যাঁর আলোয় আলোকিত মানবতা

জহির উদ্দিন বাবর
| আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:৩০ | প্রকাশিত : ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:৪১

প্রায় দেড় হাজার বছর আগের কথা। রবিউল আউয়ালের এক প্রভাতে আরব-মরুর মক্কা উপত্যকায় জন্মেছিলেন আল্লাহর রাসুল (সা.)। যার নুরে বিদীর্ণ হয়েছিল গোমরাহি ও জাহেলিয়াতের পর্দা। সে প্রভাতের বিভায় অবিচার ও অনাচারের লু হাওয়া পরিণত হয়েছিল তওহিদের শীতল হাওয়ায়। বছরের পর বছর ধরে যে আরবভূমি তথা বিশ্বমানবতা পিপাসায় হাহাকার করছিল, তার ওপর বয়ে যায় রহমতের বারিবর্ষণ। যাতে সততা, নিষ্ঠা, ভ্রাতৃত্ব, হৃদ্যতা, ন্যায় ও সাম্য থেকে বঞ্চিত মানবতার রুক্ষভূমি পূর্ণ হয়ে ওঠে শ্যামল শোভায়। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির জন্মের সেই শুভমুহূর্তে আনন্দের বন্যা বইয়ে যায় সবখানে। সে খুশির বারতা পৌঁছে গিয়েছিল দিকদিগন্তে। মহানবীর (সা.) জন্মের শুভমুহূর্তের আলোড়িত সব ঘটনাই জানান দিচ্ছিল বিশ্বমানবতার গগনে প্রদীপ্ত সূর্যের উদয়ের কথা।

ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, সে রাতে কিসরা প্রাসাদের চৌদ্দটি পাথর খসে পড়ে। পারস্যের অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। সাবওয়াহ নদী শুকিয়ে যায়। চোখে পড়ার মতো তাৎক্ষণিক এসব প্রতিক্রিয়া ছাড়াও সৃষ্টিকুলে নানা ঘটনার সূত্রপাত হয়। এছাড়া অনারবের মর্যাদা, রোমের প্রভাব, চীনের অগ্রগতির ধাপগুলো ভেঙে পড়ার কারণও ছিল তাই। এ জন্যই স্তিমিত হয়েছিল অনিষ্টের নরক, কুফরির অগ্নিকুণ্ড, মূর্খতার দাবানল। অন্ধকারের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যাওয়া বসুন্ধরা ফিরে পেয়েছিল নতুন প্রাণের স্পন্দন। মানবতা পেয়েছিল জন্মের সার্থকতা।

তিনি ছিলেন রহমাতুল্লিল আলামিন। রাব্বুল আলামিনের ঘোষণা, “আমি আপনাকে সারা জাহানের জন্য একমাত্র রহমত করেই পাঠিয়েছি।”তার কৃপার বারিধারায় সিক্ত হয়েছিল সৃষ্টিকুলের প্রতিটি বস্তু। প্রিয়নবী হজরত মোহাম্মদের (সা.) করুণার কারণেই প্রাণিকুল তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তার ব্যক্তিত্বের প্রতি দুর্বল। তার নাম শুনলে ভক্তিতে গদগদ করে। কালের বিরামহীন চক্রে দেড় হাজার বছর লীন হয়ে গেলেও আজো তার অবদানের কথা জগদ্বাসীর কাছে ভাস্বর হয়ে আছে। এখনো দুনিয়ার প্রতিটি স্থানে প্রতি মুহূর্তে শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হচ্ছে তার বরকতময় নাম। নাতিদীর্ঘ কর্মময় জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ইতিহাসের পাতায় রক্ষিত আছে সযতনে। তার সর্বপ্লাবী ব্যক্তিত্বের কাছে দুনিয়ার তাবৎ কৃতিত্ব ও যোগ্যতা ধূসরিত। ঘোর শত্রুর কাছেও তিনি কীর্তিমান, অদ্বিতীয় এক মহাপুরুষ। চরিত্রে তার নেই বিন্দু পরিমাণ কালিমার আঁচড়। চারিত্রিক সার্টিফিকেটে স্বয়ং রাব্বুল আলামিন তাকে সর্বযুগের রেকর্ডসংখ্যক মার্ক দিয়েছেন।

কৃতিত্ব, অবদান এবং মানবিক যোগ্যতার আকর্ষণীয় দিকগুলোর সম্মিলনের কারণে প্রতিটি মুসলমানের হৃদয়ে নবী করিমের (সা.) প্রতি সহজাত টান রয়েছে। সর্বোপরি মহব্বতে রাসূলের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন ইমানের অনিবার্য দাবি। সে দাবি পূরণ করতে মুসলমান হিসেবে রবিউল আউয়ালে সবাই আন্দোলিত হই। প্রিয়নবীর প্রতি আমাদের ব্যাকুল অন্তরের আকুল অনুভূতির প্রকাশ ঘটে। মহব্বতে রাসূলের নতুন হাওয়া বইতে থাকে চারদিকে। তবে আমাদের মহব্বতের প্রকাশভঙ্গিটা যথার্থ কি-না তা বিবেচনার দাবি রাখে। অনুষ্ঠানের হিড়িক, চোখ ধাঁধানো চাকচিক্য এবং মহব্বতে রাসূলের সস্তা প্রয়োগের কারণে রবিউল আউয়াল আমাদের জীবনধারায় কোনোই পরিবর্তন আনতে পারে না। গতানুগতিক বহমান স্রোতে পণ্ড হয়ে যায় রবিউল আউয়ালের প্রকৃত চেতনা ও দাবি।

রবিউল আউয়ালের পয়গাম ও দাবি কী-সেগুলোও আমাদের কাছে আজ স্পষ্ট নয়। আনুষ্ঠানিকতার সব আয়োজনই আমরা সম্পন্ন করি, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য ও শিক্ষা, বাস্তবজীবনে নববী আদর্শের কোনো ছাপ রাখতে পারি না। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, “রবিউল আউয়াল এলে তোমারই গান গাই, রবিউল আউয়াল গেলে তোমায় ভুলে যাই।” মিলাদ, কিয়াম, জশনে-জুলুশ আর অনুষ্ঠানসর্বস্ব রবিউল আউয়াল আমরা যতই উদযাপন করি, প্রাপ্তির খাতায় শূন্যতা থেকেই যাবে। এ জন্য নবীর জন্ম-মৃত্যু দিবসের যথার্থ দাবি আদায়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া ইমানদীপ্ত চেতনার সর্বপ্রধান দায়িত্ব।

একবিংশ শতাব্দীর সমস্যাসঙ্কুল এই বিশ্বে বছর ঘুরে রবিউল আউয়াল আমাদের দুয়ারে হাজির। প্রিয়নবীর জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মাস হিসেবে এ মাসে নতুন প্রাণে উজ্জীবিত হওয়া সবার কর্তব্য। মুমিনের সামনে স্বচ্ছ আয়নার মতো নববী আদর্শের বাস্তবচিত্র স্থির হয়ে আছে। সে চিত্রের সঙ্গে নিজেদের জীবনের রূপটা পরখ করে দেখলেই প্রত্যেকের স্ব-স্ব পরিচয় উদ্ভাসিত হয়ে যাবে। অনুমান করতে কষ্ট হবে না, আমাদের জীবনচিত্র সে ছাঁচের কাছে কতটা বেমানান। আদর্শিক বিচারে নবী মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর (সা.) পথ ও পদ্ধতি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। আমি যে কেউই হই না কেন, আমার জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে রাসুলের জীবনের মধ্যে রয়েছে অনন্ত পাথেয়। অন্ধকারে আলোকদিশা পাওয়ার প্রোজ্জ্বল জ্যোতি একমাত্র তার আদর্শেই বিরাজমান। জীবনের সব ঝঞ্জাট, সংকট ও সমস্যাকে জয় করতে হলে রাসুলের জীবনাদর্শে ডাকে সাড়া দিতে হবে। কারণ অনির্বাণ এ আদর্শই হলো কিয়ামতাবধি আগত-অনাগত সব মানুষের মুক্তি ও সফলতার চিরন্তন অঙ্গীকার।

সংবাদটি শেয়ার করুন

ইসলাম বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :