লেখক শেখ হাসিনা : শত ব্যস্ততার মধ্যেও বের করে নেন লেখার সময়

মাহবুবুল হক শাকিল
| আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৩৪ | প্রকাশিত : ০৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৫

[বয়স মাত্র ৪৮। আজ ৬ ডিসেম্বর দুপুরে অকস্মাৎ প্রয়াত হলেন কবি ও গল্পকার মাহবুবুল হক শাকিল। সাহিত্যিকরা ভালো প্রশাসক হন না, ভালো আমলা হতে পারেন না- প্রচল এই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী হিসেবে দারুণ সক্রিয় ছিলেন আমৃত্যু। দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের পেছনে অনেক ক্ষেত্রেই সেতুবন্ধনের কাজটি করেছেন শাকিল। মাস দেড়েক আগে সাপ্তাহিক এই সময়ের বিশেষ একটি সংখ্যায় লেখক শেখ হাসিনার লেখালেখির অজানা অধ্যায় তুলে ধরেছিলেন তিনি। সেই লেখাটি মাহবুবুল হক শাকিলের স্মরণে পাঠকদের উদ্দেশ্যে আবার দেয়া হলো।]

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে লেখালেখির অভ্যাস খুব বেশি নেই। অনেকেই আক্ষেপ করে বলে থাকেন, আমাদের রাজনীতিবিদরা যদি তাদের নিত্যদিনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথাও একটু কষ্ট করে টুকে রাখতেন, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এত সহজে বিকৃত করা সম্ভব হতো না। সামরিক শাসকদের অপকর্মও চাপা পড়ে যেত না। বাংলাদেশের হাতে গোনা যে কজন রাজনীতিবিদ লেখালেখি করেন তাদের মধ্যে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম। রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি কিভাবে লেখার সময় বের করেন, তা অনেককেই ভাবায়। পাশাপাশি তিনি একজন একনিষ্ঠ পাঠক। কথাসাহিত্যিক হরিশংকর জলদাস থেকে শুরু করে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অনেক তরুণ কবিও আছেন তার পড়ার ভেতরে।

প্রচুর লিখেছেন তিনি। অল্প কয়েকটি দিক এখানে আলোকপাত করা যেতে পারে।

২০১০-এর জানুয়ারিতে মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত ‘শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র’-এর ভূমিকায় তিনি নিজেই লিখছেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস আমার শৈশব-কৈশোর থেকে এবং সাহিত্য নিয়ে লেখাপড়া করায় আমি এ ভুবনে একজন মুগ্ধ অনুরাগী শুধু। কোনো দিন নিজে লিখব এ কথা ভাবিনি।... সময়ের দাবি আমাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে। পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে বিগত ২৮ বছর যাবৎ জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি। চারপাশে দেখা ঘটনা, মানুষের স্বপ্ন ও জীবনকে আমি যেভাবে দেখেছি এবং জেনেছি, তাই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি মাত্র।’

কৈশোরে ছিলেন ছায়ানটের শিক্ষার্থী। পিতা বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত পাঠাগার ছিল সমৃদ্ধ। নতুন কোনো বই বাসায় এলে ভাইবোনদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যেত কে আগে পড়বেন তা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু নিজে অবসর সময়ে তার ভরাট কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করতেন। তার মা ছিলেন সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক। পাশের বাসার ফুফু ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা ছিল নীলিমা ইব্রাহিমের সঙ্গে। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে তিনি অধ্যাপক আবদুল হাই, শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের মতো পণ্ডিতদের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে।

১৯৭৫-পরবর্তী দুঃসময়ে দীর্ঘদিন ছিলেন দূরপ্রবাসের নির্বাসনে। দেশে ফিরেছেন, গৃহবন্দি হয়েছেন, বারবার ঘাতকের বুলেটের টার্গেট হয়েছেন। নির্জন কারাবাসে ছিলেন মাসের পর মাস। এসবই তাকে এমন এক অভিজ্ঞতার ভেতরে দিয়ে নিয়ে এসেছে যে, লেখাকেই তিনি তার স্বপ্ন, বেদনা, আশা আর সংগ্রামের কথা বলার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার গদ্যে বারবার এসেছে এ দেশের দুঃখী মানুষের কথা, তাদের জীবনের সংগ্রাম আর কষ্টের কথা। পাশাপাশি অনুপম যে বিষয়টি পাঠক হিসেবে আমরা দেখি, গল্পকার যেখানে শুধু দুর্দশার ছবি এঁকে তার লেখা শেষ করেন, সেখানেই শেখ হাসিনা শুরু করেন তার লেখার সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়। তিনি খুঁজতে থাকেন এসব সমস্যা থেকে সমাধানের বিভিন্ন উপায়। তা নিয়ে আলোচনা করেন। অনেকগুলো পথের কথা তিনি পাঠকের সামনে আনেন; কিন্তু কোন পথটি ভালো সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভারটি একাই তুলে নেন না, সম্পৃক্ত করে ফেলেন তার পাঠককে। তার গদ্য শেষ হয় বটে; কিন্তু সচেতন পাঠককে ভাবায় অনেকক্ষণ।

‘ওরা টোকাই কেন’−শেখ হাসিনার একটি বহুল আলোচিত বই। সেখানে তিনি সমাজের অবহেলিত শিশু-কিশোরদের দুর্দশার ছবি তার শব্দের আঁচড়ে তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মিছিলে ছোট্ট শিশুদের ব্যবহার তাকে ভাবিয়েছে, যা সচরাচর গতানুগতিক ধারার কোনো রাজনীতিবিদকে ভাবায় বলে আমরা জানি না। ছিন্নমূল এ শিশুরা কেন গ্রাম থেকে শহরে এসে মানবেতর জীবনযাপন করে, তা নিয়ে তিনি ভেবেছেন। তারপরই তার লেখায় উঠে এসেছে সামাজিক বৈষম্যের চিত্র, ধনী-গরিবের ব্যাপক ফারাক, কিছু মানুষের দুর্নীতি, এমনকি বড় রাষ্ট্রগুলোর বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার প্রসঙ্গ। তিনি এদের জন্য সবচেয়ে বেশি যে প্রয়োজনের কথা ভেবেছেন সেটি হলো, পারিবারিক আশ্রয়। সমস্যা সমাধানের এই যে ভিশন তা তাকে অন্য লেখকদের চেয়ে আলাদা করে।

১৯৮৮ সালের বন্যায় তার অসাধারণ অভিজ্ঞতার চিত্র ‘বন্যাদুর্গত মানুষের সঙ্গে’। ২০ আগস্ট তিনি ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া যান। প্রায় এক মাস পরে ঢাকা ফেরেন ১৫ সেপ্টেম্বর। ত্রাণ দিতে গিয়ে জলচৌকি থেকে উঁচু মাচায় উঠতে গিয়ে আহত হন। সে সময়ের অভিজ্ঞতা, কষ্টের সেই বর্ণনা পাই আমরা তার কাছে−‘হারাকান্দি গ্রামের আব্দুর রহমান ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘরের মধ্যে মাচা বেঁধে শুয়ে আছে। হঠাৎ পানিতে খলখলানি আওয়াজ। আব্দুর রহমান ভাবল নিশ্চয়ই কোনো বড় মাছ। কোচখানা নিয়ে জায়গাটি দেখে আঘাত করল। কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে স্থির হয়ে গেল জলের প্রাণীটি। রক্তে লাল হয়ে গেল জায়গাটি। পানিতে নেমে মাছ তুলতে গিয়ে তুলে নিয়ে এলো নিজের সন্তানের লাশ। ঘুমের মধ্যে শিশুটি পানিতে পড়ে গেলে মাছ মনে করে তাকে আঘাত করে তার পিতা। আজ সেই শিশুর পিতামাতা পাগলপ্রায়।’

‘শেখ মুজিব আমার পিতা’−২০১৫ সালে আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। এই আত্মজৈবনিক সংকলনে কন্যার কলমে ফুটে উঠেছে আমাদের ইতিহাসের মহত্তম মানুষটির অবয়ব। শেখ হাসিনার সাহিত্যকুশলতা আর কবিতার গন্ধমাখা গদ্যের হাতটিই আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি ‘শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র’র প্রথম লেখা ‘স্মৃতির দখিনা দুয়ার’-এর পাতায় পাতায়, ছত্রে ছত্রে। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালীর মুগ্ধ পাঠক শেখ হাসিনা এক অসামান্য কুশলতায় পটুয়ার মতো ছবি এঁকেছেন যেন : ‘আমার শৈশবের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরম পলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝির ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈঁচি, দিঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে।’

তার পাঠক যখন এখানে দুর্গা ও অপুর সেই চিরচেনা ছবি দেখছেন তখন শেখ হাসিনা লেখার শেষে গিয়ে ভাবছেন কৃষিব্যবস্থা, সমবায়, গ্রামের জন্য আধুনিক হাসপাতাল, মাতৃসদন এবং বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামোর কথা।

২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী বিপন্ন বাংলাদেশের চিত্র তিনি সাংবাদিকের কুশলী কলমের মতো যেন তুলে এেেনেছন ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ প্রবন্ধে। সেই কৃষ্ণপক্ষের দিনগুলোতে পূর্ণিমা, ফাহিমা, রজুফা, তৃষা আর পঙ্গু শেফালি রানীর আর্তনাদ উঠে এসেছে তার কলমের টানে।

কন্যা হিসেবে শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা শুধু তাদের পিতা নয়, মাতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি বাঙালির ঋণ শোধ করেছেন বিস্মৃতির ধুলো থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ সারা বিশ্বের উজ্জ্বল আলোর সামনে নিয়ে এসে। অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকায় তার ছোট্ট লেখায় যেন লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের হারিয়ে ফেলা ইতিহাস খুঁজে বের করার জন্য এক দুখিনী রাজকন্যার অবিরাম চেষ্টার কথা, যা রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।

‘খাতাগুলো হাতে পেয়ে আমি তো প্রায় বাকরুদ্ধ। এই হাতের লেখা আমার অতি চেনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে ডাকলাম। দুই বোন চোখের পানিতে ভাসলাম। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করলাম। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি; তারপরই এই প্রাপ্তি। মনে হলো যেন পিতার আশীর্বাদের পরশ পাচ্ছি। আমার যে এখনও দেশের মানুষের জন্য সেই মানুষ, যারা আমার পিতার ভাষায় বাংলার ‘দুঃখী মানুষ’−সেই দুঃখী মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ বাকি, তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজ বাকি, সেই বার্তাই যেন আমাকে পৌঁছে দিচ্ছেন। যখন খাতাগুলোর পাতা ওল্টাচ্ছিলাম আর হাতের লেখাগুলো ছুঁয়ে যাচ্ছিলাম আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আব্বা আমাকে যেন বলছেন, ভয় নেই মা, আমি আছি, তুই এগিয়ে যা, সাহস রাখ।’ এখানেই রাজনীতিবিদ শেখ হাসিনার সাহসের উৎস, ভিশনারি শেখ হাসিনার স্বপ্নের চাবি আর লেখক শেখ হাসিনার প্রেরণার পদ্মসরোবর।

মাহবুবুল হক শাকিল : কবি, গল্পকার

ঢাকাটাইমস/০৬ডিসেম্বর/এমএইচএস/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :