বিদায়, বিদায় কমরেড!

আনন্দ মজুমদার
| আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:০৭ | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:১৬

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ‘লোকান্তরিত’ হয়েছেন এ কথা খুব জোরের সঙ্গে বলা যায় না। তিনি লোকমানসে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন। চে আর তিনি সারা দুনিয়ার তরুণদের কাছে বারবার প্রেরণার প্রতীক হয়ে বেঁচে থাকবেন।

১৯৫৯ সালের জুন মাসের ৮ তারিখে হাভানায় স্বৈরাচারী বাতিস্তার পতনের চূড়ান্ত ঘণ্টা বাজালেন ফিদেল। এই ঘটনা সোভিয়েত বিপ্লবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। স্নায়ুযুদ্ধের টান টান উত্তেজনার মধ্যে যখন সারা দুনিয়া দুই শিবিরে বিভক্ত, তখন কাস্ত্রোর উত্থান মার্কিনীদের নাকের ডগায় ঘন ঘাম জমছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই। সব হুমকি-ধামকি এক তুড়িতে উড়িয়ে দিলেন এই মহান নেতা।

তিনি শুধু কিউবার ইতিহাসের নয়া রূপকার নন, গোটা লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের গতিপথের নির্ধারকও। ১৯১০ সালে সংঘটিত মেক্সিকান বিপ্লব ছাড়া বিশ শতকের আর কোনো বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের বাঁক বদলের নির্ধারক মুহূর্তের, ঐতিহাসিক ক্ষণের দীর্ঘায়ত ঢেউ সৃজন করতে সক্ষম হয়নি। গত পঞ্চাশ বছরে এগারজন মার্কিন মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্রপতি দিনে-রাতে তাকে স্মরণ করতে বাধ্য হয়েছেন। কমরেড, দুনিয়ার অন্য জায়গার সব বৈপ্লবিক সম্ভাবনা নস্যাৎকারী মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে তার লড়াইয়ের রণনীতি ও রণকৌশল থেকে দুনিয়ার বিপ্লবীরা আজীবন পাঠ গ্রহণ করবে।

তিনি রাজনৈতিক সত্তা আকারে অনুভব, প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়ার জগতের বাইরে চলে গেলেন। আমি যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, স্বপ্ন ও সংকল্পের মূর্ত প্রতীক, সারা দুনিয়া ও লাতিন আমেরিকার আগামী ইতিহাস যার মধ্য দিয়ে প্রস্তাবিত, সেই সুঠাম ফিদেল অবিস্মরণীয় ভাষণে দুনিয়ার মানুষকে বলেই যাচ্ছেÑ লড়াই অব্যাহত রাখুন।

ফিদেল ইতিহাসের ইতিবৃত্তের খুঁটিনাটির বাইরে। ১৯৫৩ সালের সেই বিবৃতি কি ভোলা যায়! মনকাডার সামরিক ব্যারাক তছনছ করে দিলেন। বাতিস্তা পনের বছরের সাজা দিল। কারাগার তার জন্য অপেক্ষমাণ ছিল। আর ছিল ঘন অরণ্য, পাহাড় ও মানুষ। কিছুই করতে পারল না স্বৈরশাসক। সেই এজলাসের মজলিশে তার সেই অবিসংবাদিত বক্তব্য মানবজাতির ইতিহাসে অক্ষয় অক্ষরে লেখা থাকবে। আদালতের ধারাবিবরণী এতই যুক্তিপূর্ণ ছিল যে, বাতিস্তা তা প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। কিন্তু ছয়জন সাংবাদিক এই ঘটনার সাক্ষী। তারা সব ফাঁস করে দিল।

কমরেড, আজ আপনার প্রতি পরম শ্রদ্ধায় সব তরুণ, আবালবৃদ্ধবনিতা, অশ্রু নয় নিজেদের সংগ্রামী আদর্শে বলীয়ান হয়ে উঠুক। সব সংগ্রামীই ইতিহাসের অগ্রগামী মানুষের প্রেরণা! আপনি ইতিহাস রেখে লোকান্তরে গেলেন! কমরেড, শেষ বিদায়, লাল সালাম।

আমি তাদেরকে ভয় পাই না যারা আমার সাথীদের হত্যা করেছে। কমরেড, শেষ বিদায়ের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে দুই ফোঁটা অশ্রু যদি গড়িয়ে যায়, তবে জানবেন আমাদের চিন্তার গভীরে আপনি নিদ্রাচ্ছন্ন! বিদায়, বিদায় কমরেড!

বাংলাদেশের সঙ্গে ছিলেন কাস্ত্রো। মনে পড়ে, একাত্তরে! আমাদের সঙ্গে থাকুন, থাকুন সব সংগ্রামী জনতার সঙ্গে । কত কত কথা মনে পড়ে। আজ কথা ফুরাবে না। ১৯৮৫ সালে প্লেবয় ম্যাগাজিনে কাস্ট্রোর বিখ্যাত এক সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনাকে রিগ্যান ‘নিষ্ঠুর সামরিক একনায়ক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, কী জবাব আপনার, কমরেড? ‘চলুন ভাবি আপনার প্রশ্নটা নিয়ে’, বললেন তিনি, ‘যদি একনায়কতন্ত্রের অর্থ এই দাঁড়ায় যে, ডিক্রি জারি করে শাসন করা, তাহলে এই যুক্তিটা আপনি পোপকে একনায়কতান্ত্রিকতার অভিযোগ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করবেন!’

রিগ্যানকে তিনি যা বলেছিলেন সেটা হলো, তার ক্ষমতা দানবীয় রকমের অগণতান্ত্রিক! যা হোক, কথা বলছিলেন, থার্মোনিউক্লিয়ার যুদ্ধের বোতাম যাদের হাতে তারা কী করে হয় গণতান্ত্রিক! কত ভাষণ! ইতিহাস থেকে কিছুই হারাবে না।

সে সময় তো তিরিশ মাত্র। কিউবার সেনাবাহিনীর ভূমিকা আপনি শুধু কিউবার প্রতিরক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখলেন না, গোটা আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত রাখলেন। কমরেড, আপনি বারবার বলেছেন, ‘আমি ভয় পাই না’। আপনার মৃত্যু আমাদেরকে বারবার স্মরণ করতে বাধ্য করে, লাতিন আমেরিকা ও বাংলাদেশ একসঙ্গে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল! স্মরণেই ত্বরণ! সম্পর্কই শক্তি। আপনার সঙ্গে গভীর সম্পর্কের ডোরে আমরা বাঁধা। সারা জাতির পক্ষ থেকে আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। কিউবাকে কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি। আজ মনে হচ্ছে, আপনাকে কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না, বাংলাদেশ। ফিদেল আমাদেরও, কাস্ত্রো সবার।

আজ সব কথা বলে শেষ করা যাবে না। আজ আপনার দু চোখ বোঁজা। তবু সেই মুখ বারবার তাজা হয়ে উঠবে আমাদের কাছে। আপনি চিরতরুণ, চির চেনা মুখ! মেহনতী মানুষ সব সময়ই বলবে, আমাদের প্রেসিডেন্ট একজনই, ফিদেল। চে’র সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, বাংলাদেশ আপনাদের দুজনকেই মনে রেখেছে, রাখবে। বিদায়! আনন্দ মজুমদার : কবি ও চিন্তক

ঢাকাটাইমস/২৮নভেম্বর/এএম/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :