আমাদের কবি মুখ্য সচিব কামাল চৌধুরী

রাজু আলীম
| আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ২০:০৫ | প্রকাশিত : ২৮ নভেম্বর ২০১৬, ২০:০২

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন কবি কামাল চৌধুরী। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ এবং তরুণ প্রজন্মের কাছে নানা কারণে আলোচিত নাম কামাল চৌধুরী। একদিকে তিনি সরকারের সচিব হিসেবে জনকল্যানমূলক কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে পৌঁছে গেছেন সাধারণ মানুষের কাছে। অপরদিকে কবি হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে অবস্থান করে দেশি বিদেশি গণমাধ্যম ও তরুণ প্রজন্মের সামনে আদর্শ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কবি কামাল চৌধুরী বাবার হাত ধরে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে ছুটে এসেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। বালক বয়সে শোনা সেই ভাষণ কামাল চৌধুরীকে উদ্দীপ্ত করেছিল দেশপ্রেম এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বেড়ে উঠতে। আর পঁচাত্তরের পনের আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর অনেক প্রতিষ্ঠিত কবিও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে কবিতা লেখার সাহস পাননি। কিন্তু সব ভয় ভীতি উপক্ষো করে এই নারকীয় হত্যার প্রতিবাদ করে সেই সময়ে প্রথম কবিতা লেখেন কামাল চৌধুরী। তাই সব পরিচয় ছাপিয়ে কবি কামাল চৌধুরীর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীর জনকের কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাঙালি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী উন্নয়নকামী পরিপূর্ণ খাঁটি এক মানুষ।

সত্তর দশকের একজন বাঙালি কবি কামাল চৌধুরী। তিনি ২০১০ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হিসেবে কর্মরত। তার মৌলিক চারিত্রিক স্বভাবজাত সত্তা তিনি একজন কবি- উত্তর আধুনিক এই কবির কবিতার প্রধান বিষয়বস্তু প্রেম ও দ্রোহ। সমাজচেতনা কামাল চৌধুরীর কাব্যপ্রেরণার সূত্র। তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য গীতিময়তা। এই কবির অন্যতম কাব্যগ্রন্থ টানাপোড়েনের দিন- যাতে মুক্ত ছন্দে নতুন কাব্যভাষার সূত্রপাত করেছেন তিনি। ২০১২ সালে তাঁকে বাংলা কবিতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার প্রদান করা হয়।

তার পুরো নাম কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী। ১৯৫৭ সালের ২৮ জানুয়ারি কামাল চৌধুরীর জন্ম কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয় করা গ্রামে। বাবা আহমদ হোসেন চৌধুরী ও মা বেগম তাহেরা হোসেনের ছয় সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। ১৯৭৩ সালে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৭৫ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মাতাল জীবন- কাব্যলক্ষীর কাছে চিরসমর্পণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও তসলিমা নাসরিনসহ সমসাময়িক কবিদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। এই সময়েই নিজেকে তিনি কবিতা পথিক হিসেবে চিত্রিত করেন। কবিতা লিখতে লিখতেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন সমাজবিজ্ঞানে। কিন্তু সেখানেই লেখাপড়ার গণ্ডি শেষ হয়ে যায়নি। এরপরে সরকারি চাকরিতে থেকেই ফাঁকে ফাঁকে নৃবিজ্ঞানে পিএইচ, ডি করেন। পি এইচ, ডি গবেষণা করেছেন গারো জনগোষ্ঠীর মাতৃসূত্রীয় আবাস প্রথা নিয়ে। ২০১০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা সচিব হিসেবে পদোন্নতি লাভ করেন। ২০১৪ সালের মার্চ মাস থেকে জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে তিনি তথ্য সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। আর এরপরে তিনি সরকারের সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নের সময় ১৯৮১ সালের বাংলা একাডেমি বইমেলা উপলক্ষ্য করে একদল তরুণ কবি জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কামাল চৌধুরী তাদেরই একজন। এ উদ্দেশ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্রাবিড় প্রকাশনী। একুশের বইমেলাতেই বেরিয়েছিল কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ মিছিলের সমান বয়সী। এই বইয়ে কবিতার সংখ্যা ছিল ৪৮টি। এই বইয়ের কবিতার ভাষা ও শৈলী বলে দেয় কবি শামসুর রাহমান তাঁকে প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। কামাল চৌধুরীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। এরপর চাকরি জীবনের ব্যস্ততা তাঁকে কবিতা থেকে কিছুটা দূরে ঠেলে দেয়। ৮১ থেকে ৯০ একটানা নয় বছর কোনো কবিতার বই প্রকাশ করা হয়ে ওঠেনি তার পক্ষে। এই বন্ধ্যাত্ব কেটে যায় ১৯৯১ সালে। এ বছর প্রকাশিত হয় কামাল চৌধুরীর দ্বিতীয় কবিতা সংকলন টানাপোড়েনের দিন। অতঃপর একে একে আরও আটটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেগুলো হলো- এই পথ এই কোলাহল, এসেছি নিজের ভোরে, এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা, ধূলি ও সাগর দৃশ্য-২, রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল, হে মাটি পৃথিবীপুত্র, প্রেমের কবিতা এবং পান্থশালার ঘোড়া। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রকাশ করেছেন একটি বাছাই সংকলন নির্বাচিত কবিতা। এই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে প্রকাশ করেছেন কবিতা সংকলন। ১১টি গ্রন্থ থেকে ৩০৯টি কবিতা এই গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। এছাড়াও কামাল চৌধুরী ২০০৭ সালে প্রকাশ করেন কিশোর কবিতা সংকলন আপন মনের পাঠশালাতে। ১৯৭৫ সালে আলী রীয়াজ এর সঙ্গে যৌথভাবে সম্পাদনা করেছেন সত্তর দশকের কবিদের কবিতা। কাজের স্বীকৃতি হিসাবে ২০০০ সালে পেয়েছেন রুদ্র পুরস্কার, ২০০৩ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের সৌহার্দ্য সম্মাননা, ২০০৪ সালে কবিতালাপ সাহিত্য পুরস্কার, ২০০৮ সালে পেয়েছেন জীবনানন্দ পুরস্কার, ২০১০ সালে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার, ২০১০ সালে পান দরিয়ানগর কবিতা সম্মাননা এবং ২০১২ সালে কবি কামাল চৌধুরী লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার।

তিনি ১৯৮০ দশকের শুরুতে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর কবিতায় সমসাময়িক প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর প্রথম গ্রন্থের নাম ‘মিছিলের সমান বয়সী’, যার মধ্যে চিহ্নিত হয়েছে তাঁর কবিসত্তার প্রধান প্রবণতা। তিনি মূলত গীতিকবিতায় সাবলীল। সমসাময়িক অন্য কবিদের মতোই তাঁর কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের যৌথ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁর হাড়ের গল্প নামক কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশের প্রভাব পড়েছে ছন্দে, শব্দচয়নে এবং বিষয় বিস্তারে এই ভাবে-

এই তো হাড়ের গল্প। আজ রাতে বিচ্ছিন্ন বধির

পরশ্রীকাতর মাংস এতদিন আঁঠাল স্বভাবে বেঁধে রেখে

আজ ফিরিয়ে নিয়েছে তার অন্ধমুখ।

অন্যদিকে ছন্দ এবং অন্তমিলে যে স্বাভাবিক দক্ষতা তাঁর রয়েছে তা কখনো কখনো পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে-

বিকেলের কথা মনে আছে ভাঁটফুল

বৃষ্টিতে ভিজে বেড়াতে যে এল কারা

পিছল রাস্তা কাদামাখা আঁকাবাঁকা

বেড়াবার সুখ দুর্ভোগে দিশেহারা।

কবি কামাল চৌধুরী সম্পর্কে কবি মোহাম্মদ রফিক মন্তব্য করেছেন, ‘স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে জনমানুষের বেদনামথিত উত্থান পতনের ইতিহাস জানতে হলে আরো কারো কারো সঙ্গে অবশ্য পাঠ্য কামাল চৌধুরীর কবিতা। যে কোনো কবির পক্ষে এই এক বিরাট অর্জন।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘কামাল চৌধুরী রোমান্টিক ধারণার শেষতম প্রতিনিধিদের একজন। তবে তিনি ব্যতিক্রমী প্রতিনিধি। ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, অনুভূতিকে নিজের ভেতরের আত্মস্থ করে নিয়ে ধারণ করে রক্তে মাংসে মজ্জায় তাকে দিতে পেরেছেন বস্তুর সংহতি। শব্দ উপমা ও চিত্রকল্পের যথাযথ সংযোজন মূর্ত হয়ে উঠেছে এক সংবেদনশীলতায়- যা একই সঙ্গে কবির নিজের এবং পাঠকেরও বটে। তখন তিনি পাঠক আর প্রতারকবন্ধু নয়, সে কবিরই কাব্য বিশ্বের একান্ত বাসিন্দা। এই সংযোগ বা সংহতি ধ্রুপদী কবিতার অন্যতম লক্ষণ। সরকার মাসুদ লিখেছেন, ‘কামাল চৌধুরীর কবিতা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। তিনি প্রধানত রোমান্টিক আবার আধুনিকও। মূলত প্রথানুগ এই কবি কখনও কখনও প্রত্যাগত কাব্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা পেরেছেনও। ছন্দ তাঁর কবিতার এক উল্লেখযোগ্য দিক। তবে বিশুদ্ধ গদ্যকেও তিনি অনেকবার ব্যবহার করেছেন। সেই গদ্য যখন সৃজনী মাত্রা অর্জন করেছে কেবল তখনই তা হয়ে উঠেছে ফলপ্রসূ।’

একটি আলোচনা সব সময়ই প্রচলিত কামাল চৌধুরী’কে নিয়ে- তিনি যতো বড় সচিব তার চেয়েও বড় কবি। কবিতার সঙ্গে পৃথিবীর কোনো কিছুরই নেই কোনো দ্বন্দ্ব। কবিতা সব দ্বান্দ্বিকতার ঊর্ধ্বে। তাই একজন সচিব কামাল চৌধুরীর পক্ষে আদর্শ কবি হয়ে উঠতে কোনো সমস্যা হয়নি। আর কবি এবং সচিব হিসেবে এভাবেই প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাপিয়ে সফলতার চূড়ান্ত সীমারেখায় পৌঁছে যাচ্ছেন কামাল চৌধুরী। তার এই সফলতার ধারা অব্যাহত থাকুক।

রাজু আলীম: কবি, সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :