যেই তেলে চাকা ঘোরে সেই তেলে মন ঘোরে না

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১১:২৩

‘তৈল’। শুনলে আমার হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কথা মাথায় আসে। চমৎকার গদ্য। গল্পের ছলে গদ্য বলার এমন দক্ষতা কম লেখকেরই আছে। ‘তৈল’ প্রবন্ধ থেকে একটু উদ্বৃত করছি। ‘...স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ। আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি । স্নেহ কি? যাহা স্নিগ্ধ বা ঠান্ডা করে, তাহার নাম স্নেহ। তৈলের ন্যায় ঠান্ডা করিতে আর কিসে পারে?’

পারে না। তেলের অসাধ্য আসছে কিছুই নেই। একশ্রেণির মানুষ আছে সমাজে যাদের পরিচয় তেলবাজ। তেলবাজিতে যাদের দক্ষতা তুঙ্গে তিনি তত সফল। তেল দেওয়াও যে একটা শিল্প—এটা কে না জানে। সবাই বোঝে। যাকে তেল দেয়া হয় তিনিও বোঝেন। অগত্যা বলে বসেন, ‘কী ভাই তেল দিচ্ছেন?’ হাত কচলে, ‘না না কী বলছেন এসব। বাজে কথা। আমি আপনাকে তেল দিতে যাব কেন। আসলে হয়েছে কি...।’ হাতের দলাইমলাইটাও একটা তেলমর্দন কৌশল বটে। মর্দন শব্দটা অবশ্য একটু নোংরা শোনা যায়। মাখামাখি তার চেয়ে অশ্রাব্য। আবার তেল দিচ্ছেন এমনটা বুঝে ফেললেও মাঝেমধ্যে বিপদে পড়তে হয় তেলবাজকে।

এমনই একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। আমার একজন সিনিয়র বন্ধু বেশ আগে তার কলকাতা ভ্রমণের স্মৃতিচারণ করছিলেন। সেবার তারা তিনবন্ধু মিলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। নিউমার্কেট এলাকায় কোনো একটা হোটেলে উঠেছেন। ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লেন রাতের কলকাতা দেখতে। গেলেন শিয়ালদা স্টেশনে। রাত তখন ১০টার বেশি বাজে। রেলস্টেশনগুলো পাবলিক প্রোপার্টি। ছিন্নমূল মানুষগুলো আশ্রয়স্থল। বাংলাদেশ-ভারতসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের রেলস্টেশনের চিত্র এমনটাই। রেলস্টেশনে রাতযাপন করতে কেমন লাগে? বন্ধুরা ঠিক করল ওই রাত কাটিয়ে দেবে শিয়ালদাতেই। একটা চটের বস্তা জোগাড় করে তিনজন শুয়ে পড়লেন। গায়ে দিলেন আরেকটা চট। ঘুম কোথায়? তন্দ্রা ভাবও নেই। মানুষের পায়ের শব্দ পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ পারা দিয়ে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে। দু-একটা মশাও কানের কাছে এসে ভ্যান ভ্যান করছে। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। যে যার মনে ভাবছে, ‘শালা দারুণ ফ্যাঁসাদে পড়লাম দেখি।’ কিছুক্ষণ পর কানের কাছে বাঁশির শব্দ। রেলস্টেশনে এতশব্দের মধ্যে বাঁশির শব্দ এ আর এমন কি! রেলস্টেশনে তো আর অভিজাত হোটেলের বিলালী বেডরুম নয় যে রিলাক্সেশন মিউজিক বাজবে। ছালার চটের ভেতর থেকে কেউ মুখ বের করল না। বাঁশি থামছে না। সাথে যুক্ত হল গলা খ্যাকানি। তিনজনের একজন চট থেকে মাথা বের করে দেখে একটা জোড়া বুট। তার মধ্য থেকে ক্যাকটাসের মতো দুটো পা গজিয়ে উঠেছে। পা দুটোর গায়ে কালো পশম কুকড়ে আছে। পা বেয়ে উপরে চাইলে কী না কি দেখা যায় ভেবে হাটু পর্যন্ত দেখে উঠে বসলেন ওই সিনিয়র বন্ধু। ভাল করে তাকিয়ে দেখেন, একজন হাফপ্যান্ট পরা দারোগা চোখ মটকাচ্ছে। ‘বলি শোনা যাচ্ছে না। এতক্ষণ ধরে ডাকছি?’ বেতের লাঠি হাতে দারোগার খেদোক্তি।

মূল ঘটনার শুরু এবার। তিনজনকে রেলস্টেশনের পাশে থানায় নেয়া হল। তারা পরিচয় দিলেন। জানালেন বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। শুনে থানার বড়কর্তা রেগে আগুন। বললেন, ‘দেখ কা-, বাংলাদেশ থেকে শিয়ালদা ইস্টিশানে ঘুমোতে এয়েছে। তা কলকাতা শহরে কি জায়গার অভাব পড়েছে, অ্যাঁ?’ ভয়ে তাদের অবস্থা গুটিশুটি। কর্তা পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। সেরেছে। পার্সপোর্ট সঙ্গে নেই। তিনজনের একজন প্রবাল বললেন, ‘স্যার পাসপোর্ট তো হোটেলে রেখে এসেছি।’ দারোগা এবার বিকট শব্দে হেসে উঠলেন। হিক! হিক! শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে ঘন ঘন হেঁচকি তুলছেন। বিচিত্র হাসি। হাসি থামিয়ে একগ্লাস পানি খেলেন। বললেন, ‘হোটেল ভাড়া করে ইস্টিশানে চোর-ছেচ্চরদের সঙ্গে ঘুমোনোর মতলব কী, শুনি?’

‘কোনো মতলব নেই। স্টেশনে রাত কাটাতে কেমন লাগে তা দেখতে গিয়ে এই বিপদে...’

‘আর কোনো কাজ নেই। ইস্টিশানে থাকতে কেমন লাগে দেখতে এয়েছে। মাথার খারাপের দল।’ দরগার গলা নরম হয়ে এসেছে। আগের মতো সেই হম্বিতম্বি নেই কথায়। এবার যদি ছাড়া পাওয়া যায়।

‘আপনাদের অনেক প্রশংসা শুনেছি স্যার। উপন্যাস-টুপন্যাসেও পড়েছি। কলকাতার পুলিশ বেশ ভদ্র। বাংলাদেশের পুলিশের মত খবিশ কিসিমের না।’ প্রবাল ভেবেছিলেন এতে বুঝি কাজটা সরস হবে। কাজ হল। তবে উল্টোটা। দারোগা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন, ‘শালা, বেশ চালাক আদমি। তেল দিচ্ছে। পুলিশকে তেল দেয়। অনেক প্রশংসা নাকি শুনেছে। হা-হা-হা।’ আশপাশের ছোটো দারগারাও দাঁত বের করে হাসছে। কিন্তু শব্দ হচ্ছে না। শব্দ করবে শুধু বড় দারোগা-ভাবখানা এমন।

‘ভেবেছিলাম ছেড়ে দেবে। এখন তো দেখি পুলিশ চেনাতে হবে।’ বলেই থানার বড়কর্তা গা থেকে শার্টটা খুলতে লাগলেন। প্রবালদের সবার মুখবন্ধ। একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। ভাল করতে গিয়ে এখন বোধ হয় বড় বিপদে পড়া হল। পুলিশ কীভাবে চেনায় কে যানে। খালি গায়ে একটা লোমশ প্রাণি বসে আছে তিনবন্ধুর সামনে। সুঁচের মতো পশমগুলো খাঁড়াখাঁড়া হয়ে আছে।

‘নে শরীররা টিপে দে।’ বলেই টেবিলের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন বড়কর্তা। ‘কই শুরু কর। দাঁড়িয়ে আছিস কেন। আজ খুব ধকল গ্যাছে মাইরি।’

প্রবালের বাকি দুজন বন্ধু দুপাশ থেকে ওকে ঠেলে সামনে দিল। নে ব্যাটা প্রশংসা করেছিস এবার গা টেপ। কে বলেছিল এত বেশি কথা বলতে। ব্যাটা তেল দিবি তো দে, তাই বলে পুলিশকে!

যাই হোক বেশ কায়দা করে একে একে তিনজনকেই পালাক্রমে বড় দারোগার গা টিপে দিতে হল। একবার পরনের প্যান্টের বেল্ট খুলতে গিয়েছিলেন দারোগা বাবু। এ দেখে প্রবালদের তো যায় যায় অবস্থা। ভাগিস্য পুরোটা খোলেনি। খুললে কী কেলেঙ্কারিই না হয়ে যেত! বেশ যুতসই গা মর্দন হয়েছে। কর্তা বাবুর চোখে তন্দ্রা। চোখ বুজে আছেন। হাত ইশারা করে হাবিলদারকে কাছে ডেকে বললেন, ‘নামধাম লিখে রেখে বিদায় কর।’

এই লেখাটা আসলে তেলবাজদের নিয়ে নয়। বিষয়টা ‘তেল’। এই তেলের অস্বিত্ব আছে। ছোঁয়া যায়। মাখা যায়। কাজে লাগানো যায়। কাজের তেল নিয়েই কথা।

আবার শাস্ত্রীর প্রবন্ধ। শেষদিকে আছে- ‘এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।’ হ্যাঁ। চাকা ঘোরানোর তেল নিয়ে কথা হচ্ছে। যে তেলে ঘোরে তিন চাকা। ‘তেল কম হইলে চাকা ঘোরে না। বড় কষ্ট মামা।’ প্যাডেলে অশুরের শক্তি চাপিয়ে ফারুক পেছন ফিরে বলেন। ‘যন্ত্র বড় কঠিন। বুঝলেন। একটু যতœ না নিলে গোস্সা করে।’

ঢাকায় ফাঁকা রাস্তায় রিকশায় চড়ার আনন্দের বর্ণনা দেয়া বোকামি। জেনে শুনে তো আমি এ কাজ করতে পারি না। আমি যাত্রী হিসেবে খুব বেশি যন্ত্রণার নই, আমার বিশ্বাস। ওজন সহনীয়। ভাড়া নিয়ে কষাকষিতে পেরে উঠি না। আমার সঙ্গে যিনি প্রায়ই রিকশায় চড়েন, তিনি প্রায়ই বলেন-‘তুমি রিকশা ঠিক করতে পারো না।’ বলি, ‘আমি রিকশা ঠিক করতে যাবো কেন?’ সঙ্গিনী হেসে খুন। ‘আরে আমি বলেছি ভাড়া ঠিক করতে পারো না। যা বলে তাই।’ আসলে কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। এই একটা জায়গায় এসে আমার কেন জানি অতিমানবিক বোধটা জেগে ওঠে। এত কষ্টের, শ্রমের কাজ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে বলে আমার জানা নেই। মানুষ হয়ে মানুষকে টেনে নিয়ে যাওয়া—এরা আর কত টাকাই বেশি নেবে?

দিনক্ষণ মনে পড়ছে না। চেষ্টা করলে হয়তো মনে পড়ত। চেষ্টা করিনি। ফাঁকা রাস্তা রিকশা হাকাচ্ছেন ফারুক। শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ না। কথাও বলেন গুছিয়ে। রিকশা চালকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আমার স্বভাবে আছে। মুখ বুজে বসে থাকতে বিরক্ত লাগে। বরং চালকের সঙ্গে কথা বললে সময়টা ভাল কাটে। ‘আপনার বাড়ি কি ময়মনসিংহ?’ প্রশ্ন শুনে ফারুক পেছন ফিরে তাকালেন। কিছু বললেন না। বুঝলাম না সে আমার প্রশ্ন বুঝেছে কিনা। ‘আপনার বাড়ি কি মাইমিনসিং?’ এবার হেসে উত্তর দিলেন-‘হ, কেন ভাইজান?’ অবাক হলাম। একটু আগে যে মানুষটা ‘মামা’ ডাকছিল সে নেমে এল ভাইতে!

: না এমনিতেই কথা শুনে মনে হল।

: আপনার বাড়ি কি ওইহানো?

: না। আমার বেশ কয়েকজন বন্ধুর বাড়ি ওখানে।

এক কথা, দু-কথায় অনেক গল্প। এক পর্যায়ে দেখলাম গাড়ি টানতে তার দফারফা। পান্থপথের কার্পেটিং রাস্তা। গাড়ির চাপও কম। একটু পর পর একটা দুটো আসছে। পাশ দিয়ে শো করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে, গাড়ি টানতে বেশ কষ্ট পাচ্ছেন। বললাম, ‘কোনো সমস্যা ফারুক ভাই?’ মৃদু হেসে জবাব দিলেন, ‘ভাইজান একটু তেল দিতাম গাড়িতে। দুই মিনিট লাগবো। দিমু?’ আপত্তি করলাম না। রাস্তার পাশের ভ্রাম্যমাণ একটা গেরেজ থেকে পাঁচ টাকায় এক টিউব তেল কিনে সামনে-পেছনে সবকটি চাকায় দিয়ে আবার ছুটলেন গন্তব্যে। তার মিনিট দশেক পরের ঘটনা। মাঝপথে গিয়ে কেমন যেন নেতিয়ে পড়লেন। কোনোমতে রিকশাটাকে রাস্তার কিনারায় থামিয়ে ফুটপাতে বসে পড়লেন। হতবাক আমি লাফ দিয়ে নেমে এলাম। বললাম, ‘কী হয়েছে অসুস্থ লাগছে আপনার?’

ফারুক অস্বাভাবিকভাবে ঘামছেন। মনে হচ্ছে গোসল করে উঠেছেন। তার নামমুখ লাল হয়ে গেছে। মাথার চুলের কিনারা বেয়ে ঘাম ঝরছে। বুকটা ধুকপুক করছে। ফুটপাতে কাঁত হয়ে শুয়ে পড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘হাইপ্রেসার। শরীর ভাল না।’

আমি দৌড়ে গিয়ে কাছের দোকান থেকে পানি, বিস্কিট কিনে আনলাম। খাইয়ে তাকে সোজা করে বসলাম। মিনিটি বিশেক পর ফারুক স্বাভাবিক হলেন। সে আমার দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিলেন। জানতে চাইলাম, ‘কী ফারুক কাঁদছেন কেন?’ সে চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘তিন দিন আগে ছোটো মেয়েটা মারা গেছে। ব্রেইন টিউমার হয়েছিল।’ জানাল, ঢাকার শেরে বাংলা নগরে নিউরোলজি হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি ছিল ছয় বছরের সরুফা। বাঁচানো যায়নি। মেয়েকে হাসপাতালে রাখতে গিয়ে হাত-পা খালি হয়ে গেছে। তাই মেয়ের শোক ভোলার আগেই রিকশা নিয়ে নামতে হয়েছে রাস্তায়। ঘরে আরও দুটো মুখ তার দিকে তাকিয়ে। স্ত্রী আর বড় ছেলে। তাদের তো বাঁচিয়ে রাখতে হবে। বাঁচতে হবে নিজেকেও। সৃষ্টিকর্তা কী অদ্ভূত তোমার খেলা। এই শহরে কতরকম চরিত্র তুমি ছড়িয়ে দিয়েছ। কী বিচিত্র তাদের মানবজীবন। মনে মনে বললাম, তেল দিয়ে চাকার গতি বেড়েছে। কিন্তু শরীরের গতি কি ফিরেছে? শরীর নিয়ন্ত্রণ করে মন। মন ঠিক তো জগত ঠিক। যেই তেলে চাকা ঘোরে সেই তেলে মন ঘোরে না।

নগরিয়া, ৩০ নভেম্বর, ১৬

ছবি : শেখ সাইফ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :