মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে-২

আমিনুল ইসলাম
| আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:৪৩ | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:৩৭

চীনের কাছে প্রত্যাশিত সহায়তা পায়নি পাকিস্তান

সবাই জানে একাত্তরে চীন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। কিন্তু এটা অনেকের অজানা যে, পাকিস্তান তার পরম বন্ধু চীনের কাছ থেকে যতটুকু সাহায্য আশা করেছিল ততটুকু পায়নি। চীনের দরকার ছিল আমেরিকার বন্ধুত্ব এবং তাইওয়ানকে হটিয়ে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ লাভ করা। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন তার এই দুই স্বার্থ আদায় করেছিল সার্থকভাবে।

গণমানুষের কথিত বন্ধু চীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল তার রাজনৈতিক স্বার্থেই। ১৯৫৯ সালে দালাই লামাকে আশ্রয়দান এবং ১৯৬২ সালে চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের পর চীন-ভারত সম্পর্কের ঘোর অবনতি হয়। এ ছাড়া ১৯৫৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এই আন্দোলনের নেতা কে, তা নিয়ে ভারত ও চীনের দুই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু ও চৌ এন লাই প্রকাশ্য বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন। আবার, সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মূল বিষয়গুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং ১৯৬৯ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে সীমান্ত সংঘর্ষের পর চীন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্ম্পক একেবারেই ভেঙে পড়ে। তাই, ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বিপরীতে চীন যে তার বিপক্ষ বলয় পাকিস্তান ও আমেরিকার দিকে ঝুঁকবে, তাতে বিন্দুমাত্র আশ্চর্য হওয়ার কিছু নাই।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই চীন পাকিস্তানের সাথে সখ্য গড়ে তোলে। জেনারেল আইয়ুব খান তার ‘Friends, not Master’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ষাটের দশকের গোড়ায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভারতবান্ধব নীতির বড় কারণ ছিলো চীনের ভয়’। চীনা হুমকি মোকাবেলায় ভারত এক যোগ্য সহচর। এই বিশ্বাস সে সময়ের আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিকে প্রভাবিত করে। কঠোরভাবে ভারত-বিদ্বেষী আইয়ুব খান ভারতের প্রতি আমেরিকার উদার মনোভাবকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করার জন্য কাজে লাগান চীনকে।

এদিকে চীন আমেরিকার বন্ধুত্ব কামনায় ব্যাকুল। কারণ, তাইওয়ান শাসনকারী আমেরিকার তাঁবেদার শাসক চিয়াং কাইশেক মূল চীনের প্রতিনিধি হয়ে জাতিসংঘে প্রতিনিধিত্ব করছেন। জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভের একাধিক চেষ্টার পরও মার্কিন ভেটোর কারণে চীন সে সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয়। এ ব্যাপারে সমর্থন দিতে আইয়ুবের কাছে ব্যক্তিগত অনুরোধ নিয়ে আসেন পাকিস্তানের চীনা রাষ্ট্রদূত। তার জবাবে পাল্টা অনুরোধ হিসেবে আইয়ুব খান চীন ও পাকিস্তানের ‘বিতর্কিত’ সীমানা চিহ্নিতকরণে চুক্তি করার প্রস্তাব রাখেন।

চীনা রাষ্ট্রদূত জানালেন এই ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল। তার জবাবে আইয়ুব খান জানালেন ‘সীমানা চিহ্নিতকরণ যদি জটিল হয়, তাহলে জাতিসংঘে চীনের সদস্য হওয়াও জটিল’। আইয়ুব খান গর্ব করে তাঁর বইয়ে লিখেছেন- তাঁর যুক্তি তর্কে চীনা রাষ্ট্রদূত খুবই মুগ্ধ হয়েছিলেন। সবশেষে ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ও চীন তাদের সীমান্ত এলাকা চিহ্নিত করে একটি চুক্তি সম্পাদন করে।

চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সর্ম্পক উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখেন আইয়ুবের তরুণ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভূট্টো। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘Myth of Independence’ এ ভূট্টো সরাসরি কেনেডি প্রশাসনের ভারত ঘনিষ্ঠতাকে সমালোচনা করেন। তিনি যুক্তি দেখান, ‘আমেরিকা যদি চীনের উত্থানে ভীত হয়ে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠতা দেখায়, তাহলে সেটা পাকিস্তানের জন্য অবমাননাকর। পাকিস্তানের উচিত ভারত- আমেরিকা ঘনিষ্ঠতাকে ভেঙে দিয়ে নতুন পথ খোঁজা’। বলাই বাহুল্য সেই পথ হচ্ছে চীন।

জাতিসংঘে হুয়াং হুয়ার হুংকার

যা হোক, আমেরিকার সমর্থনে, পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় চীন তাইওয়ানকে হটিয়ে জাতিসংঘের সদস্য হয়। ১৯৭১ সালে চীন-আমেরিকা ঐতিহাসিক সমঝোতা হয়। ১৯৭১ সালেই পাকিস্তান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বহির্বিশ্বে প্রচার করে। চীন পাকিস্তানের প্রত্যেকটি বর্বরোচিত পদক্ষেপকে সোল্লাসে সমর্থন জানায়।

১৩ এপ্রিল ১৯৭১ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর একটি চিঠি নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হয়। চৌ-এন লাই চিঠিতে লিখেছেন, ‘আপনি (ইয়াহিয়া খান) এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন-ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণের দুঃসাহস দেখায়, তাহলে চীন ও তার জনগণ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে’।

পাকিস্তানের প্রতি চীনের সবচেয়ে বড় সাহায্য আসে জাতিসংঘ থেকে। সদ্য স্থায়ীসদস্যপদ প্রাপ্ত চীন নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে বিতর্কে অংশ নিয়ে জোরালো ভাষায় ‘তথাকথিত বাংলাদেশের’ প্রতি তীব্র ও কর্কশ ভাষায় আক্রমণ চালায়।

জাতিসংঘে চীনের স্থায়ী প্রতিনিধি হুয়াং হুয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ১৯৩১ সালে অধিকৃত চীনের মানচুকো প্রদেশে জাপান স্বাধীন রাষ্ট্রে গঠনের যে চেষ্টা চালায়, তার সঙ্গে তুলনা করেন। হুয়াং হুয়া অভিযোগ করেন “ভারত পাকিস্তানকে বিভক্তি করে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ’ গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে।” শুধু তাই নয়, তিনি বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানান, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন পাকিস্তানের পাশে থাকে।

জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রশ্নে বিতর্কে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের আপত্তির কারণে আলোচনায় অংশই নিতে পারেনি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরও চীন ‘বাংলাদেশ বিরোধীতা’ বন্ধ করেনি। শুধু চীনের ভেটো প্রয়োগের কারণে বাংলাদেশ স্বাধীনতার তিন বছর পর পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভে ব্যর্থ হয়।

পাকিস্তানের পক্ষে প্রতিশ্রুত তবে সামরিক সাহায্য আসেনি

চৌ-এন লাই আঙ্গীকার করেছিলেন, ভারত কর্তৃক আক্রান্ত হলে তিনি পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবেন। কিন্তু ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে, ভারত-পাকিস্তান সর্বাতুক যুদ্ধ শুরু হলে চীন সামরিকভাবে কোনো সাহায্যেই করেনি পাকিস্তানকে। ভারতের পূর্বাঞ্চলের নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর বিশাখাপত্তমে ফনা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস বিক্রান্ত’।

মহান নেত্রী ইন্দিরা গান্ধী এক গোপনবার্তায় পার্লামেন্ট মেম্বারদের অবহিত করেন ‘চীনকে ভয় দেখালেই কাজ হয়ে যাবে। কারণ, চীনারা জানে ভারতের বিরুদ্ধে চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে যুদ্ধ করে, তাহলে সোভিয়েত রাশিয়া বিরোধপূর্ণ সিনকিয়াং প্রদেশ দখল করবে, আর আমাদের সাহায্যের জন্য বিমানে বাহিনী পাঠাবে’।

ইন্দিরার অনুমান সত্য হয়েছিলো। তাই, বলতে পারি একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কেবল পাকিস্তানই পরাজিত হয়নি, তার সঙ্গে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও পরাজিত হয়।

লেখক: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

আগামীকাল পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের নেপথ্যে-৩

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :