্রাধিকার’ , ‘ইতিবাচক ভাবনা সাফল্যের চাবিকাঠি’ , ‘ভবিষ্যতের সরকার কেমন হবে’ ‘মাতৃভাষার প্রতি মমতা’, ‘সুখ ও শান্তি : আমাদের করণীয়’ , ‘নেতৃত্বের শক্তি’, ‘আদর্শ জীবন গঠনে মূল্যবোধ’, ‘আমার প্রাত্যহিক জীবন’, 'আমার অনুভব'।মন্তব্য করুন