অর্জন বনাম মনোনয়নের রাজনীতি এবং আমাদের গণতন্ত্র...

অনুপম মাহমুদ
 | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:৩৩

একটা সময় ছিলো যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল থাকায় মানুষ নিজেদের এলাকার বাইরে অন্য কাউকে চিনতো না বা জানতো না। নিজেদের জন্য ফসল ফলাতো ও নিজেদের প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতো।

এক একটি গ্রাম ছিলো তখন এক একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মতোই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিনিময়প্রথা চালু হবার পর গোত্র বা গ্রামের বাইরের মানুষ এর সাথে পণ্য বিনিময়ের পাশাপাশি একে অপরের সঙ্গে মিশতেও শিখে।

একে অন্যের প্রয়োজনকে পুঁজি করে পণ্য বা দ্রব্য উৎপাদন এবং তার বিনিময়য়ের মাধ্যমে নিজেদের ও অন্যের চাহিদা পূরণ করতে শুরু করে একদল অগ্রসর মানুষ। এভাবেই এই শ্যামল বাংলায় পা রেখেছে কখনো পর্তুগিজ, কখনো ফরাসি আবার কখনো বা ডাচ/ওলন্দাজরা।

আর এই সুযোগে এদেশের কিছু অসৎ ব্যবসায়ী, সমরবিদ আর ক্ষমতালোভী রাজ পরিবারের সদস্যদের যোগসাজশে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে একটি প্রহসনের যুদ্ধে নবাব সিরাজোদ্দৌলাকে পরাজিত করে ১৯০ বছর আমাদের গোলাম করে রেখেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তথা ব্রিটিশ রাজ। ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে রাজতন্ত্রের নামে উপনৈবেশিকতার যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছে আমার পূর্ব প্রজন্ম। ‘আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি, আমি আমার পূর্ব পুরুষের কথা বলছি, যার পিঠ রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো...’

শুধু ধর্মের নামে এক হাজার দুইশ কিলোমিটারের দূরে থাকা দুইটি ভূখণ্ড নিয়ে কিম্ভূতকিমাকার ‘পাকিস্তান’ নামের এক আজব রাষ্ট্রের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালে। যাদের ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবন নিয়ে ভাবনা কোনটাই এক ছিলো না। ২৪ বছরের ক্রমাগত শোষণে আমরা আমাদের পথ খুঁজে নিয়েছিলাম নিজেদের মতো করেই।

১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯ এর ধারাবাহিকতায় ১৯৭০ সালের নির্বাচন আর সেই পথ ধরে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ সর্বত্রই ছিলো গণতন্ত্র ও অধিকার অর্জনের সুতীব্র বাসনা। রাজনীতির বাঁক বদল হয় ১৯৭৫ সালের পট পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। সামরিক আদলে গণতন্ত্রের আমদানি হয় এই দেশে। উর্দি ছেড়ে রাজনীতিতিতে আসা স্বৈরাচারকে টেনে নামিয়ে ১৯৯০ সালে অর্জন করেছি গণতন্ত্র। হায় গণতন্ত্র...

গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র বলা হয় আব্রাহাম লিংকন এর সেই বিখ্যাত উক্তিকে ‘Government of the people, for the people and by the people’। সেটা হয়তো আমরা ভুলতে বসেছি। তৃণমূল থেকে নেতৃত্ব উঠে আসা এখন কল্পনা মাত্র। অথচ এই দেশেই সন্তোষ থেকে ভাসানী, টুঙ্গিপাড়া থেকে বঙ্গবন্ধুর মতো নেতা উঠে এসেছিলেন।

১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের জাতীয় নির্বাচন একক দল কেন্দ্রীক হলেও ২০০১ সাল থেকে জোটবদ্ধ নির্বাচনের ধারা চালু হয়। এই সুযোগে দেশে এলো ১/১১ এর বিভীষিকা। ২০০৮ সালের নির্বাচন দিয়ে তারা বিদায় নিলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে অর্ধেকের বেশি আসনে ভোটই হয়নি। সেই নির্বাচনকে ঠেকানোর প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে নির্বিচারে মানুষ পুড়িয়ে মারার পেট্রল বোমার আমদানি হয় রাজপথে।

ছাত্র, যুব, শ্রমিক, কৃষক, তাঁতী, মজুর এমনকি ধর্মীয় ও পেশাগত শ্রেণি আজ রাজনৈতিক বিভাজনে স্পষ্টতই বিভক্ত। ছাত্র রাজনীতির নামে চলছে মূল রাজনৈতিক দলের লেজুরবৃত্তি।

বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মৃত্যুর মিছিলের নেপথ্যে রয়েছে মূলত টেন্ডারবাজি। ছাত্র সংসদের নির্বাচন হচ্ছে না ৯০ দশকের পর থেকেই। তাই দেশে তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব, সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমেদ, মাহমুদুর রহমান মান্না তৈরি হচ্ছেন না। তার স্থান দখল করে নিচ্ছে তথাকথিত হাইব্রিড নেতৃত্ব...

মানুষের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বা শেখার জন্য কোন কোচিং সেন্টার নেই বা কোনগৃহ শিক্ষক এর খোঁজ পাওয়া যাবে না, যিনি নেতা তৈরি করেন। সময়ের প্রয়োজনেই সাধারণ, একেবারেই একজন সাধারণ মানুষ হয়ে উঠেন আমাদের পথপ্রদর্শক। নেতার নৈতিক স্থলন যে হয় না তা নয়, তার পরেও আমরা নেতা নির্বাচন করি, আবার নেতা যদি তার জনমত ধরে রাখতে ব্যর্থ হন, তবে আমরাও তাকে ছুড়ে ফেলে নতুন নেতা নির্বাচন করি। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য্য।

একজন নেতার কিছু যোগ্যতা থাকে বা থাকা প্রয়োজন। আমার খুবই সাধারণ ভাবনা বলে যে এই যোগ্যতাগুলো একজন নেতার থাকতেই হবে, যেমন ১. তিনি হবেন সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, ২. থাকবে কিছু সহজাত দক্ষতা, ৩. সদূরপ্রসারী চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী হবেন, ৪. দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন, ৫. বিরোধ নিষ্পত্তি করে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবেন সবাইকে, ৬. গুরুত্ব অনুধাবন করে কী করতে হবে সবার আগে সেটা বুঝতে হবে, ৭. নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলবেন, ৮. শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন, ৯. সততা থাকতেই হবে, ১০ নেতৃত্ব তৈরি করবেন যেন শূন্যতা না আসে।

মোদ্দা কথা হলো, নেতৃত্ব আদতে চাপিয়ে দেয়ার বিষয় নয় এটা অর্জনের ব্যাপার। বংশগতির ধারক ও বাহক নয় যে নেতার ছেলেই নেতা হবেন। এটা একটা বিশেষ যোগ্যতা ও জনসমর্থনের বিষয়। নেতার ছেলের যোগ্যতা থাকলে নেতা হবেন, না থাকলে ভালো কর্মী হবেন। কিন্তু এই যোগ্যতা এখন মূখ্য নয়, যদি আপনি মনোনয়ন ও একটা জুতসই পদ পেয়ে যান, সেটা নির্বাচনই হোক বা দলের যে কোন পর্যায়ের কমিটি গঠনই হোক...

গত উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক প্রাণহানি ও অনিয়ম হয়েছে। সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াটাও লক্ষণীয় ছিলো। এবারই প্রথম দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হয়। তাই আঞ্চলিকতার পরিবর্তে এখানে গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় রাজনীতি ও ইস্যু।

তৃণমূল থেকে নির্বাচন এর প্রার্থী বাছাই এর নামে যা হচ্ছে তা কতটুকু নিয়মতান্ত্রিক? আবার কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া প্রার্থী, সেটাই কি গণতন্ত্র? নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি দল মেয়র পদের জন্য তৃণমূল থেকে সম্মিলিত সিদ্ধান্তে তিনটি নাম পাঠালেও কেন্দ্র থেকে দেয়া হলো চতুর্থ একজনকে, যিনি সদ্য সাবেক মেয়র।

আবার সংসদে না থাকলেও দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের জোট তাদের প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে রীতিমত হিমশিম খেয়েছে। তিনজন সেরা প্রার্থী অপারগতা প্রকাশ করায় অপেক্ষাকৃত নবীন একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছেন।

মনোনয়নের নামে প্রধান দল বা জোটগুলোর পছন্দ বা কেন্দ্রের চাপিয়ে দেয়া নেতৃত্ব যে ভুল ছিলো তার প্রমাণ সদ্য সমাপ্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যাক হারে বিদ্রোহী প্রার্থীর বিজয়। এমনকি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঢাকায় ও ফরিদপুরের দুটি আসনে উত্তাপ ছড়িয়ে জয়লাভ করেছিলেন দুই বিদ্রোহী প্রার্থী। অর্থাৎ বলা যায় দলীয় মনোনয়ন এক্ষেত্রে সঠিক ছিলো না। এলাকায় অবস্থান না করেও মনোনয়ন/মার্কা হাতে নিয়ে অনেকেই নির্বাচনের মাঠে আসছেন, যা গণতন্ত্রের জন্য এবং তৃণমূলের নেতৃত্বের জন্য ভীষণ হতাশার।

এক সময় শিক্ষক এবং আইনজীবীদের প্রধান্য ছিলো নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে। এখন তাদের সংখ্যা কমে বাড়ছে ব্যবসায়ী। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে নারায়ণগঞ্জের সিটি করপো নির্বাচনের ৮০% প্রার্থী ব্যবসায়ী, ৭১% এসএসসি পাস করেননি আর আছেন অনেকেই যারা হত্যাসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। কিন্তু এই পরিসংখ্যান আমাদের ভাবায়। নির্বাচন যদি হয় বিনিয়োগ, তাহলে দুশ্চিন্তার কারণ আছে বৈকি...

এখন হচ্ছে জেলা পরিষদের নির্বাচন, এখানে ভোটার হচ্ছেন স্থানীয় পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়নের নির্বাচিত মেয়র, চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত আসনের নারী কাউন্সিলর। একপক্ষ বলছে এটা মৌলিক গণতন্ত্রের নতুন সংস্করণ, আবার অন্যপক্ষ বলছে এমপি সাহেবরা সবাই মিলে যদি প্রধানমন্ত্রী এমনকি মহামান্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করতে পারেন তবে জেলা পরিষদে নয় কেন?

থাক সেসব কথা, আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের চিন্তা ভাবনাও সাধারণ। জেলা পরিষদের নির্বাচনে ভোটারদের দলীয় অবস্থান যেহেতু চিহ্নিত, তাই কারা নির্বাচিত হতে যাচ্ছে, সেটা আঁচ করার জন্য জ্যোতিষী হওয়ার দরকার নেই, দরকার শুধু একটা মনোনয়ন...

তৃণমূল থেকে কেন্দ্র, সর্বত্র চালু করতে হবে নির্বাচনের মাধ্যমে নিজ দলের নেতা নির্বাচন, তবেই হয়তো মার্কা, ব্যাক্তি এবং পরিবারের বৃত্তের বাইরে আসবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র।

লেখক: অনুপম মাহমুদ

উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :