নাফ তীরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মানবতা

প্রভাষ আমিন
 | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:৪৩

গত বছর তুরস্কের সাগর তীরে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা শিশু আয়লান কুর্দির মরদেহ প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল বিশ্ব বিবেককে। তেমনি আরেকটি ছবি রোহিঙ্গা শিশু তৌহিদের লাশ উপুড় হয়ে আছে নাফ নদীর তীরে থকথকে কাদায়। কিন্তু কোথায় আজ মানবতা, কোথায় বিশ্ব বিবেক? কয়েকদিন আগে একটি লেখায় লিখেছিলাম মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় বিশ্বের সবচেয়ে অভিশপ্ত মানব সম্প্রদায়। তাদের কোনো দেশ নেই, নাম নেই, পরিচয় নেই। কাগজে-কলমে বিশ্বে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের কোনো অস্তিত্বই নেই। এমনকি তাদের অস্তিত্ব নেই বিশ্ব বিবেকের তালিকায়ও। সবাই যেন চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করছে, কখন রোহিঙ্গারা নিশ্চিহ্ন হবে। তারপর তারা মুখ খুলবেন, আহা উহু করবেন।

এটা ঠিক আরাকানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কী করছে, তার পরিষ্কার কোনো ছবি নেই কারো কাছেই। কারণ মানবাধিকার কর্মী এবং সাংবাদিকদের সেখানে যেতে দেওয়া হয় না। অবাধ তথ্যপ্রবাহ না থাকায় যা হয়, রোহিঙ্গা ইস্যুতেও তাই হয়েছে। নানা গুজব, ভুল ও বিকৃত তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ওপর কথিত যেসব ছবি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে, তার অনেকটিই সঠিক ছবি নয়। পুরনো অন্য ঘটনার ছবি রোহিঙ্গাদের ওপর চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে আরাকানে কম নির্যাতন হচ্ছে এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। যেমন এই রোহিঙ্গা শিশুর ছবিটি নিয়েও কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন। পরে জানা গেল, না, এই শিশুটির ছবি ভুয়া নয়। শিশুটির নাম তৌহিদ। তার বাবার নাম জাফর আলম। তিনি মালয়েশিয়া প্রবাসী। তার মায়ের নাম ছেনোয়ারা বেগম। গত রোববার রাতে মিয়ানমারের বড়গজিরবিল এলাকা থেকে তৌহিদ, তার মাসহ আরো অনেকে নির্যাতন থেকে বাঁচতে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে চেয়েছিল। কিন্তু নদী পেরোনোর আগেই নৌকাটি ডুবে যায়। তাতেই ছবি হয়ে যায় তৌহিদ। কারো কারো অভিযোগ তৌহিদ মারা যাওয়ার পর তার মরদেহ কাদায় উপুড় করে রেখে ছবি তোলা হয়েছে। যদি হয়ও তাহলে তো তৌহিদের মৃত্যু মিথ্যা হয়ে যায় না। তার স্বজনদের বেদনা কমে যায় না। তৌহিদের উপুড় হয়ে থাকা মরদেহটি দেখে আমার বুক ফেটে আসা কান্নার দলাটা গলায় আটকে আছে, এমনকি ছবিটি নিয়ে সন্দেহ শোনার পরও। নিষ্পাপ তৌহিদ তো আমাদের এই রাজনীতির মারপ্যাঁচ, জাতি-ধর্মের হিসাব-নিকাশ, বিজিবি-বিজিপির প্রহরার বিষয়গুলো জানত না। তা হলে তাকে এভাবে মরতে হলো কেন?

মিয়ানমার সরকার কখনোই রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। তাদের নাগরিকত্ব নেই, ভোটাধিকার নেই, পাসপোর্ট নেই, শিক্ষার সুযোগ নেই। তারা আসলে অদৃশ্য সম্প্রদায়। দশকের পর দশক মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করে আসছে। সবাই আশায় বুক বেঁধে ছিল, গণতন্ত্র এলে বুঝি রোহিঙ্গারা বাঁচার অধিকার পাবে। অং সান সুচির হাত ধরে গণতন্ত্র এসেছে, তবে সে গণতন্ত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য। সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক রোহিঙ্গাদের ঘরে গণতন্ত্রের সুবাতাস পৌঁছায়নি। শান্তিতে নোবেল জয়ী অং সান সুচি এখন রোহিঙ্গাদের কাছে ভয়ংকর এক নাম। অং সান সুচি রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি কমিশন করেছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে। গত সপ্তাহে তিনি আরাকান রাজ্য পরিদর্শন করেন। আমরা আবার আশায় বুক বাঁধি। এবার বুঝি একটা সমাধান হবে। কিন্তু কফি আনান পরিদর্শন করেছেন সরকারের নির্ধারিত এলাকা। সেখানে তিনি সত্যিকারের নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের দেখা পাননি। চারজন কোনোরকমে কফি আনানের কাছে পৌঁছতে পেরেছিলেন, কিছু অভিযোগও করেছিলেন। কিন্তু কফি আনান যাওয়ার পর পর সে চারজনকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। আমরা আশাহত হই, যখন কফি আনান বলেন, আরাকানে সন্ত্রাস চলছে, গণহত্যা নয়। হা হা হা। একটি পুরো সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পরিকল্পিত আক্রমণকে যদি গণহত্যা না বলে, তা হলে কাকে বলে গণহত্যা। অং সান সুচি তার পছন্দের কফি আনানের কাছ থেকে বিশাল সার্টিফিকেট পেয়ে গেছেন। এই সার্টিফিকেট সামনে রেখে এখন তিনি নিশ্চিন্তে তৌহিদদের মারতে পারবেন, দেশছাড়া করতে পারবেন। মিয়ানমারে কী হচ্ছে তা দেখতে কফি আনানের আরাকানে যেতে হবে না, বাংলাদেশের টেকনাফে এলেই টের পাবেন। প্রতিদিন অসহায় রোহিঙ্গারা নদীতে ডুবে যাওয়ার ঝুঁকি, বন্দুকের গুলিতে মরে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে আসছে। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বললেই জানতে পারবেন সেখানে আসলে কী হচ্ছে। কী ঘৃণ্য কায়দায় চলছে গণহত্যা।

আরাকানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে। আর ভেতরে-বাইরে সবাই বাংলাদেশের ওপর চাপ দিচ্ছে, বাংলাদেশ কেন সীমান্ত খুলে দিচ্ছে না, কেন রোহিঙ্গাদের আসার সুযোগ দিচ্ছে না। কী আশ্চর্য আবদার। বাংলাদেশ কেন এই দায়িত্ব নেবে? তবে বাংলাদেশ সরকারকে অনেক ধন্যবাদ, তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে অনেক মানবিক আচরণ করছে। সীমান্ত খুলে না দিলেও সীমান্ত সিলগালাও করে রাখেনি। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীরা অনেককে ফিরিয়ে দিয়েছে এটা যেমন ঠিক, আবার গত ৯ অক্টোবর এই দফার সমস্যা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২১ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার সুযোগ পেয়েছে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদেরও আশ্রয় দিয়ে নিজেদের জঙ্গি সমস্যাকে আরো জটিল করে তুলবে না। গত ৯ অক্টোবর রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা একটি পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণের পরই এবার অত্যাচারের স্টিম রোলার চালানোর অজুহাত তৈরি হয়। বাংলাদেশ অবশ্যই নারী, শিশু, বৃদ্ধদের বিষয়টি মানবিকভাবে দেখবে। কিন্তু সীমান্ত খুলে দিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানাবে না। সত্তরের দশক থেকেই বিভিন্ন সময়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। সব মিলিয়ে এখন অন্তত ৭ লাখ রোহিঙ্গা আছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশ কেন বছরের পর বছর মিয়ানমারের অমানবিকতার দায় বহন করবে। বাংলাদেশকে মানবিক হতে বলার আগে বিশ্ব বিবেকের উচিত মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধে চাপ দেওয়া, এখুনি। নাফ নদীর তীরে তৌহিদের মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা লাশ জাগিয়ে তুলুক বিশ্ব বিবেককে, বিশ্ব মানবতাকে।

প্রভাষ আমিন : লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]

ঢাকাটাইমস/১১ডিসেম্বর/পিএ/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :