সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে

অমর মিত্র
| আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৫:০২ | প্রকাশিত : ৩০ নভেম্বর ২০১৬, ১৪:২৩

সতত কার কথা ভাবি? কপোতাক্ষর কথা। তার তীরে কবি শ্রী মধুসূদন, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মধুসূদনের মা জাহ্নবী দেবীর জন্ম। আমার মাতৃকুলও কপোতাক্ষর কূল। পিতৃকুল বেতনা নদীর কূল। বেতনা পড়েছে কপোতাক্ষয়। আমি ২০০০ সালে খুলনার ডেপুটি কমিশনার মশায়ের বদান্যে আমাদের ফেলে আসা শহর সাতক্ষীরে হয়ে ধূলিহর গ্রামে গিয়েছিলাম। সে মাত্র আধ ঘণ্টার জন্য। কিছুই দেখা হয়নি। শুধুই অশ্রুপাত হয়েছিল। তা নিয়ে অগ্রজ প্রতিম বন্ধু এখনো ঠাট্টা করেন। তারপর আর যাওয়ার কথা ভাবিইনি।

এক সন্ধ্যায় এক বন্ধু যখন সাহিত্য সভায় বললেন, তার একটা গ্রাম আছে, তার একটা নদী আছে তাই নিয়ে তিনি লেখেন। শুনতে শুনতে আমি নিজের নিঃস্বতা অনুভব করেছিলাম। আমার তো নেই। আমার গ্রাম আমার নদী ওপারে ফেলে এসেছি আমি। গুগল সার্চ করে আমাদের গ্রাম দেখলাম একদিন। ছবিও। ফেসবুকে সাতক্ষীরের কজন বন্ধু হলো কোন অজানতে। এরপর একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে সাতক্ষীরের বন্ধু তুহিন ম্যানগ্রোভ বলল, দাদা আসুন না কেন নিজেদের ফেলে যাওয়া গ্রামে। তুহিন বারবার ডাকতে লাগল, দাদা আসেন, সাতক্ষীরে আসেন, সাতক্ষীরে আপনার জন্য বসে আছে। এই তুহিন একদিন বিকেলে আমাকে ফেসবুকে মেসেজ দিল, দাদা আপনার বাবার নাম, ঠাকুদ্দার নাম? আমি জানাতে সে বলল, ধুরোলে (ধূলিহরে) আপনাদের ভিটেয় দাঁড়িয়ে আছি। সারা গা শিহরিত হয়ে উঠল। অন্তরজাল এমনভাবেই তো এই ভুবনকে জুড়েছে পরস্পরে। আমাদের পিতৃপুরুষের ভিটেয় দাঁড়িয়ে তুহিন ডাক দিচ্ছে। এ কি সত্য হতে পারে? ষাট বছর আগে যা হারিয়ে গেছে তাকে পাই কীভাবে?

দুদিন বাদে এক সন্ধ্যায় অস্ট্রেলিয়াবাসী সাতক্ষীরের কন্যা ফিরদৌস জান্নাত নজৌলা বারবার বলতে লাগল, দাদা আপনার জন্মভূমি দেখে আসুন। চেনা মানুষ খুঁজে পাবেন ঠিক। তাই সাতক্ষীরে যাওয়া। আর উস্কে দিয়েছিল তরুণ সাংবাদিক বন্ধু অনমিত্র এবং বাংলাদেশের খ্যাতিমান সাংবাদিক আবেদ খান মশায়। সম্ভ্রান্ত খান পরিবারের বাড়ি সাতক্ষীরে। তাঁরা তিনপুরুষ সাংবাদিক। আমি যবন হরিদাসের জন্মভিটে কেড়াগাছির কথা অনমিত্রর কাছে শুনেছিলাম। কেড়াগাছি, ধূলিহর যেতে চাই শুনে ঢাকা থেকেই আবেদ খান মশায় যাদের যাদের বলার, বলে দিয়েছিলেন। আমাকে বারবার তাড়িত করছিলেন। সাতক্ষীরের কথা নিয়ে আমি যেন লিখি। আবেদ খান তো বলছিলেনই, বলছিলেন সাতক্ষীরের সাংসদ রবিভাই, উপজেলা কলারোয়া অঞ্চলের সাংসদ লুতফুল্লাভাই। ফোনে ডাকছিল কবি মন্ময় মনির। ফোনে ডাকছিল তুহিন, শুভ্র আমেদ, আসুন আসুন। এসো এসো। ভোররাতে, ঘুমের ঘোরে তাদের ডাক শুনছিলাম। মধ্যরাতে আধো চেনা কারোর ডাক শুনছিলাম আচমকা ঘুম ভাঙা অন্ধকারে। এসো এসো। আয় আয়। তাঁরা আর কেউ নন, আমার পিতৃকুল মাতৃকুলের হারানো মানুষ, ধূলিহরের চন্ডীচরণ মিত্র, লক্ষ্মীনারায়ণ মিত্র, অন্নদাচরণ, হেমনলিনী। বাঁকা ভবানীপুরের প্রমাতামহ কৈলাশ বসু, মাতামহ ধীরেন্দ্রনাথ বসু... হারানো নদ কপোতাক্ষ, নদী বেতনা। নদীঘাট সুপুরিঘাটা, বড়দল। যুগীপোতার বিল জমি।

রাজশাহী হয়ে ঢাকা গিয়েছিলাম আগের মাসে। সে ছিল অন্য আমন্ত্রণ। ঢাকা থেকে ফিরে আটদিনের মাথায় সাতক্ষীরে ভায়া বসিরহাট। এত কাছে! বাউন্ডারি কমিশনের, জধফপষরভভ সায়েবের মানচিত্রে দাগিয়ে গোটা খুলনা জেলাকেই ভারতে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। তিনদিন বাদে ১৮ আগস্ট খুলনা ওপারে চলে যায়। সাতক্ষীরে তখন খুলনা জেলার একটি মহকুমা। এখন জেলা। থাক ওসব কথা।

আমি যেন আমার আর জন্মের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। যাদের দেখিনি সেই প্রপিতামহ চন্ডীচরণ মিত্র, মাতামহ ধীরেন্দ্রনাথ বোস ডাক দিচ্ছিলেন। সব নিয়ে বসে আছি। আয়, একবার আয়। তোরে তো দেখিনি আয়। আয় রানি, ঠাকুরদাসের খবর নিয়ে আয়। শিবু, কেষ্টর খবর নিয়ে আয়। রানি আমার মা রাধারানি, শিবু কেষ্ট আমার দুই মামা। মধ্যরাতের সেই ডাকই আমাকে নিয়ে গেল। না গিয়ে পারিনি তাই গেছি। বসিরহাট থেকে এপারে ঘোজাডাঙা, ওপারে ভোমরা সীমান্ত, সঙ্গে তরুণ লেখক অরিন্দম বসু। স্থল-সীমান্ত দিয়ে সীমান্ত না পার হলে সীমান্তের মহিমা ধরা যায় না। এপারের কাস্টমস, সীমান্ত প্রহরীর ছাড়পত্র নিয়ে ট্রলি ব্যাগ টেনে টেনে বাংলাদেশে ঢুকে গেলাম। ওপারে তুহিন, শুভ্র, মন্ময়রা দাঁড়িয়ে। চন্ডীচরণ, অন্নদা মিত্তির হেমনলিনী আর ধীরেন বসুরা দাঁড়িয়ে। যারা এপারে প্রয়াত হয়েছেন, বাবারা তিনভাই, বড় মামা, মামি, আমার মা রাধারানি সবাই এপারে প্রয়াণের পর ওপারে ফিরে গেছেন, আমি দেখতে পাচ্ছি তাদের। হ্যাঁ, স্পষ্ট। অনুভব করতে পারছিলাম যেন। ওপারে গিয়েও এপারের মোবাইল সিম চালু থাকে প্রায় ২ কিলোমিটার অবধি। তারপর তা মুছে দেয় র‌্যাডক্লিফের ভূত। ফোনে গ্রামীন ফোনের সিম ভরে নিলেই সিলেট, চট্টগ্রাম, ঢাকা, হাতিয়া, ময়নাদ্বীপ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাসের কূল, গোয়ালন্দ, ঈশ্বরদি, আরিচাঘাট, পোড়াবাড়ি, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ জুড়ে যায়। ঢাকার ভূতের গলি থেকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া গ্রামের শেফালী খাতুনের বাড়ি চলে যাওয়া যায় পড়ন্ত বেলায় নারিকেল গাছের ছায়ার অভিমুখ দেখে দেখে (শহীদুল জহিরের গল্প ‘কোথায় পাব তারে’)।

এবারের সাতক্ষীরে ভ্রমণ সব অলীকতার অবসান হয়ত। কিংবা নতুন অলীকতার জন্ম। সাতক্ষীরে, ধুরোল, বাঁকা, আমাদী, রাঢুলী কাঠপাড়া, পাটকেলঘাটা সবই আমার কাছে ছিল হারিয়ে যাওয়া ভূখ-। সীমান্তের ওপারে যা আছে তার একবিন্দুও আমার নয়। গ্রাম, নদী, নদীঘাট, কিছুই আমাদের নয়। সেখানে আমার কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। বন্ধু সুজন আছে বটে, রক্তের কেউ নেই। নেই নেই কেউ নেই ওদেশে। কদিন আগে ঢাকাতেও তাই বলেছি গাজীপুর উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশভাগ নিয়ে বলতে গিয়ে। ঢাকার খামখেয়ালির সভায় তাই বলেছি। স্বকৃত নোমান কিংবা অধ্যাপক শোয়েইব জিবরানকেও তাই বলেছি। কনকর্ড মার্কেটে তরুণ লেখকদের সঙ্গে আড্ডা দিতে গিয়ে তাই বলেছি। কিন্তু সীমান্ত পার হয়ে সাতক্ষীরের দিকে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল কেউ যেন আছে কোথাও! ঘ্রাণ আসছে। গায়ের গন্ধে স্বজন চেনা যায়। ছোটবেলায় মায়ের গায়ের গন্ধ চিনতাম, ঠাকুমার চিনতাম। তাঁদের মাথার চুলে ঘন নারকেল তেলের গন্ধ এখনো ভুলিনি। তা যেন বাতাসে ভেসে আছে ভোমরা সাতক্ষীরের পথে। কেউ যেন আছে। যার ডাকে মধ্যরাতে ঘুম ভেঙেছিল, সে আছে। কিন্তু এ তো আমার কল্পনা। ইচ্ছা পূরণের কথা মাত্র। তা হয় নাকি? হয় না। সাতক্ষীরে কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল তৃপ্তিমোহন মল্লিকের সঙ্গে। তিনি পঁচাত্তর। থাকেন সাতক্ষীরের নিকটবর্তী গ্রাম নাটানা, আশাশুনি। আশাশুনির নাম কত শোনা। দেখে মনে হলো চেনা মানুষ। গান লেখেন। গানে সুর করেন। কত পরিবার চলে গেছে ইন্ডিয়ায়। তিনি যাননি। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তারাপদ মিত্র কে হন? চিনতেন আমার ছোটকাকাকে।

হ্যাঁ, সাতক্ষীরের কবিতা পরিষদের অনুষ্ঠানের মধ্য থেকেই আমাকে তুলে নিয়েছেন প্রবীণ শিক্ষক আনিসুর রহিম। ফিরদৌস জান্নাত নজৌলার মামা। ভাগ্নী খবর দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া থেকে। তারা আসলে বর্ধমানের লোক। ১৯৪৫ সালে তাঁর বাবা চাকরিতে বদলি হয়ে সাতক্ষীরে আসেন। আর ফিরে যাননি। তিনি আমাকে প্রাণনাথ ইনস্টিটিউশনে নিয়ে গেলেন। বাবার ইস্কুল। ১৫০ বছর হয়ে গেছে। জমিদার প্রাণনাথ চৌধুরী পরিবারের প্রতিষ্ঠা করা বিদ্যালয়। দুপুরে বৃষ্টির ভিতরেই আমাকে তিনি দেখালেন প্রাণ সায়র। লম্বা সায়র। এই সায়রের ধারে হেমচন্দ্র ঘোষের বাড়ি ছিল। তিনি আমার ঠাকুমার ভাই। খুঁজলাম। পাত্তা করতে পারিনি। আশি বছরের মানুষ পেলে জিজ্ঞেস করতাম। বাবার মামা, আমার সেই দাদুকে আমি দেখেছি ১৯৫৫-৫৬ সালে। সে আমলের কাউকে যদি পাওয়া যেত! কোনো চিহ্ন পড়ে নেই। কাল স্রোতে ভেসে গেছে সব। অথচ কত লোকের সঙ্গে দেখা হলো যাদের আত্মীয়স্বজন এপারে, ধান্যকুড়িয়া, হাবড়া, সোলাদানা, টাকি। যাতায়াত আছে। কবিতা লেখে দিলরুবা। তার বাপের বাড়ি ধান্যকুড়িয়া। বসিরহাট কলেজ থেকে বি,এ। এপারে আসেন বিয়ের পর, এই বছর দশ আগে। তারা কেউ বলতে পারলেন না হেমচন্দ্রের বাড়িটি কোথায় ছিল। কতকালের কথা এসব, আর কি খুঁজে পাওয়া যায়?

আমাদের ভিটেমাটি আর আত্মজনের খোঁজে যে যাত্রা, তার সঙ্গী তৃপ্তিমোহন। তুহিন ও শুভ্র আছে। অরিন্দম আছে। আছে কুমিল্লার পুত্র তরুণ কবি পিয়াস মজিদ আর তার বন্ধু বাবু। এই যাত্রা ছিল সেই মধ্যরাতের ডাক। আগের দুদিন ছিল অকাল বর্ষণে বিমর্ষ। আমরা ভ্রমরা কিংবা ভোমরা সীমান্তে মেঘ মাথায় নিয়ে ঢুকেছিলাম। তারপর থেকে দুদিন বর্ষণে কেটেছে। ধূলিহর বা ধুরোল যাত্রা শুরু উজ্জ্বল দিনে। তৃপ্তিমোহনকে যখন বলেছি, ব্রহ্মরাজপুরে আমার মাসির বাড়ির কথা। না তারা কেউ থাকে না। প্রকাশ চলে গেছে ১৯৯১ সালে। বিএনপির শাসনকালে। তাহলে পশুপতি ঘোষ আপনার? মেসোমশায়। তৃপ্তিমোহন খুব চেনেন। কাকে না চেনেন। মাসতুতো ভাই প্রকাশ ঘোষকে ভালোই চিনতেন। সে কেন চলে গেল দেশ ছেড়ে? জমিজমা পড়ে আছে এখানে সব। তৃপ্তিমোহন জিজ্ঞেস করলেন, প্রকাশ খুব কষ্ট করেছে ওপারে গিয়ে, শুনেছি তাই। হ্যাঁ তাই। সে ২০০১ না ০২ সালে দেশত্যাগ করে সুজন-বন্ধুদের না জানিয়ে। উপায় ছিল না। মিথ্যে অভিযোগে পুলিশ কেসে ফাঁসিয়ে দিচ্ছিল কতিপয় বিরোধী ব্যক্তি। তখন খালেদা জিয়ার শাসনকাল। সেই সময়ের গভীরে ভয়ানক সাম্প্রদায়িকতা ছিল। ওদেশ ছেড়েছিল তখন অনেক হিন্দু। কথাটা জানা। কলারোয়ার সাংসদ লুৎফুল্লাও সেই কথা পরেরদিন বলেছেন আমাকে। প্রকাশদা নাকি ওপারে গিয়ে স’মিলে কাজ করতেন। আহা! আমি মধ্যমগ্রামে গিয়ে দেখা করতে পারিনি কষ্টে।

তারাপদ মিত্রকে চিনতেন? আমি জিজ্ঞেস করেছি তৃপ্তিমোহনকে।

খুব চিনতাম। তৃপ্তিমোহন জিজ্ঞেস করলেন, তারা ডাক্তার কে হতেন আপনার?

তিনি আমার কাকা। চিকিৎসক ছিলেন। বিমর্ষ হলেন তৃপ্তিমোহন তিনি বেঁচে নেই শুনে। বেঁচে থাকলে নব্বই পেরিয়ে যেতেন ঠিক। সাতক্ষীরে পোস্ট অফিসের মোড় থেকে রাস্তা বাঁ দিকে ঘুরে গেছে ধূলিহরের পথে। পাকা রাস্তা। ২০০০ সাল আর ২০১৬ সাল অনেক তফাৎ। পথের দুপাশে দোকানপাট। ইস্কুল। কলেজ। ট্রেনিং সেন্টার। সাতক্ষীরে চলল অনেকটা। তারপর সবুজ বনানী দুপাশে। ব্রহ্মরাজপুর ধূলিহর গায়ে গায়ে। ধূলিহরের ভিতরেই বুঝি ব্রহ্মরাজপুর ঢুকে আছে। পশুপতি ঘোষের বাড়ি জমিদারের অট্টালিকা। রাস্তা থেকে দেখা যায়। কেউ নেই। সব রেখে প্রকাশ ওপারে গিয়ে স’মিলে কাজ নিয়েছিল। আমি তাকে গিয়ে যেন বলি একবার ঘুরে যেতে। তৃপ্তিমোহন, লেখক খায়রুল বাশার, সাংসদ... সবাই আমাকে বলেছেন কদিন ধরে। খায়রুল বাশার বলেছিলেন ঢাকা থেকে। টেলিফোনে। সব ফেলে দিয়ে যে চলে গেছে, তার সব মায়া চলে গেছে যে তা বলতে পারি না। কিন্তু আর ফিরবে না সে। আমাকে প্রকাশ বলেছে, আর ফেরা যায় না। হ্যাঁ, একবার সে যাবে। পাসপোর্ট হয়ে গেলেই যাবে।

ব্রহ্মরাজপুর বাজার বেশ বড়। জমজমাট। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। খারা হাতে অন্নদাচরণ। তৃপ্তিমোহন খুব কথা বলেন। আমাকে সব দেখাবেনই। ওই যে কালভৈরবের মন্দির। টিনের চালা দেখলাম দূর থেকে। আমি বললাম সুপুরিঘাটা যাব। সুপুরিঘাটায় নৌকো থেকে যে নবদম্পতি নেমেছিল বিবাহের পর, তারা আমার জনক-জননী। মায়ের বাপের বাড়ি ছিল কপোতাক্ষ তীরে বাঁকা ভবানীপুর। সুপুরিঘাটার বেতনা নদী গিয়ে পড়েছে নদ কপোতাক্ষয়। মায়ের কাছে শোনা কথাই আমি বলছি। সুপুরিঘাটার আগে আমাদের বাস্তুভিটে। মাটির বাড়ি। এই অঞ্চলে পশুপতি ঘোষ ব্যতীত পাকা বাড়ি ছিল কোথায়। আগের বার, সেই ২০০০ সালে সিদ্দিক ছিল না। মহম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক মোড়ল। ১৯৬২ সালে সিদ্দিকের বাবা শুকুর আলি মসলন্দপুর থেকে এখানে আসেন। তারা অন্নদাবাবুদের ভিটেয় আছেন। তবে সেই ভিটের কিছুটা আছে, সবটা নেই মনে হয়। আবছা যা মনে আছে তার কিছু আছে, বড় দুটি পুকুর ছোট। ডোবার চেয়ে একটু বড়। আমি কী বলব? ভিটের আর কী দেখার আছে? মাটির বাড়ি ভেঙে নতুন করে করা যায়। আমি সিদ্দিকের পরিবার দেখছিলাম। সিদ্দিকের কিছুই মনে নেই মসলন্দপুরের কথা। বাড়ির বাতাবি লেবু কেটে দিল। সিদ্দিকের বিবিকে আমার ছোটকাকির মতো মনে হচ্ছিল। তেমনি স্মিত হাসি, মাথায় ঘোমটা। আগেরবার বলেছিলেন, ভাত খেয়ে যান, আপনাদের ভিটেয় আছি, জমির ধান পাই, খেয়ে বাঁচি... মনে আছে সব। আমি ফোনে ধরলাম আমার মেজদা উদয়নকে। আমি ধুরোলে বাবুদা...। আমাদের জন্মভিটেয়। তাই। ফোনের ওপারে মেজদা কাঁদছেন। সিদ্দিক বলছিলেন, তারা ভালো আছে, সবই মাটির গুণ। সিদ্দিকের বয়স ৫৬-৫৭। অনেক সময় বসেছিলাম উঠানে। হাতনের পৈঠায়। এইখানে জন্মেছিল বড়দা মনোজ, মেজদা উদয়ন, বোন অপর্ণা। অকাল প্রয়াত দিদি ডিলডিল, সবার বড় ভাই সায়েব। মা ছিলেন সর্বংসহা। রাধারানির চোখে জল আসে। তিনি যে আমার ভিতরে আছেন। পাশের বাড়ি আবদুল জলিলের। শীর্ণকায় বৃদ্ধ। তিনি আমাদের আর এক শরিকের বাড়ি নিয়েছেন। বাবার জেঠতুতো ভাইদের বাড়ি। আবদুল জলিল আমাকে বললেন, বেলেঘাটায় গিয়ে সাতদিন ছিলেন সন্তোষ মিত্রর বাড়ি। সেখানেই দলিল হয় বিনিময়ের। কতকালের কথা সব। তিনি অনেক প্রবীণ। আমাকে নানাজনের নাম বলতে লাগলেন। তারা সব তাদের প্রতিবেশী ছিলেন। ইন্ডিয়ায় চলে গেছেন। এই গ্রামেরই মানুষ সবাই। কেউ নেই। হরি মাস্টার ছিল অনেকদিন। তারপর চলে গেল কবে যেন। তর্জনী তুলে দেখিয়ে দিলেন দূরের একটা ভিটে। সিদ্দিকও পড়েছে হরি মাস্টারের কাছে। আরে আমিও পড়েছি। দীর্ঘকায়, কৃষ্ণবর্ণের হরি মাস্টার প্রাইমারি টিচার ছিলেন। দেখেই আতঙ্ক হতো। বেত্রাঘাত, কান ধরে দাঁড়ানো। পথের পাঁচালীর সেই গুরুমশায়ের পাঠশালা ছিল যেন প্রাইমারি ইস্কুলটা। জলিল বললেন, কালী সেন, দোল মাস্টারকে আমি চিনি কি না? নাম শোনা, আমি চিনব কী করে? যিনি সবাইকে চিনতেন, পূর্ববঙ্গ ধারণ করে রেখেছিলেন নিজের ভিতরে, আমার মা রাধারানির কাছেই তো সব জানা আমার। আমি তো রাধারানির স্মৃতিই যেন পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। জলিল জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কালী সেন, বিশ্বেশ্বর সেনরা কি বেঁচে আছেন? রামকৃষ্ণ ধরের ‘ফ্যামিলি’ কেমন আছে? কত সব নাম উচ্চারণ করতে লাগলেন। শুনতে শুনতে রাধারানির চোখে জল। রাধারানি কাঁদছেন। আবদুল জলিল এসে এঁদের পেয়েছিলেন প্রতিবেশী হিসেবে। তারপর সেই সব প্রতিবেশী একে একে গ্রাম ছেড়ে ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। জলিলের খুব মনে পড়ে? আমার সেই জেঠাদের ‘ফ্যামিলি’ কেমন আছে? সুশীল মিত্তির, স্মরজিত মিত্তির, সন্তোষ মিত্তিরদের ছেলেমেয়েরা? কথা যেন ফুরোয় না জলিলের। হ্যাঁ করে শুনছে সিদ্দিক। কেউ নেই। গ্রাম শূন্য করে চলে গেছে সবাই।

আমরা চললাম সুপুরিঘাটার দিকে। বেতনার সেই ঘাটে নববধূ রাধারানি নেমেছিলেন প্রথম। ঘাটেই হিন্দু- মুসলমান নারীরা, এজার শানা মোজার শানার মা দিদিরাও উলুধ্বনি দিয়েছিল। হেমনলিনীর ছেলে হাজুর বউ আসছে। হাজরা ঠাকুরের কৃপায় ছোটবেলায় বেঁচে গিয়েছিল অশোক। তাই তার নাম হাজু। সব জানে রাধারানি। মনে পড়ে যেতে রাধারানির চোখে জল। আমার পিঠে তুহিনের হাত। আমার হাত ধরেছে শুভ্র। এখন আর নদীঘাট নেই। পাকা ব্রিজ হয়ে গেছে। আমরা রওনা হলাম আমার মাতুলালয় বাঁকা ভবানীপুরের উদ্দেশে। আগে কপোতাক্ষ তীরের সেইসব গ্রাম, বাঁকা, রাঢ়ুলি কাটিপাড়া, পাইকগাছা, কপিলমুনি, আমাদী থেকে নদীপথই ছিল পথ। স্টিমার-লঞ্চ ধরে বেরুতে হতো গ্রামের বাইরে। এখন রাস্তায় রাস্তায় জুড়ে গেছে সব। পথের বাধা নদীর এপার ওপার সেতুতে সেতুতে জুড়েছে। মাঝে গাড়ি থামল বুধাহাটা বাজারে। চা খাওয়া হলো। বুধাহাটার নাম কত শুনেছি মায়ের কাছে। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। আমি বুধাহাটা থেকে ফোনে ধরেছি ছোটমামাকে। মামা আমি বাঁকা যাচ্ছি। সে কী আবেগ শিবপ্রসাদ বসুর। কত কথা। তারপর বললেন, কেন যাচ্ছিস? কিছুই নেই। কেউ নেই।

আবার রওনা হলাম। গাড়ি ছুটেছে চমৎকার রাস্তা দিয়ে। দুপাশে বিল-জমি। মাছের ঘের। জল আর জল। আবার কোথাও বিস্তীর্ণ খেতে ধান পেকেছে। খেজুর গাছ কাটা হয়েছে। কলসি এখনো ঝোলেনি। রাধারানি চলেছে তার বাপের বাড়ি। বিষাদে ভরা মুখ। চশমার কাচের আড়ালে চোখ ছলছল। কার কাছে যাবে সে? আমি মাতুলালয় দেখিনি। মায়ের কাছেই যা শোনা সেই হারানো নদী হারানো গ্রামের গল্প। স্টিমারের ভোঁ বহুদিন থেমেছে। আমরা ঘণ্টা দেড় বাদে বুঝি পৌঁছেছি বাঁকা বাজারে। কেন এলাম মা? মাতুলালয় শূন্য। কালী সেন বিশ্বেশ্বর সেনদের মতো সবাই চলে গেছে ইন্ডিয়া। পড়ে আছে ভিটা কিন্তু অন্য মানুষ। পিয়াস মজিদ জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, কেউ আছে মামাবাড়িতে? মাথা নেড়েছি। কে থাকবে? আমার মামারা-মাসিরা সব ইন্ডিয়ায় গিয়ে খুব কষ্ট করে বেঁচেছে। দাঁড়িয়েছে। আবার এখনো দাঁড়াতে চাইছে। খুঁজছি সেই বোস বাড়ি। অবিনাশ বোস। জমিদার ছিলেন। মামাদের বড় শরিক। আমি কোনোদিন আসিনি এই গাঁয়ে, বাড়িটা দেখিয়ে দেবেন ভাই। অবিনাশ বোসকে কে না চেনে। তিনপুরুষ আগের মানুষ। তাদের দান ছিল গ্রামে। বিরাজ সাগরের জল যে এখনো খায় গ্রামের মানুষ। ওই পুকুরে মাছ নেই। শুধু তৃষ্ণার জল। এসব বলতে বলতে দোকানি মুকুল বললেন, রাতুল বোস তো থাকে এখানে। কে রাতুল বোস?

আমাদের গাড়িতে কামাল হোসেন নামের যুবক উঠেছে বাড়ি দেখিয়ে দিতে। প্রাচীন হয়ে আসা দুতলা দুটি দালান সম্মুখে। ডানদিকে। বাঁয়ে কপোতাক্ষ আল বেঁধে মাছের ঘের। নদীকে এইভাবে হত্যা করা হয়েছে আমাদের দেশেও। ইছামতির এই হাল হয়েছে অনেক জায়গায়। আমি অবাক হয়ে দেখছি। সেই নদী? প্রমত্তা নদী। ভোরে প্রথম ইস্টিমার। আমার যে সব জানা। শুভ্র বলল, ড্রেজিং করে কপোতাক্ষকে আবার বাঁচানো হচ্ছে। কাজ চলছে। মাইকেলের নদী যে কপোতাক্ষ। প্রথম বাড়ি রেখে দ্বিতীয় বাড়ির বারান্দায় উঠেছি। দেয়ালের প্লাস্টার খসা। জানালার খড়খড়ির সবুজ রং মলিন হয়ে গেছে। জানালায় এক প্রবীণার মুখ। আমি তাকে চিনি না। রাতুল হলো পিন্টু বোসের ছেলে। পিন্টু মামা মন্টু মামাদের দেখেছি ছোটবেলায় মনে হয়। মায়ের জ্যাঠতুতো ভাই। তাদের একজন আছেন এখানে? সত্যি! কেউ আছে? রাধারানি এই দ্যাখো পিন্টু মামার বউ, আমার মামি জানালায় দাঁড়িয়ে। উনি কি আমাকে চিনবেন। দুচোখে বিস্ময় আর চাপা ভয়ও।

আমি বারান্দায় উঠতে উঠতে বলছি, মামি আমি রানিদির ছেলে, রানিদি গো, রাধারানি, বেলগেছিয়ার রানিদি। রানিদি! অশোক মিত্র! মনোজ আপনার বড় ভাই। রানিদিরে আমি দেখিনি কোনোদিন, বলতে বলতে তিনি জানালা থেকে সরে বাইরে এলেন। মোবাইলে ডাকতে লাগলেন রাতুলকে। সে বাজারেই আছে। রাধারানি বললেন, আমিও তোমারে দেখিনি বউ, তোমারে দেখতি এতদূর আসা। কেউ নেই ভেবে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ভ্রমরা সীমান্ত থেকে তা যে এইভাবে নাড়–, চন্দ্রপুলি, তক্তি, সন্দেশ, দধিতে পুণ্য হবে কে জানত। রাতুল এলো। লুঙ্গি আর শার্ট পরিহিত রাতুল আমাকে দেখাল আমার মামার বাড়ি। পেছন দিকে। শহর আলী গাজির পুত্ররা কিনেছিল অন্য দুই শরিকের অংশ। অবিনাশ বোসের অংশ, বড় অংশ নিয়ে রাতুল ওদেশে ফিরে গেছে ইন্ডিয়ায় এসে কিছু না করতে পেরে। নিজের দেশ তো। নিজের গ্রাম। রাধারানি বললেন, আমিও থাকি রাতুল? থাকো পিসি থাকো। রাধারানি নিজের বাপের বাড়ি ফিরলেন। বাড়ির পিছনে সেই পুকুর। কী টলটলে জল! ঘাটে বসে চোখের জল ফেলতে লাগলেন রাধারানি। আমি ছোটমামা শিবপ্রসাদকে ফোন করেছি সেখান থেকে। গলা জড়িয়ে গেছে ইন্ডিয়ার এবং বাংলাদেশের। কথা আটকে গেছে দুজনেরই। দূরে কপোতাক্ষ। গতিহারা। ম্লান মুখ। মায়ের চোখের জল।

অমর মিত্রঃ কলকাতার খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :