শিক্ষকের মর্যাদা

কাওসার শাকিল
 | প্রকাশিত : ২৯ নভেম্বর ২০১৬, ১৭:৪৭

১.

আমার স্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সে মানুষ ভালো। সোজা সরল এবং অল্পতেই খুশি হওয়া টাইপের। রাজ্যের যানজট ডিঙিয়ে ঢাকা শহরের বাইরের ক্যাম্পাসে গিয়ে ক্লাস নিতে হয় তাকে। কিন্তু বাড়ি ফেরে এক মুখ হাসি নিয়ে। প্রায়ই সে তার ছাত্র-ছাত্রীদের গল্প শোনায় আমাকে। তার শিক্ষার্থীরা আজকে এটা করেছে, ওটা পেরেছে, এইসব। এবং এটা সে করে প্রচন্ড আনন্দ থেকে। আমি সবটা মন দিয়ে শুনিও না। কিন্তু এটুকু বুঝি শিক্ষকতার একধরনের সন্তুষ্টি আছে, সেটা প্রাপ্যের সিকি ভাগ বেতনে চারগুণ খাটুনি খাটা আমার স্ত্রীকে দেখে বুঝতে পারি।

২.

ফুলবাড়িয়া ডিগ্রী কলেজের যে শিক্ষকরা সেদিন জাতীয়করণের দাবী নিয়ে রাস্তায় এসেছিলেন তাদের আমি চিনি না। তারাও বাড়ি ফিরে তাদের পরিবারের সাথে একই রকম আনন্দ নিয়ে ছাত্রদের কথা বলতেন কিনা সেটাও আমার জানা নেই। আমি শুধু জানি উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ আর কখনই বাড়িতে তার পরিবারের কাছে ফিরবেন না। আমি জানি তার পরিবার কখনই আর আগের মতন হবে না, কেননা এই পরিবারের কর্তা ব্যক্তিটির পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে খুব অপমানিত হয়ে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে বাদশাহ আলমগীরের শিক্ষণীয় গল্পটি কবিতা হিসেবে মুখস্থ করা জাতি আমরা। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারণে পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে একজন শিক্ষকের মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা নাড়া দিতে পারেনি আমাদের। কেন সেটা আমি জানি না। আমি শুধু এটুকু জানি, শিক্ষক আবুল কালামের পরিবারের সামনে খুব কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। কেননা, তারা তাদের পরিবারের উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়েছেন।

৩.

নারায়ণগঞ্জের সেলিম ওসমান যখন প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তিকে কান ধরালেন-তখন আমি আমার একটা কানে ধরা ছবি পোষ্ট করেছিলাম। সেটা অবশ্য আরো অনেকেই করেছিলো। পরে আমাদের করা এই তুচ্ছ প্রতিবাদটা নিয়ে জাতীয় দৈনিকে খবর হয়েছিল। তখন মনে হয়েছিলো যাক, অন্তত একজন শিক্ষেকের সম্মানে আমাদের এই ক্ষুদ্র প্রতিবাদটুকুর হয়তো কোনো মানে থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু শিক্ষক আবুল কালামের আজাদের মৃত্যুতে কি বলে প্রতিবাদ জানাবো ঠিক বুঝতে পারছি না। কি করবো? আবার কান ধরবো? মানুষটাতো মরে গেছে। তার মৃত্যুর ন্যায় বিচার চেয়ে মানববন্ধন করবো? তার পরিবার কি আদৌ বিচার পাবে? তারচেয়েও বড় কথা-আমরাই বলি শিক্ষা জাতীর মেরুদন্ড। আমরাই বলি শিক্ষকরা হলেন মানুষ গড়ার কারিগর। আবার আমরাই সেই শিক্ষকদের অপমান করি, পিটিয়ে মেরে ফেলি। কেন?

৪.

দুর্নীতির মামলায় তিন বছরের কারাদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার পর হাই কোর্ট থেকে ছয় মাসের জামিন পেয়েছেন কক্সবাজারে ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস‌্য আব্দুর রহমান বদি। বদি যখন তার এলাকায় ফিরছিলেন তার সম্মানে ১৩০ টা তোরণ তৈরি করা হয়। শত শত ব্যানার ফেস্টুন ঝোলানো হয়েছিলো তার আগমনকে স্বাগত জানিয়ে। যে দেশের মানুষ অভিযুক্ত মাদক সম্রাট এবং দন্ডপ্রাপ্ত আসামীকে এরকম সম্মান দেয় সেদেশের সরকার, সাংসদ, পুলিশ, প্রশাসন- তারা সবাই শিক্ষকের অসম্মান করবে, এটাই হয়তো স্বাভাবিক।

৫. আবুল কালাম আজাদ স্যারের ছাত্ররা তার জন্য কাঁদছে। স্যারের জানাজা তারা পড়তে পারেনি, ১৪৪ ধারা জারি ছিলো। তারা তাদের প্রিয় শিক্ষকের লাশ কাধে নিয়ে কবরে দিয়ে আসতে পারেনি। তবে তারা তাদের প্রিয় স্যারের জন্য আকুল হয়ে কেঁদেছেন। একজন মানুষের জন্য, একজন শিক্ষকের জন্য তাদের এই কান্না যেন শত শত গুণ ভালোবাসা হয়ে তাদের জীবনে ফেরত আসে, এটুকু চাই।

লেখক: গণসংযোগ বিশেষজ্ঞ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :