মহাত্মা গান্ধী শৈশবে যেমন ছিলেন

স্বকৃত নোমান
 | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ১২:৫২

ভারতের গুজরাটের অধিবাসী কাবা গান্ধী বা করমচাঁদ গান্ধী ছিলেন পোরবন্দরের দেওয়ান। ব্যক্তি হিসেবে তিনি সত্যানুরাগী, উদার; কিন্তু রাগী। পর পর চারটি বিয়ে করেন। প্রথম দুই স্ত্রীর ঘরে দুই মেয়ে। চতুর্থ স্ত্রী পুতলী বাঈয়ের ঘরে এক মেয়ে ও তিন ছেলে। এ চার ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার ছোট মোহনদাস। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর পোরবন্দর অথবা সুদামাপুরীতে জন্ম মোহনদাসের।

ছোটবেলা থেকেই নিয়ন্ত্রিত জীবনে অভ্যস্ত ছিল মোহন। ধার্মিক মায়ের সঙ্গে এবং গুজরাটের জৈন ধর্ম প্রভাবিত পরিবেশে থেকে ছোটবেলা থেকেই জীবের প্রতি অহিংসা, নিরামিষ ভোজন, আত্মশুদ্ধির জন্য উপবাসে থাকা, বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয় শিখতে শুরু করে। বাল্যকাল কাটে পোরবন্দরেই। শৈশবে কোনো স্কুলে পড়েনি, বাড়িতেই অনেক কষ্টে কয়েকটি নামতা শেখে। বুদ্ধিও খুব একটা তীক্ষè ছিল না, স্মরণশক্তিও ছিল কাঁচা।

পোরবন্দর থেকে তার বাবা রাজস্থানিক কোর্টের সভ্য হয়ে রাজকোটে এলেন। মোহনের বয়স তখন সাত। তাকে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো রাজকোটের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছাত্র হিসেবে খুব একটা ভালো ছিল না। মাঝারি ধরনের বলা যায়। দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময় একটা পুরস্কার পেল। চতুর্থ শ্রেণীতে চার টাকা, পঞ্চম শ্রেণীতে দশ টাকার বৃত্তি পেল। এই বৃত্তি আবার সবাই পেত না। যারা ‘সোরাট’ অঞ্চল থেকে পড়তে আসত শুধু তারাই পেত। পুরস্কার বা বৃত্তি পেলে অবাক হতো মোহন।

নিজের ব্যবহার ও আচরণ সম্পর্কে বিশেষ সচেতন ও সতর্ক থাকত সবসময়। কোনো কারণে আচরণে ত্রুটি ঘটলে কেঁদে ফেলত। শিক্ষকরা তিরস্কার করতে পারেন এমন কোনো কাজ করলে দুঃখের আর সীমা থাকত না তার। একবার শিক্ষকের হাতে মার খেল। মার খাওয়ার জন্য তার দুঃখ হলো না, কিন্তু সে যে মার খাওয়ার যোগ্য দোষী বলে গণ্য হলো, সেজন্য খুবই দুঃখ পেল।

আরেকবারের ঘটনা। সে তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের হেডমাস্টারের নাম দোরাবজী এদুলজী গীমী। ছাত্ররা খুবই ভালোবাসে তাকে। ন্যায় ও নিয়মনিষ্ঠ মানুষ। শৃঙ্খলাপরায়ণ ছাত্রদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতেন। পড়াতেনও ভালো। উপরের ক্লাশের ছাত্রদের ব্যায়াম করা তিনি বাধ্যতামূলক করলেন। কিন্তু ব্যায়াম ভালো লাগে না মোহনের। স্কুলে নিয়ম হওয়ার আগে কখনো ব্যায়াম করেনি। কখনো ফুটবল বা ক্রিকেটও খেলেনি। স্বভাবে লাজুক প্রকৃতির ছিল বলেই খেলাধুলায় অনীহা তার। সহজে কারো সঙ্গে মিশত না, বইপত্র আর লেখাপড়াই তার একমাত্র সঙ্গী। ঘণ্টা বাজার সময় স্কুলে পৌঁছত, ছুটি হলেই আবার বাড়ি ফিরে আসত। স্কুলের কারো সঙ্গে কথাবার্তা বা গল্প করা একদম ভালো লাগত না। ভয় হতো, কথা বললে যদি কেউ তার সঙ্গে ঠাট্টা করে!

তখন তার বিশ্বাস ছিল ব্যায়ামের সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। অসুস্থ বাবার সেবা করার গভীর ইচ্ছাও ব্যায়ামকে অপছন্দ করার অন্যতম কারণ। স্কুল ছুটি হলেই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে বাবার সেবায় লেগে যেত। স্কুলে ব্যায়াম করার আদেশ জারি হওয়ায় বাবার সেবায় বিঘœ ঘটতে লাগল। বাবার সেবার জন্য ব্যায়ামের ক্লাসে হাজির হবে না বলে অনুনয় করল হেডমাস্টারের কাছে, কিন্তু গীমী সাহেব তা মানলেন না।

এক শনিবারের কথা। বিকেল চারটায় ব্যায়াম করতে যাওয়ার কথা। আকাশ মেঘলা ছিল বলে বেলা টের পেল না মোহন। সে যখন ব্যায়ামস্থলে পৌঁছল সবাই তখন ফিরে যাচ্ছে। খুব মন খারাপ হলো তার। পরদিন গীমী সাহেব হাজিরা পরীক্ষা করে দেখলেন মোহন অনুপস্থিত ছিল ব্যায়ামে। কারণ জিজ্ঞেস করলে মোহন সত্য কথাটি বলল। কিন্তু গীমী সাহেব তার কথা বিশ্বাস করলেন না, মিথ্যা বলার জন্য দুই আনা জরিমানা করে দিলেন। খুবই দুঃখ হলো মোহনের। সে মিথ্যা বলেনি, একথা কিভাবে প্রমাণ করবে? কোনো উপায়ও ছিল না। মনের যন্ত্রণা মনেই রয়ে গেল। বুঝল যে, সত্য যে বলতে চায়, সত্য যে পালন করতে চায়, তার অসাবধান হওয়া চলবে না। ভবিষ্যতে আর এমন ভুল না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় গীমী সাহেব জরিমানার টাকা মওকুফ করে দিলেন।

মাধ্যমিক স্কুলের একটি ঘটনা থেকেই বোঝা যায় শৈশবে কতটা সহজ-সরল ছিল মোহন। শিক্ষা বিভাগের ইন্সপেক্টর জাইলস্ সাহেব এলেন স্কুল পরিদর্শনে। ছাত্রদের তিনি পাঁচটি শব্দের বানান লিখতে দিলেন। একটা শব্দ ছিল কবঃঃষব. শব্দটির বানান ভুল লিখল মোহন। মাস্টারমশায় তখন জুতার ডগা দিয়ে তাকে সাবধান করে দিলেন। ইশারায় বললে মোহন যেন তার সামনের ছেলেটির শ্লেট দেখে শব্দটি শুদ্ধ করে লেখে। কিন্তু মাস্টারের ইঙ্গিত বুঝল না সে। মনে করল, সে যাতে নকল করতে না পারে সেজন্যই বুঝি মাস্টার তাকে পাহারা দিচ্ছেন। অন্যের কাছ থেকে নকল করে লেখা সে জানতই না। পরে যখন নকলের ব্যাপারটা জানল, মাস্টার যে তাকে নকল করতে বলেছেন সেজন্য মাস্টারের প্রতি তার শ্রদ্ধা এতটুকু কমল না। পরে এই মাস্টারের আরো অনেক দোষ সে জানতে পেরেছিল। তবু তার প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অটুট। কারণ সে মনে করত, গুরুজনের আজ্ঞা পালন করতে হবে। তারা যা বলেন তাই করতে হবে। গুরুজন ভুল করলেও তা ধরা চলবে না।

দুই. মাস্টারের তিরস্কারের ভয়েই পাঠ্যবই পড়ে মোহন। নইলে পড়তই না। বইয়ের পড়া খুব একটা মনে থাকে না তার। পড়া অনেক সময় কাঁচা থেকে যায়। এই অবস্থায় পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যকোনো বই তো পড়ার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু একদিন তার বাবার কেনা একটি বইয়ের ওপর চোখ গেল তার। ‘শ্রবণের পিতৃভক্তি’ নামের একটি নাটকের বই। বইটি পড়তে হবে, মাথায় ঝোঁক চাপল তার। গভীর আগ্রহের সঙ্গে বইটি সে পড়ে ফেলল।

সে-সময় একদিন বাড়িতে একজন বায়োস্কোপঅলা এলো। ঝুনঝুনি বাজিয়ে বায়োস্কোপে শ্রবণের পিতৃভক্তির ছবি দেখাচ্ছে বায়োস্কোপঅলা। একটি ছবিতে মোহন দেখল, বাবা-মাকে একটা ভাঁড়ায় বসিয়ে সেই ভাঁড়া কাঁধে নিয়ে তাদেরকে তীর্থস্থানে নিয়ে যাচ্ছে শ্রবণ। দৃশ্যটি মোহনের মনে দাগ কাটল। সিদ্ধান্ত নিল, তাকেও শ্রবণের মতো বাবা-মায়ের ভক্ত হতে হবে, সেবা করতে হবে।

তারপর একদিন গ্রামে একটা নাটকের দল এলো। বাবা-মায়ের কাছ থেকে নাটক দেখার অনুমতি পেল মোহন। নাটকের বিষয় ছিল হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান। নাটকটি দেখে তার আশা মেটে না, বারবার দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্ত কে তাকে এতবার দেখাবে? হরিশচন্দ্রকে স্বপ্ন দেখে মোহন। ‘হরিশচন্দ্রের ন্যায় সত্যবাদী সকলে কেন হয় না?’ তার মনে হরদম এই প্রশ্ন বাজতে থাকে। ভাবল, হরিশচন্দ্রের মতো বিপদে পড়লে তারই মতো তাকেও সত্য পালন করতে হবে। নাটকে যেমন লেখা হয়েছিল, হরিশচন্দ্রের যেসব বিপদ হয়েছিল, সবই সত্য মনে হলো তার। হরিশচন্দ্রের দুঃখের কথা মনে করে সে গোপনে কাঁদত।

তিন. বাবা-মায়ের ইচ্ছায় খুব অল্প বয়সে বিয়ে করতে হয়েছিল মোহনকে। ছোটবেলায় তিনবার ‘সগাই’ হয়েছিল তার। সগাই অর্থ বিয়ের প্রতিশ্রুতি। ছেলে ও মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে তাদের বাবা-মায়ের মধ্যে যে প্রতিশ্রুতি বিনিময় হয়, তাকেই বলে সগাই। প্রথম দুই মেয়ে মরা গেল। সাত বছর বয়সে তৃতীয় আরেকটি মেয়ের সঙ্গে সগাই হলো তার।

মোহনের বয়স তখন মাত্র তের। বাড়িতে একদিন বিয়ের প্রস্তুতি। কিন্তু কার বিয়ে? এই প্রথম সে জানল তার বিয়ের কথা। বিয়ে কী সে তখনো বোঝে না। বিয়ে বলতে তার কাছে ভালো জামা-কাপড় পরা, বাজনা বাজানো, শোনা, শোভাযাত্রা দেখা, পাঁচ রকম ভালো খাবার খাওয়া এবং অচেনা এক মেয়ের সঙ্গে খেলা করা। এ ছাড়া আর কিছু নয়। ঠিক এই অবুঝ বয়সেই, ১৮৮৩ সালে, কস্তুরবাঈ মাখাঞ্জীর সঙ্গে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হলো।

কস্তুরবাঈ ছিল নিরক্ষর। কিন্তু সরল, স্বাধীনচেতা এবং দৃঢ়সংকল্পের এক নারী। কথা বলত কম। স্বামীর সঙ্গেও খুব বেশি কথা বলত না। নিরক্ষরতার জন্য তার ভেতর কোনো অসন্তোষ ছিল না। স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখানোর ইচ্ছা মোহনের। কিন্তু স্ত্রীর তাতে আগ্রহ কম। মোহনেরইবা সময় কই? সারাক্ষণ পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। তবে স্ত্রীর প্রতি খুবই ভালোবাসা ছিল তার। স্কুলে গিয়েও তার কথা মনে পড়ত। তার বিচ্ছেদ অসহ্য বোধ হতো। কখন রাত হবে, কখন আবার তার সঙ্গে দেখা হবে, এই ছিল তার সারা দিনের ভাবনা।

বিয়ের কারণে পড়ালেখায় এক বছর বিঘœ সৃষ্টি হলো। ঐ এক বছরের ঘাটতি পূরণ করে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন মাস্টারমশাই। পরিশ্রমী ছাত্রদের তখন এমন সুযোগ দেওয়া হতো। তৃতীয় শ্রেণীতে মাত্র ছয় মাস পড়ে গ্রীষ্মকালীন ছুটির পর চুতুর্থ শ্রেণীতে ওঠার আদেশ পেল মোহন। চতুর্থ শ্রেণী থেকে কোনো কোনো বিষয় ইংরেজিতে পড়ানো হতো। মোহন ইংরেজির কিছুই বুঝত না। বিশেষ করে জ্যামিতি। ইংরেজিতে জ্যামিতি পড়ানো হয় বলে কিছুই বুঝত না সে। জ্যামেতির মাস্টার ভালোই পড়াতেন, কিন্তু তার মাথায় কিছুই ঢুকত না। অনেক সময় সে খুবই নিরাশ হতো। দুই ক্লাস এক বছরে শেষ না করে আবার তৃতীয় শ্রেণীতে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হতো মাঝেমধ্যে। কিন্তু তাতে তো লজ্জা। যে শিক্ষক তাকে প্রমোশন দিয়েছেন তারও লজ্জার কারণ হবে। এই ভয়ে নিচের ক্লাসে নামার চিন্তা বাদ দিল।

জ্যামিতি বোঝার চেষ্টা করতে লাগল। চেষ্টা করতে করতে ইউক্লিডের ত্রয়োদশ প্রতিজ্ঞা পর্যন্ত যখন এলো তখন হঠাৎ দেখল যে, জ্যামিতি খুই সহজ একটা বিষয়, যেখানে শুধু বুদ্ধিরই সহজ ও সরল প্রয়োগ। তারপর থেকে জ্যামিতি তার কাছে খুবই সহজ বিষয় হয়ে উঠল। তবে মুশকিল হলো সংস্কৃতে। জ্যামিতিতে মুখস্থ করার কিছু ছিল না, কিন্তু সংস্কৃত তো মুখস্থ করার বিষয়, অন্তত তার কাছে। সে তখন সপ্তম শ্রেণীতে। সংস্কৃত শিক্ষক খুবই কঠোর। ছাত্রদের তিনি সংস্কৃত শেখাবেনই। সংস্কৃত ও ফরাসি ক্লাসে এক রকম প্রতিযোগিতা ছিল। ছাত্ররা আড়ালে-আবড়ালে বলাবলি করত যে, ফরাসি বড় সহজ ও ফরাসি শিক্ষক বড় ভালো। শুনে ফরাসি শেখার ইচ্ছে হলো মোহনের। একদিন ফরাসি ক্লাসে গিয়ে বসল সে। এতে সংস্কৃত শিক্ষক খুবই রাগ করলেন। মোহনকে ডেকে বললেন, তুমি কাদের ছেলে বুঝে দেখ। তোমার নিজের ধর্মের ভাষা তুমি শিখবে না? তোমার যা কঠিন লাগে তা আমার কাছে নিয়ে এসো। আমার তো ইচ্ছে করে সব ছাত্রকেই ভালো করে সংস্কৃত শিখিয়ে দেই। আরো ভালো করে শিখলে এতে খুব রস পাবে। এরকম হার মানা তোমার উচিত নয়। তুমি আবার আমার ক্লাসে ফিরে আসো।

শিক্ষকের কথা শুনে খুব লজ্জা পেল মোহন। শিক্ষক তাকে যে উপদেশ দিলেন, তার অপমান করতে পারল না। আবার সে সংস্কৃত শেখার সিদ্ধান্ত নিল।

চার.

মোহনের বয়স তখন ষোল বছর। তার অসুস্থ বাবা সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে। মোহন, তার মা এবং বাড়ির এক চাকর বেশিরভাগ সময় রোগীর সেবায় ব্যস্ত। মোহনের কাজ ছিল নার্সের মতো। বাবার গা ধোয়ানো এবং গায়ে মলম লাগানো, ওষুদ খাওয়ানো এবং যদি বাড়িতে ওষুদ তৈরি করতে হয় তা করা, এসবই ছিল তার বিশেষ কাজ। রাতে সাধারণত বাবার পা টিপে দিত। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে সে ঘুমাতে যেত। বাবার সেবা করা তার খুবই প্রিয় একটি কাজ। এমন কোনো দিন নেই যেদিন সে বাবার সেবা করে না। পড়ালেখা আর বাবার সেবা, এছাড়া তার আর কাজ নেই। যেদিন বাবার শরীর ভালো থাকত সেদিন সন্ধ্যায় শুধু বেড়াতে বের হতো। কিন্তু বেশি দিন আর বাঁচলেন না বাবা, রোগের সঙ্গে লড়তে লড়তেই তিনি মৃত্যু বরণ করলেন।

১৮৮৭ সালে ম্যাট্রিক পাস করল মোহন। গুরুজনদের ইচ্ছা ম্যাট্রিক পাস করার পর কলেজে গিয়ে সে আরও পড়বে। কলেজ আছে বোম্বাই ও ভবনগরে। ভবনগরে খরচ কম বলে সেখানকার শ্যামলদাস কলেজে পড়তে যাবে বলে সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু কলেজে গিয়ে মোহন কিছুই বোঝে না, সবই কঠিন লাগে তার কাছে। অধ্যাপকরা যা পড়ান তাতে না পায় আনন্দ, না পারে বুঝতে। এতে অধ্যাপকদের দোষ নেই। তখনকার দিনে শ্যামলদাস কলেজে যারা অধ্যাপন করতেন তারা প্রথম শ্রেণীর অধ্যাপক বলে গণ্য হতেন। ছাত্র হিসেবে মোহন কাঁচা, তাই বুঝতে কষ্ট হয় তার।

কলেজের প্রথম টার্ম শেষ হওয়ার পর বড়ি এলো মোহন। তখন তাদের পরিবারে মাভজী দাভে নামে এক ব্রাহ্মণ আসতেন। নানা বিষয়ে তিনি পরামর্শ দিতেন। বিদ্বান, অভিজ্ঞ ও বিচক্ষণ মানুষ। মোহনের মায়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি মোহনের পড়ালেখার বিষয়ে জানতে চাইলেন। শ্যামলদাস কলেজে পড়ছে শুনে তিনি বললেন, সময় বদলেছে। ছেলেদের মধ্যে কাউকে যদি কাবা গান্ধীর স্থালাভিষিক্ত করতে চাও তাহলে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। বি-এ পাস করতে এখনো চার-পাঁচ বছর লাগবে মোহনের। পাস করে পঞ্চাশ-ষাট টাকার চাকরি একটা পাওয়া গেলেও দেওয়ানি পাওয়া যাবে না। যদি আমার ছেলের মতো আইন পড়তে যায় তবে আরও সময় লাগবে এবং ততদিনে দেওয়ানি পাওয়ার জন্য অনেকে ওকালতি পাস করে এসে জুটবে। তারচেয়ে বরং মোহনকে তোমরা বিলেত পাঠিয়ে দাও। বিলেত থেকে সহজেই ব্যারিস্টার হয়ে আসা যায়। মাত্র তিন বছর লাগে। খরচও চার-পাঁচ হাজারের বেশি লাগবে না। আমার মতে তাকে এ বছরই বিলেত পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।

সিদ্ধান্ত হলো বিলেতেই পাঠানো হবে মোহনকে। মোহনের তো আনন্দের সীমা নেই। কলেজে পড়া চালিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভবই মনে হচ্ছিল। তখন তার বয়স মাত্র আঠারো বছর। ১৮৮৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে গেল সে। রাজকীয় রাজধানী লন্ডনে তার জীবন যাপন ছিল ভারতে থাকতে তার মায়ের কাছে করা শপথ প্রভাবিত। জৈন সন্ন্যাসি বেচার্জীর সামনে সে তার মায়ের কাছে শপথ করেছিল, মাংস, মদ এবং উচ্ছৃঙ্খলতা ত্যাগ করার হিন্দু নৈতিক উপদেশ পালন করবে।

১৮৯১ সালের ১০ জুন তাকে ব্যারিস্টার করা হলো। আড়াই শিলিং দিয়ে ইংল্যান্ডের হাইকোর্টের তালিকায় নিজের নাম ওঠাল। একই বছরের ১২ জুন আবার দেশে সে ফিরে এলো।

এর পরের ইতিহাস অন্য। শৈশব-কৈশোরের সেই মোহনদাস ধীরে ধীরে বদলে গেলেন। ভারতজুড়ে তার নাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তিনি হয়ে উঠলেন ভারতের অন্যতম প্রধান রাজনীতিবিদ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রগামী ব্যক্তিদের একজন এবং প্রভাভশালী আধ্যাত্মিক নেতা। তার নামের শুরুতে যুক্ত হয়ে গেল ‘মহাত্মা’ উপাধি। বিশ্বব্যাপী তিনি পরিচিত হয়ে উঠলেন ‘মহাত্মা গান্ধী’ নামে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক। সহযোগী সম্পাদক, এই সময়

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :