স্কুলভর্তিতে নৈরাজ্য কেন?

সৈয়দ শিশির
| আপডেট : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:৩৯ | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৬

একথা অনস্বীকার্য যে, জাতির সামগ্রিক উন্নয়নের স্বার্থে সুশিক্ষা অপরিহার্য। আর সুশিক্ষা নিশ্চিত করতে হলে শিক্ষার পরিবেশ ও যেকোনো অনিয়ম বা বিশৃঙ্খলা রোধ করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু দেশে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করা যেন দিনদিন সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এক্ষেত্রে দায়ী কে বা কারা? খুব সহজে দায়ী করা যেতে পারে সরকারকে। কিন্তু সরকার কি আমাদের স্বভাব-চরিত্রও বদলে দেবে? তাহলে নিজের বা সমাজের জন্য আমাদের করণীয় কী? আসলে সরকারকে যেমন দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সর্বোচ্চ আন্তরিক হতে হয়, তেমনি দেশের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সর্বোচ্চ আন্তরিক হওয়া উচিত। তাহলেই সবকিছু যথাযথ হতে পারে কোনো রাষ্ট্রে।

জানা গেছে, গত ৮ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় আগামী শিক্ষাবর্ষে (২০১৭) বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ভর্তি নীতিমালা জারি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ এমপিওভুক্ত, আংশিক এমপিওভুক্ত, এমপিও-বহির্ভূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি ফরমের জন্য সর্বোচ্চ ২০০ টাকা নিতে পারবে। সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে মফস্বল এলাকায় ৫০০ টাকা, পৌর (উপজেলা) এলাকায় এক হাজার টাকা, পৌর (জেলা সদর) এলাকায় দুই হাজার টাকা গ্রহণ করা যাবে। ঢাকা ছাড়া অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় তিন হাজার টাকার বেশি হবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ভর্তির ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিও-বহিভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীর ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশনচার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা এবং ইংরেজি মাধ্যমে ১০ হাজার টাকা নিতে পারবে। উন্নয়নখাতে কোনো প্রতিষ্ঠান তিন হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবচিত্র প্রায় সম্পূর্ণই ভিন্ন। দেশজুড়ে যেন হরিলুটের আয়োজন চলছে!

সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানতে পারলাম, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং না থাকায় এ নিয়ে দেশের সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলোতে আবারও নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি না এরই মধ্যে দেড় থেকে দ্বিগুণ ফি আদায়ের লিখিত ঘোষণা দিয়ে ভর্তি ফরম বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। এছাড়াও বেশকিছু স্কুলভর্তি ফির পাশাপাশি টিউশন ফি ও সেশন চার্জ আদায়েও সরকারি নির্দেশনা না মানার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছে বলে খবরে প্রকাশ। কিন্তু অবাক হতে হয়, যখন শুনি এ নিয়ে অভিভাবকরা চরম ক্ষোভে ফুঁসলেও শিক্ষাপ্রশাসন শুধুমাত্র ‘বিজ্ঞপ্তি’ জারির মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে। বিজ্ঞপ্তি জারি করলেই কি কোনো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়? অবশ্যই না। আরও কিছু করণীয় থাকে নিশ্চয়ই। করণীয়সমূহ যথাযথভাবে সম্পাদন ছাড়া যে সম্পূর্ণরূপে সুফল আশা করা যায় না।

প্রকৃতঅর্থে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘দায়সারা’ তৎপরতার কারণেই এখাতে দিনদিন নৈরাজ্য বাড়ছে বলে মনে হয়। কারণ, গত বছর আমরা দেখেছি, বিপুলসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ভর্তি ফির কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায় করেছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তা ফেরত দেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে নানা হুমকি-ধামকি দিলেও তাতে তেমন কোনো কাজ হয়নি। এই যে কাজ না হওয়া, তার জন্য কি এসব স্কুলের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? নেওয়া হয়নি। আর ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণেই ধারাবাহিকতা রক্ষায় এবারও সরকারি-বেসরকারি অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি নীতিমালা অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাচ্ছে বলে ধরে নেওয়া যায়। এক্ষেত্রে দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক যে, ফি আদায়ের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল কর্তৃপক্ষ গতবারের মতো এবারও নতুন পে-স্কেলকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের ভাষ্য, অষ্টম পে-স্কেলের কারণে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হয়েছে। আর যেহেতু শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা নানা ফি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আয়ের একমাত্র উৎস, তাই বাড়তি খরচ মেটাতে ফি বাড়াতে হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে যৌক্তিক ভিন্ন কোনো উপায় কি বের করা যায় না?

এ ধরনের নৈরাজ্য প্রসঙ্গে বলতে হয়, ব্যবস্থা না নেওয়ার ক্ষেত্রে কি সরকার দায়ী, নাকি প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা? আমি এখানে দুটি পক্ষ দাঁড় করালাম জেনেশুনেই। কারণ বিড়াল বাজারের কোনো দোকান থেকে চুরি করে শুঁটকি খেয়ে ফেলা মানে এই নয়, বিড়াল বাজার খেয়ে ফেলেছে। তেমনি শিক্ষাপ্রশাসনের কতিপয় অসৎ অথবা অদক্ষ কর্মকর্তার দায়িত্বে অবহেলা অথবা স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অবৈধ অর্থের গোপন লেনদেন থাকলে তা সম্পূর্ণরূপে সরকারের ব্যর্থতা নয়। তবে এ ধরনের অসাধুদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দেওয়া অবশ্যই সরকারের ব্যর্থতা। এ পর্যায়ে সরকার ব্যর্থ হলেই নানা হুমকি-ধামকিতেও কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নে পিছিয়ে পড়তে হয়।

এদিকে কিন্ডারগার্টেনের জন্য ভর্তি নীতিমালা না থাকায় এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি ফি আদায়ে প্রকারান্তরে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। বরাবরের মতো এবারও তারা প্লে বা নার্সারি শ্রেণিতে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা ভর্তি ফি আদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এসব প্রতিষ্ঠানের বিষয় দেখার কথা থাকলেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় রয়েছে। এ বিষয়েও সংশ্লিষ্টদের শিগগির নজর দেওয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি নীতিমালা অমান্য করে নৈরাজ্য সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে তাদের চিহ্নিত করতে হবে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সুস্পষ্টরূপে বলা যায়, বাড়তি তদারকি করলে এখনো তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। এবারও ভর্তি নীতিমালা অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাচ্ছে বলেই যখন বিষয়টি আলোচনায় এসেছে, তখন তা আমলে নিয়ে সেই মোতাবেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। তবে সরকারের উচিত সবার আগে রাজধানী ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের এমপিওবিহীন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধার আওতায় আনা। তারপর বাড়তি ফি আদায়ের লাগাম টেনে ধরা। সবদিক থেকে এমন ভারসাম্য থাকলেই প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্টদের অসদুপায় থেকে রোধ করা সম্ভব। মনে রাখা চাই, শিক্ষা ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের নৈরাজ্যই শিক্ষা অর্জনের পরিবেশকে বিঘিœত করে। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের ভাবা উচিত, অভিভাবক তথা সাধারণ মানুষকে এভাবে জিম্মি করে নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় কোনোভাবেই শিক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক নয়। তাছাড়া অতিরিক্ত অর্থ দিয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত অনেককে ভবিষ্যতের জন্য গচ্ছিত সঞ্চয় ভাঙতে হয়। এমনকি কেউ কেউ জমিজমা, সম্পত্তি ও সোনার গহনা বিক্রি করেন। এছাড়া বিপুল অঙ্কের ভর্তি ফি জোগাড় করতে না পেরে অনেকে তাদের মেধাবী সন্তানদের যেনতেন স্কুলে ভর্তি করতে বাধ্য হন। যারা মানুষ গড়ার কারিগর, তারা বিষয়টি ভাববেন এমন আশা করতেই পারি। কেননা, নিয়ম নীতিকে উপেক্ষা করে যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মতো প্রবণতা পরিলক্ষিত হয় তখন সেই পরিস্থিতি একটি ভয়ানক অধ্যায়েরই জন্ম দেবে, যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।

সৈয়দ শিশির : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

[email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :