৭০০ টাকার নাম্বার প্লেটের জন্য ৩০ হাজার টাকা!

মঞ্জুর রহমান, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:১৬

সোমবার সকাল ১০টা। মানিকগঞ্জ পৌরসভার সামনে একটি অটোবাইকের সিটে মন খারাপ করে বসে আছেন মজনু মিয়া নামের এক যুবক। ব্যাটারিচালিত হেলো বাইক চালক মজনু'র বাড়ি পৌর এলাকার কেওয়ারজানী। জীবন থেকে একটি বছর চলে গেছে, কিন্তু তার ইজি বাইকের নাম্বার প্লেট এখনও পাননি।

চোখে মুখে রাজ্যের হতাশা নিয়ে বললেন, ‘পৌরসভার সামনে সকাল থেকে বসে আছি বাচ্চু ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য। বাচ্চু ভাই একটি প্লেট ব্যবস্থা করে দিবেন বলেছেন। কিন্তু কবে যে পাব সেই নাম্বার প্লেট?’

একই দশা পশ্চিম দাশড়া এলাকার গনি মিয়া, মকিমপুর এলাকার শাকিল ও উচুটিয়া এলাকার আইউব মিয়াদের। নাম্বার প্লেটের জন্য ঘুরে ঘুরে হয়রান।

এত নাম্বার প্লেট তাহলে কোথায় যায়? কারা এগুলো পায়? প্রশ্নের জবাবে বান্দুটিয়া এলাকার হাফিজুর রহমান বলেন, পৌরসভার নম্বর প্লেট বাইরের লোকদের কাছে বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। যার কাছ থেকে যত নিতে পারে। এগুলো কারা বিক্রি করছে এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, পৌরসভার কাউন্সিলর নিজের লোক মারফতে এগুলো বিক্রি করছেন। আবার কোনো কোনো কাউন্সিলর নিজেই সরাসরি পৌর এলাকার বাইরের গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছেন।

এ সময় উপস্থিত এক হেলোবাইক চালককে দিয়ে পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছারোয়ার হোসেনকে ফোন দিয়ে টাকা নেয়ার সত্যতাও পাওয়া গেল।

মানিকগঞ্জের বর্তমান মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম দুর্নীতিমুক্ত পৌরসভা গড়ে তোলার অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাস্তবতা যে মেয়রের অঙ্গীকারের সাথে মেলে না! এক বছর যেতে না যেতেই এমন নৈরাজ্য। এটি মেয়র জানেন তো? এ ব্যাপারে আরও অনুসন্ধান করতে যাওয়া হলো মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। সেখানকার চালকরাও জানালেন কীভাবে কাদের মাধ্যমে নম্বর প্লেট পাওয়া যায়?

মানিকগঞ্জ পৌরসভার বেউথা এলাকার রনি (নিরাপত্তার স্বার্থে বাইক নম্বর প্রকাশ করা হলো না) বলেন, ‘আমি দুই মাস আগে হেলোবাইক কিনেছি। বিভিন্ন লোকজনদের বলেও নম্বর প্লেট পাইনি। এরপর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর উজ্জল হোসেনকে ১৫ হাজার টাকা দিয়ে নম্বর প্লেট নিয়েছি। অভিযোগ রয়েছে এই কাউন্সিলর ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে আরও অনেক নম্বর প্লেট পৌর এলাকার বাইরে বিক্রি করেছেন।’

শহরের দুধবাজার এলাকার বাদশা মিয়া (নিরাপত্তার স্বার্থে বাইক নম্বর প্রকাশ করা হলো না) বলেন, ‘আমি তিন মাস হলো হেলোবাইক কিনেছি। কিন্তু পৌরসভায় অনেক ঘুরেও নম্বর প্লেট পাইনি। পড়ে বাধ্য হয়ে পৌরসভার পিয়ন বাচ্চু মিয়াকে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে নম্বর প্লেট নিয়েছি। বিভিন্ন কাউন্সিলররা বাচুচকে দিয়ে বরাদ্দ পাওয়া নম্বর প্লেট পৌর এলাকার বাইরের হেলোবাইক চালকদের কাছে বিক্রি করছেন।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ১২জন কাউন্সিলরকে সাতটি করে নম্বর প্লেট বরাদ্দ দিয়েছেন। কাউন্সিলররা বরাদ্দ পাওয়া নন্বর প্লেটগুলো নিজ ওয়ার্ডের লোকদের না দিয়ে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা নিয়ে তা পৌর এলাকার বাইরের গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করছেন।

সদর উপজেলার মকিমপুর এলাকার ফয়সাল মিয়া বলেন, তিনি পৌরসভার এক প্রভাবশালী কাউন্সিলরকে ৪০ হাজার টাকা দিয়ে নম্বর প্লেট নিয়েছেন। তিনি তার নিরাপত্তার স্বার্থে কাউন্সিলরের নাম প্রকাশ করতে চাননি। এদিকে মকিমপুর এলাকার শাকিল নামের এক যুবক পৌরসভার এক স্টাফকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে রাখছে নম্বর প্লেটের জন্য। কিন্তু এখন তাকে নম্বর প্লেট না দিয়ে ঘুরানো হচ্ছে। বান্দুটিয়া এলাকার আব্দুল পাশা ২০ হাজার টাকা খরচ করে পৌরসভা থেকে নন্বর প্লেট নিয়েছে এমন খবর নিশ্চিত করেছে তার এক আত্মীয়।

এদিকে জানা গেছে, এই নম্বর প্লেট বিক্রির সাথে জড়িত আছে তারেক নামের এক যুবক। তিনি পৌরসভার পিয়ন পরিচয় দিলেও তাকে পৌরসভার মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিমের সাথে তারেককে সব সময় চলাফেরা করতে দেখা যায়।

মানিকগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও হেলোবাইক চালক খিলিন্দা এলাকার খোরশেদ আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা পৌরসভার বাসিন্দা হওয়ার পরও নন্বর প্লেট নিতে আমাদের হয়রানি হতে হচ্ছে। অথচ যারা পৌর এলাকার বাইরের লোক তারা নম্বর প্লেট পেয়ে যাচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।’

তিনি বলেন, ‘আগেরমেয়র রমজান আলীর দুর্নীতির কারণে সেলিম ভাইয়ের কথায় তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছি। এখন দেখি এখানে আরও বেশি দুর্নীতি।’

মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়রা এলাকার বাসিন্দা ও হেলোবাইক চালক বলেন, 'আমরা আগের মেয়রের সময়কালে হেলোবাইক কিনে নম্বর প্লেট করেছি। এখন সেই সময়ের নম্বর প্লেটগুলো পুনরায় নবায়ন করতে পারছি না। নন্বর প্লেট করতে গেলে আমাদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।’

মানিকগঞ্জ পৌরসভার সহকারী লাইসেন্স পরিদর্শক ফারুক হোসেন বলেন, পৌরসভা থেকে (২০১৬-২০১৭) অর্থবছরের জন্য হেলোবাইক চালকদের ৫০০টি নম্বর প্লেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন নম্বর প্লেট পেতে এবং পুরানো নম্বর প্লেটগুলো পুনরায় নবায়ন করতে হলে গ্রাহকদের পৌরসভার মেয়র বরাবর ৭০০ টাকা জমা দিয়ে আবেদন করতে হয়। এরপর যাচাই-বাচাই করার পর গ্রাহকদের নতুন নম্বর প্লেট দেয়া হয়। তার দাবি, যদি কোনো গ্রাহক পৌর এলাকার বাইরে বাসিন্দা হয়ে থাকে তাহলে তাকে নম্বর প্লেট দেয়া হয় না।

মানিকগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র আরশেদ আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, নতুন প্লেট ও নবায়নের জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে পৌর গ্রাহকদের কাছ থেকে ৭০০ টাকা নেয়া হয়। এর বাইরে কোনো টাকা নেয়া হয় না। তার দাবি, বর্তমান মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিমের নেতৃত্বে যে পরিষদ গঠিত হয়েছে তা দুর্নীতিমুক্ত।

মানিকগঞ্জ পৌরসভার মেয়র গাজী কামরুল হুদা সেলিম ঢাকাটাইমসকে বলেন, হেলোবাইকের নম্বর প্লেট বিক্রির সঙ্গে শুধু কাউন্সিলর নয়, পুরানো হেলোবাইক চালকরা জড়িত এমন খবর আমি পেয়েছি। কিন্তু এতে আমার কিছু করার নেই।

আগের মেয়র রমজান আলীর কাছ থেকে হেলোবাইক গাড়ির নম্বর প্লেট পাওয়া গ্রাহকরা নতুন করে নবায়ন করতে পারছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে পৌর মেয়র বলেন, পৌরসভা থেকে পাঁচ শতাধিক হেলোবাইকের নম্বর প্লেট গ্রাহকদের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চার শতাধিক পুরানো হেলোবাইকের নম্বর প্লেট নবায়ন করা হয়েছে।

মানিকগঞ্জ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অর্থরিটি (বিআরটিএ) মানিকগঞ্জ সার্কেলের সরকারী পরিচালক (ইঞ্জি.) প্রকৌশলী মোবারক হোসেন বলেন, এক শ্রেণির লোক অবৈধভাবে ব্যাটারিচালিত হেলোবাইকগুলো বিক্রি করছে। এসব গাড়ি যারা বিক্রি করছে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাদের আর্থিক জরিমানা করাসহ দোকান সিলগাড়া করে দেয়া হচ্ছে। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ অবৈধ হেলোবাইক চলাচলের অনুমোদন দিতে পারে না।

(ঢাকাটাইমস/০৬ডিসেম্বর/এমআর/এসএএফ/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

কথায় কথায় মানুষ পেটানো এডিসি হারুন কোথায়? থানায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের তদন্ত কোথায় আটকে গেল?

মজুত ফুরালেই বাড়তি দামে বিক্রি হবে সয়াবিন তেল

কোন দিকে মোড় নিচ্ছে ইরান-ইসরায়েল সংকট

ছাদ থেকে পড়ে ডিবি কর্মকর্তার গৃহকর্মীর মৃত্যু: প্রতিবেদনে আদালতকে যা জানাল পুলিশ

উইমেন্স ওয়ার্ল্ড: স্পর্শকাতর ভিডিও পর্নোগ্রাফিতে গেছে কি না খুঁজছে পুলিশ

জাবির হলে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে জঙ্গলে ধর্ষণ, কোথায় আটকে আছে তদন্ত?

নাথান বমের স্ত্রী কোথায়

চালের বস্তায় জাত-দাম লিখতে গড়িমসি

গুলিস্তান আন্ডারপাসে অপরিকল্পিত পাতাল মার্কেট অতি অগ্নিঝুঁকিতে 

সিদ্ধেশ্বরীতে ব্যাংক কর্মকর্তার মৃত্যু: তিন মাস পেরিয়ে গেলেও অন্ধকারে পুলিশ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :