দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার শিকার প্রান্তিক নারী

শামীম আরা শিউলী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৫০ | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:২১

জয়ফুল বেগমের ফটোর সঙ্গে যে পরিচয় দেয়া আছে সেখানে তার বয়স উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫। হাওর অধ্যুষিত সুনামগঞ্জের পুর্বপাড়ার এই নারীর ছবি দেখে আমি নিশ্চিত তার বয়স ৫০-এর কম নয়। সময়টা ছিল ২০১৪ সাল। একটা গবেষণার কাজে হাওর ও চরাঞ্চলের হতদরিদ্র নারীদের জীবনযাপন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের কাজ করছিলাম।

জয়ফুল বেগমসহ মোট ৩৫ জন নারীর একান্ত সাক্ষৎকার নেবো। সবার ছবিসহ প্রাথমিক পরিচয় সম্বলিত একটি তালিকা আমাকে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমার খটকা লাগছিল। কেবল জয়ফুল নয় অন্যদের ছবির সঙ্গেও বয়সের কোনো সামঞ্জস্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

হবিগঞ্জের নিলুফার বয়স লেখা ২৫ বছর। অথচ ছবিতে মধ্যবয়স্ক এক নারী। সুনামগঞ্জের কাথৈরের বাসিন্দা বৃদ্ধাপ্রায় নিরাশা দাসের বয়স লেখা ৪৪ বছর! ধরেই নিয়েছিলাম গ্রামের বলতে গেলে নিরক্ষর এই নারীরা নিশ্চয়ই তাদের বয়সের হিসেব ঠিকমতো রাখেননি। যারা তালিকা তৈরি করেছেন তাদেরও ভুল হতে পারে। নানাভাবে প্রশ্ন করে আমাকেই সঠিক বয়স বের করে নিতে হবে।

ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সহায়তায় হতদরিদ্র এই নারীদের তালিকা তৈরি করা হয়েছিল। আর ছবিগুলো তুলেছেন খ্যাতিমান ফটোজার্নালিস্ট জিএমভি আকাশ। আমাদের একসঙ্গেই ছবিতোলা ও তথ্যসংগ্রের কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আমি আর তার সঙ্গে যোগ দিতে পারিনি। ছবিগুলো নিয়ে পরে আমি তাদের সাক্ষাৎকার নেই।

জয়ফুল বেগমকে আমার প্রথম প্রশ্নই ছিল আপনার বয়স কত? তার উত্তর ৩৫ বা ৩৬ বছর হবে মনে হয়। আমি তার সঠিক বয়স বের করার জন্য নানাভাবে প্রশ্ন শুরু করলাম। আপনার জন্ম কোন সালে?

যা ভেবেছিলাম, সাল বলতে পারলেন না। তবে এটুকু জানেন তার জন্ম স্বাধীনতার পর। অন্যপথ ধরলাম জানতে চাইলাম বিয়ে হয়েছে কোন বছর। সাল বলতে না পালেও কত বছর হয়েছে বলতে পারলেন প্রায় ২০ বছর। আমি হেসে জানতে চাইলাম তথন তাহলে আপনার বয়স কত ছিল? জয়ফুল সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন ১৪ বা ১৫ বছর হবে মনে হয়।

জয়ফুলের বাল্যবিবাহ হয়েছিল। ১৬ বছর বয়সেই মা হয়েছেন। তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা সাত। চার ছেলে তিন মেয়ে। একটি মাত্র সন্তান স্কুলে যায়। স্বামী আব্দুল মজিদের বয়স প্রায় ৫৫ বছর। পেশায় ক্ষেত মজুর। তার শরীরও ভগ্নপ্রায়।

মজিদ আজকাল তেমন পরিশ্রম করতে পারেন না। তাছাড়া হাওর এলাকায় বছরের প্রায় ছয় থেকে সাত মাস মানুষ পানিবন্দি থাকে। এসময় মানুষের কাজ থাকে না। সে সময়ে প্রায়ই তিন বেলা খাবার জোটে না পরিবারটির।

জয়ফুল নিজেও আয় করার চেষ্টা করেন কিন্তু নারীদের কর্মসংস্থানের তেমন সুযোগ নেই। তিনি হাঁস পালেন তবে হাঁসের ডিম বা মাংস কখনো খাওয়া হয় না। আর বিক্রি করে যা পান তা পরিবারের মোট আয়ে বেশি কিছু যোগ করে না। তাদের খাবারেও তেমন বৈচিত্র্য নেই।

সাধারণত তিন বেলাই ভাত খান। সঙ্গে কথনো ডাল অথবা শবজি। কোন কোন সপ্তাহে মাছ খেতে পারেন যদি হাওর থেকে ধরা হয়। আজকাল তাও হয় না। এলাকার প্রভাবশালীরা হাওর ইজারা নেয়। প্রায়ই তারা নির্ধারিত সীমানা ছাড়িয়ে প্রায় পুরো হাওরই দখলে নিয়ে নেয়। তাদের নিরাপত্তাকর্মীরা মাছ ধরতে দেয় না কাউকে। মাংস খাওয়া হয় কয়েক মাসে হয়তো একবার। তার ছেলেমেয়েদের ডিম, দুধ, ফল এসব খাওয়ানোর কথা তিনি চিন্তাও করতে পারেন না।

অন্য নারীদের কাহিনিও ভিন্ন নয়। কারো কারো অবস্থা আরো ভয়াবহ। কেউ বিধবা, কারো স্বামী শহরে গিয়ে আবার বিয়ে করেছে আর খোঁজ নেই। ছেলেমেয়ে তিন থেকে পাঁচ জন।

কিশোরগঞ্জের তিন সন্তানের জননী, স্বামী পরিত্যক্তা দুলারা বেগম জানান, কোরবানির ঈদে যখন অবস্থাসপন্ন পরিবারগুলো মাংস বিতরণ করে তখনই কেবল মাংস খেতে পারেন তারা। নিকলী বাজারে সপ্তাহে মাত্র একদিন গরু বা খাসী কাটা হয়। কারণ মানুষজনের ক্রয়ক্ষমতা নেই।

সরকারি ও আন্তর্জাতিক নানা উদ্যোগের ফলে গত শতকের নব্বই দশকের তুলনায় বাংলাদেশে পুষ্টি পরিস্থিতির অনেক অগ্রগতি ঘটেছে। তার পরও বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাধিক অপুষ্টির শিকার দেশগুলোর অন্যতম। ২০১৬ সালে ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকাউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেসন (আইপিসি)-এর কান্ট্রি কেস স্টাডিজ রিপোর্ট অনুযায়ী সিলেটের ছয় হাওর জেলায় মাঝারি খেকে চরম খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা দেখা যায়।

আর্ন্তজাতিক এই গবেষণা ফোরাম খাদ্যমন্ত্রণালয়ের ‘ফুড প্লানিং ও মনিটরিং ইউনিট’-এর সহায়তায় দুই দফায় বাংলাদেশের ২৮ টি জেলায় জরিপ চালিয়েছে। দ্বিতীয় দফায় সিলেট ও চট্টগ্রামের ১০ টি জেলায় পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী চট্টগ্রামের রাঙামাটি এবং সিলেটের সুনামগঞ্জে ভয়াবহ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা চিহ্নিত করা হয়েছে।

আইপিসির শ্রেণিবিন্যাসে এটি চতুর্থ পর্যায়ে ‘দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’ শ্রেণিতে পড়ে। জেলার ৭০ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীন এবং নারী এবং শিশুরাই মূলত ভুক্তভোগী। জয়ফুল, দুলারা এবং তাদের সন্তানরা আমকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তাদের দুরাবস্থা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলিত উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপের ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি-২০১২ শিরোনামে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, সেখানেও দেখা যায় বয়স অনুপাতে কম ওজনজনিত অপুষ্টি সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ। জন্মের পর থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা অপুষ্টির শিকার। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ শিশুর দৈহিক উচ্চতা এবং ৪১ শতাংশ শিশুর জন্মকালীন ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম।

জন্মের পর থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা অপুষ্টির শিকার। অপুষ্টির শিকার কিশোরীরা যখন বাল্যবিবাহের শিকার হয় এবং বিয়ের পাঁচ থেকে ছয় বছরের মধ্যে দুই থেকে তিনটি সন্তানের মা হয়ে যায় তখন তাদের স্বাস্থ্য জয়ফুলদের মতই হয়ে পড়ে।

আইপিসির প্রতিবেদনে এসব এলাকায় অপুষ্টির অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে অপরিমিত খাদ্যগ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থানের অভাব, একক আয়ের উপর নির্ভরতা এবং অশিক্ষা। পাশাপাশি অসুস্থতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, প্রাকৃতিক দুর্য়োগ এবং দুর্বল অবকাঠামোও এই অবস্থার জন্য দায়ী। আমি এর সঙ্গে যুক্ত করতে চাই বাল্যবিবাহ, স্বাস্থ্যসেবার অভাব ও অপরিকল্পিত-একাধিক সন্তান জন্মদান।

আর্ন্তজাতিক কৃষি উন্নয়ন তহবিল এবং বিশ্ব খাদ্য সংস্থার সহায়তায় তৈরি বাংলাদেশ দারিদ্র্য মানচিত্রেও এই জেলাগুলোর অবস্থান সবচেয়ে দারিদ্রপীড়িত অঞ্চলের অর্ন্তভূক্ত। হাওরে বসবাসকারী মানুষগুলোর কাছে সরকারি সেবা কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলোর ঋণসুবিধা পৌঁছায় না। ফি বছর আকস্মিক বন্যায় ফসল এবং বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধাও নেই। সাক্ষাৎকার দেয়া ২১ নারীর কেউ দুস্থ ভাতাও পান না।

এ বছর জুন মাসে আইপিসি একটি সতর্কবার্তায় বাংলাদেশ সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে দ্রুত এবং সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়েছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে জীবন ও জীবিকার উন্নয়নে বহুমূখী কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বাজার ও অবকাঠামোর উন্নয়ন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ক শিক্ষা জোরদার এবং আচরণ পরিবর্তন যোগাযোগের ব্যবহার।

বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ এই বিবৃতিতে আত্মসন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলবে না। দারিদ্র নির্মূল, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বা্স্থ্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রথম তিনটি অর্জন করতে হলে প্রত্যন্ত এই এলাকায় খাদ্যনিরাপত্তায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে নারীর সুস্বাস্থ্য এবং কর্মসংস্থান।। তাহলে পাঁচ নম্বর লক্ষ্য লিঙ্গসমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নও অর্জন করা যাবে।

লেখক: নলেজ ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশনস স্পেশালিস্ট, আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা

ইমেইল: [email protected]

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :