অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-১০

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৫৫

জনকথা থেকে বেরিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে রাতে আড্ডা মারার জন্য শাহজাহানপুরে এক বন্ধুর বাসায় যাবার পথে মালিবাগ মোড়ে দেখা হলো বান্না ভাইর সঙ্গে। সাংবাদিক আজিজুল হক বান্না জনকথায় লিখতেন। কিন্তু চৌধুরী মোহাম্মদ ফারুকের দাপুটে অনুপ্রবেশের পর বান্না ভাই একটু বেকায়দায় পড়েন। এক পর্যায়ে তিনি জনকথা থেকে নিজকে গুটিয়ে নেন। কিছু দিনের মধ্যে আর একটি ক্ষেত্র খুঁজে নিলেন বান্না ভাই। তিনি আমাকে পছন্দ করতেন। জনকথা ছেড়ে দেবার খবরে বললেন, ভালো করেছো! বললেন, চিন্তা করো না; কাল আসো, জমির ভাই একটি পত্রিকা বের করেছেন; আমি ওখানে আছি। কাল দুপুরের পর আসো। এই বলে কমলাপুরে পত্রিকার ঠিকানা দিলেন বান্না ভাই।

ঠিকানা মতো বিকেলে আমি গেলাম, বান্না ভাই আগে থেকেই ছিলেন। কিছুক্ষণ পর এলেন পত্রিকার মালিক কাম সম্পাদক জমির ভাই, জমির আলী। মুসলিম লীগ নেতা, বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফ-এর পান্ডা হিসেবে কুখ্যাতি আছে। তার পত্রিকার নাম ঝরণা। পাহাড়ি নয়, স্ত্রী নামে পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক ঝরণার। অন্যদের মধ্যে আগে থেকে বান্না ভাই ছাড়া আরও কাজ করতেন মাহবুবুর রহমান ও আরিফুর রহমান। তিনজনই বরিশালের, আমি যোগ হওয়ায় সংখ্যা দাঁড়ালো চার। তবে জনকথার অভিজ্ঞতায় প্রথম দিনই সতর্ক হলাম। মনে হলো, এ পত্রিকায়ও কোনো গোপন বিনিয়োগ থাকতে পারে; আর মালিক মুসলিম লীগ নেতা হওয়ায় পত্রিকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের বিষয়টি ছিল অনিবার্য।

সাপ্তাহিক ঝরণায় আমার প্রথম অ্যাসাইন্টমেন্ট ছিল কাজী কাদের ইন্টারভিউ করা। পরে জেনেছি, সে সময়ের প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদ মুসলিম লীগ নেতার পরিচয়ের বাইরেও কাজী কাদেরকে বিশেষ সম্মান করতেন রংপুরের লোক হিসেবে। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি হচ্ছে, কাজী কাদের উদার স্বভাবের ছিলেন। সাংবাদিকদের তিনি খুবই সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। এই সম্মান বা স্নেহ, যে কারণেই হোক, তিনি আমাকে একাধিকবার তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন। তার দাওয়াতের প্রথম দিনটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এর কারণ হচ্ছে, অতিথির প্রতি তার বিশেষ সম্মান। এর বিপরীত অভিজ্ঞতা হয়েছে বিএনপি নেতা ও এক সময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসের চৌধুরীর কাছ থেকে।

একদিন সন্ধ্যায় কাজী কাদের বললেন, কাল দুপুরে তোমার দাওয়াত, আমার সঙ্গে খাবে। সে সময় দুপুরে আমার খাবার অভ্যাস না থাকলেও দাওয়াত কবুল করলাম। বেলা পৌনে তিনটার দিকে গেলাম তার গুলশানের বাসায়, সম্ভবত বাসা ছিল ৮ নম্বর রোডে। আমাকে দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। বললেন, তুমি একটা মানুষ, তোমাকে দুপুরে বলেছি, এসেছো বিকেলে; আমার ডায়বেটিস!

তার রাগে আমার তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। ভাবলাম, তার ডায়বেটিকস, তো আমি কী করবো; আমি তো আর ডাক্তার না! ভাবতে ভাবতে তাকে অনুসরণ করে ডাইনিং হলে গেলাম। সেখানে টেবিলের দিকে নজর দিয়ে একটু খটকা লাগলো। বিশাল এক ডাইনিং টেবিলের প্রায় অর্ধেকটা নানান খাবারে সাজানো। দেখে ভালোই লাগলো। পরে ভাবলাম, আমার দেরিতে এতো চটার কী আছে, বাকি মেহমানরা তো আসেনি! এদিকে তিনি তখনও চটে আছেন। বললেন, বসো! একটু পরেই বুঝলাম, মেহমান কেবল আমি একা এবং তিনি প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিজে অভুক্ত থেকে। এ অবস্থায় নিজেকে বড়ই অপরাধী মনে হলো। এই অভিজ্ঞতা কারণে বিএনপি নেতা বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরীর দাওয়াতে আর দেরি করিনি। কিন্তু অভিজ্ঞতা হয়েছে নিদারুণভাবে বিপরীত।

উল্লেখ্য, বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার আলতাফ হোসের চৌধুরীর বংশের আর সকলে নামের সঙ্গে খলিফা ব্যবহার করেন, একমাত্র আলতাফ হোসেনের নামের সঙ্গে যুক্ত আছে চৌধুরী।

সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান আলতাফ হোসেন চৌধুরী সবেমাত্র রাজনীতিতে নেমেছেন। বরিশালের ছাত্রদলের এক নেতা জাফর, বিএম কলেছেন ভিপি থাকার সুবাদে ভিপি জাফর হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত, একদিন বললো, আলতাফ চৌধুরী রাজনীতি করবেন, আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দিতে; বড় ভাই হিসেবে আপনি একটু সহায়তা করলে আমার উপকার হয়। আমি জাফরকে পছন্দ করতাম। জাফরের অনুরোধে প্রথম দিন নিয়ে গেলাম মোস্তফা ফিরোজকে। চানাচুর থেকে মিষ্টি- সব কিছুই আলতাফ চৌধুরী আমাদের প্লেটে তুলে দিয়েছেন। তার অমায়িক ব্যবহার ও আতিথেয়তায় মোস্তফা ফিরোজ তো মুগ্ধ, মাখনের মতো গলে যাবার মতো অবস্থা। বিষয়টি আমার সঙ্গে শেয়ারও করলেন মোস্তফা ফিরোজ; কিন্তু আমার কি রকম যেনো একটু খটকা লাগলো। মনে হলো, নাটক। এই মনে হওয়ার প্রমাণ মিলতে অবশ্য বেশি সময় লাগেনি। এক বিকেলে আলতাফ চৌধুরী বললেন, কাল দুপুরে তোমাদের দাওয়াত।

কাজী কাদেরের বাসার ঘটনা মনে থাকায় এবার আর দেরি করলাম না। ঠিক কাঁটায় কাঁটায় বেলা একটায় আলতাফ চৌধুরীর বাসায় গেলাম আমি ও সন্তোষ শর্মা। কিন্তু দৃশ্যপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। হোস্ট অনুপস্থিত, দাওয়াতের কথা বাসার কেউ জানে না। টোনাটুনির গল্পের মতো দাওয়াত সত্ত্বেও অভুক্ত অবস্থায় ফিরতে হলো আলতাফ চৌধুরীর বাসার গেট থেকে। অবশ্য এতে আমার কোনো অসুবিধা না হলেও শর্মার হয়েছে। ক্ষুধা লাগলে তার শরীর কাঁপে। বললাম, ঠিক আছে তোমাকে আমি খাওয়াবো চলো, তবে শর্মাই বিল দিয়েছে। শর্মার সামনে আর কেউ বিল দিতে পেরেছে তেমনটি আমার অভিজ্ঞতায় নেই, কারো আছে কিনা জানি না।

সাপ্তাহিক জনকথার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আমার উদ্দেশ্য ছিল দ্রুত মুসলিম লীগ নেতা জমির আলীর সাপ্তাহিক ঝরণা ত্যাগ করা। এ পত্রিকায় যোগদানের উদ্দেশ্য ছিল, একদিনও বেকার না থাকা। আর এবার স্বভাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটু চোখ-কানও খোলা রাখলাম।

মাসখানেকের মধ্যে জানা গেল, সাপ্তাহিক ঝরণায় ফাইন্যান্স করেন এম এ জিন্নাহ নামে চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী। তখন তিনি জাহাজ কোম্পানি হেগি অ্যান্ড কোম্পানির মালিক হিসেবে পরিচিত। তার বাবা মাহফুজুল হক পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত কাছের লোক হিসেবে পরিচিত রাজনীতিক মাহফুজুল হকের গ্রামে পৈত্রিক বাড়ি ছাড়া আর কোনো বাড়ি ছিল না, এ বাড়িতেই তিনি ৯৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মাহফুজুল হকের ছেলে জাহাজ ব্যবসায় যখন মধ্য গগণে বিরাজ করছিলেন তখন তার রাজনীতি করার ঝোঁক চাপলো। এর প্রাথমিক ধাপ হিসেবে পত্রিকার স্লিপিং পার্টানার হতে চাইলেন। শুরু হলো সাপ্তাহিক ঝরণা দিয়ে। এর আগে সাপ্তাহিক খবরেও অর্থের যোগান দিয়েছেন। এ গল্প পরে শুনেছি এম এ জিন্নার কাছেই। তখন আমি সাপ্তাহিক সুগন্ধা কাগজ-এর প্রধান সম্পাদক ও উত্তরায় থাকি। তার ঢাকার বাড়িও ছিল আমার বাসার কাছে। রাজনীতির বাতিকে এ বাড়িসহ অনেক সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে এম এ জিন্নাহকে। যদিও তিনি মিরসরাই তথা চট্টগ্রাম-১ আসন থেকে ১৯৯১ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচনে তার আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী কমরেড দিলীপ বড়ুয়া ভোট প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বরাবরই চারশ’র নিচে থেকেছেন। এরপরও রাজনীতির খেলায় তিনি মন্ত্রী হয়েছেন শেখ হাসিনা সরকারে; আর বিত্ত-বৈভব তো এই কমরেডের পায়ের ভৃত্য। এর বিপরীতে রাজনীতিতে নেমে নিজের ও পৈত্রিক সম্পদ এবং ব্যবসা হারিয়েছেন এম এ জিন্না, শেষমেষ উঠেছেন গুলশানের একটি ফ্ল্যাটে।

সাপ্তাহিক পত্রিকায় বেশি আগানো যাবে না- এ বিবেচনায় এম এ জিন্নাহ দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। যেই চিন্তা সেই কাজ; পত্রিকার নাম দিলেন দৈনিক দিনকাল। তবে দিনকাল শেষতক তার থাকেনি। বহু কোটি টাকা খরচ করার পর পত্রিকাটি তিনি বেগম খালেদা জিয়াকে উপহার দিলেন স্বেচ্ছায় অথবা মনোনয়ন পাবার বিনিময়ে। এখনও দৈনিক দিনকাল ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে বিএনপির মুখপাত্র হিসেবে- এ কথা সবারই জানা। কিন্তু অনেকেই জানেন না, একাধিকবার এমপি হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতির বাতিকে প্রায় নিঃস্ব হয়েছেন এম এ জিন্নাহ।

ছবি: মুসলিম লীগ নেতা কাজী কাদেরের সঙ্গে

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মাই টিভি

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :