জলবায়ু সুরক্ষার লড়াই

মোহাম্মদ জমির
 | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:১০

সম্প্রতি মরক্কোর মারাক্কেশে হলো জাতিসংঘের ২২তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২২)। সীমান্তজুড়ে শরণার্থী সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতার ক্ষেত্রে এ সম্মেলন উদাহরণ হয়ে থাকবে। এছাড়া বৈশ্বিক উষ্ণতা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত বিষয়গুলোর জরুরিভাবে সমাধান দরকার। শুধু কার্বন নিঃসরণ কমানো নয়, এর ফলে যেসব সমস্যা তৈরি হচ্ছে তা প্রশমন করতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।

সম্মেলনের ফাঁকে অনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভায় প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে আকর্ষণীয় কিছু দিক তুলে ধরা হয়েছে।

২০১৬ সালকে যখন উষ্ণতম বছর ঘোষণা করা হচ্ছে, তখনি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নির্গত কার্বন-ডাই-অক্সাইডের নির্গমন গত তিন বছর বিশ্বজুড়ে একই অবস্থায় আছে। বিজ্ঞানীরা একে স্পষ্ট এবং অপ্রত্যাশিত বিরতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এটি বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় একটি পরিবর্তনকারী দিক হিসেবে চিহ্নিত করবে।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, চীনে কয়লা ব্যবহার কমানো হয়েছে। কার্বন নিঃসরণ ধীর গতির জন্য বিশ্বে সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত চীন এর কারণ হতে পারে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে, বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলো যখন তাদের কল-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে কয়লা, তেল এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কম করে তখন বিশ্বে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণও কম হয়। তবে এই তত্ত্বটি চ্যালেঞ্জ করেছেন অধ্যাপক লি কোয়েরি।

তিনি মন্তব্য করেছেন, বিশ্ব অর্থনীতি আসলে কার্বন নির্গমন কমাচ্ছে না বরং ৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার বক্তব্য অনুসারে, এই হ্রাসকে নজিরবিহীন বলা যায়।

কপ-২২ সম্মেলনের আলোচনায় বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে অনেকেই ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমনটা ভাবছেন তা আসলে তেমন সহজ হবে না।

পিলিটা ক্লার্ক উল্লেখ করেছেন, সামান্য আশার আলো দেখা দিয়েছে। কিন্তু উন্নত এবং উন্নয়শীল দেশগুলোর বেশিরভাগ অংশই অন্ধকারে রয়ে গেছে।

রেকর্ডে দেখা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কয়লার ব্যবহার কমানোর কারণে ২০১৫ সালে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এই প্রবণতা চলতি বছরে অব্যাহত থাকবে বলে বলা হয়েছে। ভারতে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ৫ শতাংশ বেড়েছে এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে কয়েক বছর কম থাকার পর এক দশমিক চার শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বের এক-চতুর্থাংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করে চীন। ২০১৪ সালে চীনে কার্বন নির্গমনের পরিমাণ ৫ শতাংশের বেশি। গত দশ বছর পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ বৃদ্ধি পেয়ে আসছিল দেশটিতে। তবে ২০১৫ সালে ০.৭ শতাংশ কমে আসে। আশা করা হচ্ছে, চীনে নতুন ব্যবস্থা গ্রহণের কারণে চলতি বছর আরও ০.৫ শতাংশ কমে আসতে পারে।

বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ২০১৫ সালে বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা প্রতি মিলিয়নে ৪০০ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আট লাখ বছরে এটি সবচেয়ে বেশি।

এবারের জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২২) আরেকটি কারণে উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালে কার্বনের ঘনত্বে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হবে বলে আশা করা হচ্ছে। শক্তিশালী এল নিনোর আবহাওয়ার কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্বাভাবিক তাপ ও শুষ্ক অবস্থা তৈরি হয়েছে। গাছ এবং অন্যান্য উদ্ভিদের কার্বন-ডাই অক্সাইডের শোষণ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে।

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ক্রমবর্ধমান কার্বন নির্গমনের প্রভাব মোকাবেলায় ছায়া ফেলেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়লাভ করায় এই ছায়া তৈরি হয়েছে। জলবায়ু বিষয়ে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্থিতিকে জটিল করতে পারে বলে অনেকের ধারণা। নির্বাচনের আগে ট্রাম্প বলেছিলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি একটি ‘ধাপ্পাবাজি’। তিনি প্রেসিডেন্ট হলে প্যারিস চুক্তি বাতিল করবেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রকে এ ধরনের চুক্তি ও জাতিসংঘকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান থেকে বিরত রাখবেন। এই অর্থ দিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নে কাজ করবেন। ট্রাম্প মনে করেন, এতে করে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। নির্বাচনের আগে তিনি মার্কিনীদের এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় কয়লাভিত্তিক শিল্পকে উজ্জীবিত করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন তিনি।

জলবায়ু কর্মীরা অবশ্য ইঙ্গিত দিয়েছেন, প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রকার অসমর্থন চুক্তির ২৮ ধারা অনুযায়ী মোকাবেলা করতে হবে। আর এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চার বছর লেগে যেতে পারে। যা ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টের মেয়াদের শেষের দিকে কার্যকর হবে। এ ধরনের পদক্ষেপ একটি তীব্র নেতিবাচক কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। যা সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের ক্ষমতাকালীন কিয়োটো প্রটোকলের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপের চেয়ে গুরুতর হতে পারে। কারণ প্যারিস চুক্তিতে চীন, ভারত এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো রয়েছে।

বিদায়ী জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ভয় দূর করার চেষ্টা করছেন। যাতে জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্থিতি মোকাবেলায় এগিয়ে যাওয়া যায়। বান কি মুন আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ট্রাম্প নির্বাচন প্রচারণার সময় কিছু কথা বলেছেন যেগুলো সম্ভবত জনপ্রিয় বাগড়ম্বরপূর্ণ উক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আর এগুলো তেমনভাবেই গ্রহণ করা উচিত।

বান কি মুনের প্রত্যাশা ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর জলবায়ু পরিবর্তনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে শুনবেন, বুঝতে পারবেন এবং এ ব্যাপারে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। তার কাছ থেকে একটি বিষয় আশা করা যায় সেটি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-কারখানায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে সম্ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে নিশ্চয়ই তিনি প্রশংসা করবেন।

কপ-২২ সম্মেলন চলার সময় গ্লোবাল কার্বন বাজেট চালু হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, বিশ্বের সব দেশকে কার্বন নির্গমনের নেতিবাচক বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।

এই প্রেক্ষাপটে বনায়ন, নতুন বন সৃষ্টি, কার্বন আটকানো ও জমা রাখা, বায়ু আটকানো (মাটিতে আংশিকভাবে জৈববস্তু পুড়িয়ে অতিরিক্ত কার্বন-ডাই অক্সাইড শুষে নেয়া) এবং বাতাস আটকানো (বায়ুম-ল থেকে কার্বন-ডাই অক্সাইড সরিয়ে নেয় এবং তারপর ভূগর্ভে সঞ্চিত করে) দরকার।

কার্বন আটকানো এবং বায়ুশক্তি উৎপাদনের সর্বশেষ পদ্ধটি সম্পর্কে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ এর জন্য প্রচুর খালি জায়গার প্রয়োজন হবে এবং এটি কম আয়তনের দেশগুলোর পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

এই সংকটময় মুহূর্তে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক প্রোগ্রামের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক সোলহেমের দুটি মন্তব্য সম্পর্কে বলা উচিত।

তিনি মন্তব্য করেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বিশ্বের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা অবশ্য ভুলে যাওয়া যাবে না। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অসুস্থতা এবং যুদ্ধ আঘাত হানছে। এখানে বিষয়টি বুঝতে হবে, এসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন জাতিসংঘের ১৯৫১ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী আইনি সুরক্ষার অধীন নয়। আর এটি আমাদের ব্যর্থতার স্মারক। মন্ট্রিল প্রটোকলের কিগালি সংশোধনীর উপরও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সেখানে ওজন স্তরের জন্য ক্ষতিকারক এইচসিএফসি ব্যবহার বন্ধে সম্মত হয়েছে। এটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হলে ০.৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পেতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য হ্রাস অনুধাবন করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। এটি জি-২০ শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আরও কার্যকর শক্তি দক্ষ গতির কানকুন চুক্তির ২০২০ সালের অঙ্গীকার পূরণ করতে এটি একটি পথ হতে পারে। তবে এটি এখন পর্যন্ত একটি রোলার কোস্টার রাইড। কিন্তু আশা করা হচ্ছে, মারাক্কেশের অধিবেশন এই প্রচেষ্টাকে আরও বেগবান করবে।

জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। অত্যন্ত গুরুত্ব ও প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

স্মরণ করা যেতে পারে, বাংলাদেশ গত ২১ সেপ্টেম্বর প্যারিস চুক্তির ‘অনুসমর্থন দলিল’ জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে হস্তান্তর করেছে। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত ১৯৭টি দেশের মধ্যে ১০৯টি দেশ প্যারিস চুক্তিকে আনুষ্ঠানিক সমর্থন দিয়েছে। ৪ নভেম্বর এটি বেগবান হয়। বাংলাদেশ নিজস্ব অর্থায়নে ৪০ কোটি ডলারের জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে।

১৬ নভেম্বর মরক্কোর মারাক্কেশে জাতিসংঘের ২২তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২২) শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে দেওয়া বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মিলিতভাবে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ও প্রশমনে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুতদের বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ, কার্যকর পানি শাসনের মাধ্যমে নিরাপদ খাবার পানি এবং স্যানিটেশন নিশ্চিত করা, জলবায়ু গবেষণায় নতুন বিশ্ব তহবিল গঠন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট মারাত্মক সমস্যা সমাধানে কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনায় উন্নত প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং বিনিময়ের বিষয়টি তুলে ধরেন। এ বিষয়গুলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে সহায়তা করবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর প্রয়োজনীয় অর্থায়নের গুরুত্বের বিষয়টি জাতিসংঘকে অনুধাবন করতে হবে। একশ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু অর্থ তহবিল সৃষ্টির জন্য অনুমোদিত রোডম্যাপের বিষয়টি এখানে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এছাড়াও প্রকল্প সৃষ্টি ও গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে এটি সাধারণ পদক্ষেপ হিসেবে প্রযোজ্য হবে। জবাবদিহিতা সৃষ্টিতে স্বচ্ছতা এখানে অপরিহার্য।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ইতিমধ্যে সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঋণের বদলে এখানে আর্থিক সহায়তার দরকার। এতে করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বেশি সহায়ক হবে।

মোহাম্মদ জমির : সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং প্রধান তথ্য কমিশনার

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :