মামলার ফাঁদ: চট্টগ্রাম ও মংলায় আটকা ৯ বিদেশি জাহাজ

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২২:১১ | প্রকাশিত : ০৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ২১:৫০

চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে মামলার ফাঁদে আটকে আছে নয়টি বিদেশি জাহাজ। এরমধ্যে গত চার-পাঁচ বছর ধরে আটকা পড়ে সাগরে ভাসছে এমন জাহাজও আছে। পণ্য নিয়ে এসে কোটি টাকার জাহাজ আটকে পড়ায় মালিকদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, নাবিক ও অফিসারদের বেতন বাবদ দেনা-পাওনা পরিশোধ ও বিভিন্ন ক্ষতিপুরণ আদায়ের মামলায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে এসব জাহাজ আটক রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে সাতটি এবং মংলা বন্দরে দুটি জাহাজ আটকা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্ট কর্তৃপক্ষ।

শিপিং এজেন্টদের সূত্রমতে, আটক জাহাজের দু-একটির বিরুদ্ধে যৌক্তিক মামলা হলেও কিছু জাহাজ উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে মামলা করে আটকে দিয়েছে স্বার্থান্বেষি মহল। অবস্থা এমন যে চাইলেই মামলা দিয়ে কোটি টাকার জাহাজ আটকে দেয়া যায়। মামলার উৎপত্তিতে সার্ভেয়ারদের যোগসাজশ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন এজেন্টরা।

চট্টগ্রাম বন্দর সূত্র জানায়, মামলার কারণে সিঙ্গাপুর থেকে ক্লিঙ্কার নিয়ে আসা জাহাজ এশিয়া জিরকন গত ১৩ নভেম্বর আটকা পড়ে। গত ৩০ অক্টোবর আটক হয় কয়লা নিয়ে আসা মাল্টা পতাকাবাহী মিম সুপ্রামেক্স। গত ১৬ জুন থেকে আটকে আছে ভিয়েতনামী জাহাজ ভিনালাইনস স্টার।

বাংলাদেশি জাহাজ ক্রিস্টাল গোল্ড গত বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি থেকে এবং গোল্ডেন সাফায়ার ১৬ জানুয়ারি থেকে আটক রয়েছে। নাবিক ও অফিসারদের বেতন দেনাপাওনা পরিশোধের মামলায় জাহাজ দুটি আটকে আছে। গত বছরের ১৯ মার্চ থেকে আটকে আছে গাগাসন যোহর। সিঙ্গাপুর পতাকাবাহী আতিকুর রহমান গত বছরের ১৮ মে থেকে আটক রয়েছে। ২০১১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে আটক রয়েছে পানামা পতাকাবাহী সুইফট ক্রো।

মংলা বন্দর সূত্র জানায়, সাইপ্রাস পতাকাবাহী এমভি বোরা আটকে আছে গত তিন বছর ধরে। আমদানিকারকের ক্ষতিপূরণ মামলায় জাহাজটি আটক রয়েছে। ক্রেনের ধীরগতি এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পণ্য খালাসে বিলম্বের অভিযোগে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। মংলায় আটকে আছে আরও একটি জাহাজ।

জাহাজগুলোর আটকাদেশসমূহ পর্যালোচনায় দেখা যায়, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের আর্জির পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত আটকাদেশ দেয়। এসব এডমিরালটি মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রিতার কারণে জাহাজ মাসের পর মাস; বছরের পর বছর অবস্থানের কারণে স্থানীয় এজেন্ট বা প্রটেক্টিং এজেন্ট ব্যয়ভার বহন করতে পারে না। ফলে জাহাজের নাবিকরা নানা দুর্ভোগে পড়ে জাহাজ পরিত্যাগ করে চলে যান। জাহাজ নিয়ে পালিয়ে যেতেও বাধ্য হন।

অতীতে এমভি ডেল্টা স্টার, এমভি জিংঈ জাহাজকে নাবিকরা ফেলে চলে গিয়েছিলেন। আর কোনো প্রকার পোর্ট ক্লিয়ারেন্স ছাড়াই পালিয়েছিল টেকমেট পাইওনিয়ার জাহাজ। একশ্রেণির আমদানিকারক এবং শিপিং এজেন্টদের শিকারে পরিণত হয় গম, ক্লিংকার, কয়লা, লবণবোঝাই বিদেশি জাহাজগুলো। কোনো একটা অজুহাত তুলে তারা জাহাজ মালিকের কাছে থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের নামে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফন্দি-ফিকির শুরু করে। হুমকি দেয়া হয় এডমিরালটি কোর্টে মামলা দায়েরের। এরপরও জাহাজ মালিক রাজি না হলে মামলা করে দেয়। ১০ লাখ টাকা ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় ১০ কোটি টাকার।

বার আউলিয়া শিপিং এজেন্সির ব্যবস্থাপক দুলাল মিয়া ঢাকাটাইমসকে জানান, বাংলাদেশে আমদানি পণ্য নিয়ে আসা একের পর এক জাহাজ এভাবে হয়রানিতে পড়ার ঘটনায় শিপিং কোম্পানিরা উদ্বিগ্ন। তারা এটাকে ভালোভাবে নিচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। এভাবে হয়রানির আশংকায় তারা বাংলাদেশে ভালো জাহাজ পাঠাতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে এবং ফ্রেইটও দাবি করছে বেশি। পুরনো লক্কর-ঝক্কড় জাহাজসমূহ তারা পাঠাচ্ছে বাংলাদেশে।

ভাই-ভাই শিপিং এজেন্সির প্রধান নির্বাহী আশিকুর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, স্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আসার কারণে আর্দ্র আবহাওয়ায় জাহাজের খোলে কিছু পণ্য আংশিক নষ্ট হতে পারে। আর এটাকে পুঁজি করে সার্ভেয়ার প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ক্যাপ্টেনকে বাধ্য করা হয় সার্ভে রিপোর্ট ঠিক আছে বলে মেনে নিতে। এরপর শুরু হয় জাহাজ মালিকের সাথে দর কষাকষি। ক্ষতিপূরণ বাবদ অস্বাভাবিক ও অবাস্তব দাবি করা হয়। আর এই অর্থ আদায় নিয়ে এডমিরালটি কোর্টে মামলার হুমকি দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, আমদানি পণ্যবোঝাই জাহাজ পৌঁছার পর খালাস শুরু করার পূর্বে সার্ভে করা হয়। সরবরাহকারী এবং আমদানিকারকের মনোনীত এবং সরকার অনুমোদিত মাস্টার মেরিনাররা তা করে থাকেন। কাস্টমস-এর প্রতিনিধির উপস্থিতিতে তারা সার্ভে করেন। সার্ভে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমদানিকারক পণ্য বুঝে নেন। কতিপয় আমদানিকারক এক্ষেত্রে গর্হিত কৌশলের আশ্রয় নেন। তারা ভালো পণ্যকে নষ্ট চিহ্নিত করে অথবা ওজনে ঘাটতির অভিযোগ তুলে ক্ষতিপূরণ আদায়ে তৎপর হন। সার্ভে প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে তা হয়ে থাকে।

এমনকি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়োজিত সার্ভেয়ারও আমদানিকারকের স্বার্থ রক্ষা করেন। সার্ভে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমদানিকারক নষ্ট বা ঘাটতির জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। শিপমেন্টের সময় ব্যাংক থেকে মালের মূল্য পেয়ে যায় সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। তাই তাকে কিছু করার থাকে না।

এ পরিস্থিতিতে ফাঁসানো হয় জাহাজ মালিককে। নানাভাবে চেষ্টা হয় আপসরফার। কিন্তু আমদানিকারকের অস্বাভাবিক ক্ষতিপূরণ দাবি মেনে নিতে জাহাজ মালিক অপারগতা প্রকাশ করেন। এই পর্যায়ে আমদানিকারক হাইকোর্টের এডমিরালটি বিভাগে মামলা করে দেয় জাহাজের আটকাদেশ চেয়ে। এরপর জাহাজ আটকে যায় হাইকোর্টের আদেশে। মামলা নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত আটকে থাকে। প্রচুর সময় লেগে যায় মামলা নিষ্পত্তিতে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর আটকে থাকতে থাকতে জাহাজের দায়-দেনার পরিমাণ দাঁড়ায় বিক্রয় মূল্যের বেশি। তখন মালিক জাহাজ ফেলে চলে যান। আদালত জাহাজের আটকাদেশ প্রদানের পর তা ন্যস্ত হয় বন্দরের হেফাজতে।

আদালতের পুনরাদেশ ছাড়া জাহাজ যাতে বাংলাদেশের জলসীমা ত্যাগ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয় বন্দর কর্তৃপক্ষকে। কর্তৃপক্ষ জাহাজের ছাড়পত্র প্রদান (এনওসি) বন্ধ রাখে। বহির্নোঙ্গরে জাহাজের গতিবিধির ওপর নজরদারির কোন লোকবল ও যান্ত্রিক উপকরণ নেই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের।

এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) গোলাম সারোয়ার ঢাকাটাইমসকে বলেন, ঢালাওভাবে জাহাজ আটক করার প্রবণতা রোধ এবং আটক জাহাজের মামলা নিষ্পত্তি তিন মাসের মধ্যে করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। সেটা হলে জাহাজ মালিকদের হয়রানি হ্রাস পেতো বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।

(ঢাকাটাইমস/০৫ডিসেম্বর/আইকে/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বন্দর নগরী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা