‘আমি বিরলতম মানুষদের একজন’

ঢাকাটাইমস ডেস্ক
 | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১০:৪৪

এবছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন মার্কিন গায়ক বব ডিলান। তবে তিনি পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যাননি। তাই তাঁর হয়ে পুরস্কারটি গ্রহণ করলেন সুইডেনের মার্কিন রাষ্ট্রদূত। পড়ে শোনানো হলো ডিলানের তীর্যক সম্মতি ভাষণ। ডিলানের সেই লিখিত ভাষণটি এখানে তুলে ধরা হলো:

‘‌শুভ সন্ধ্যা উপস্থিত সবাইকে। সুইডিশ আকাদেমি এবং সমাগত অতিথিদের শুভেচ্ছা। আমি দুঃখিত উপস্থিত থাকতে না পারার জন্য, কিন্তু শারীরিকভাবে না হলেও আমার মন, আত্মা আপনাদের সঙ্গেই রয়েছে!‌ আমি সম্মানিত বোধ করছি এই মূল্যবান পুরস্কারটি পেয়ে। কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি ‘‌সাহিত্য’-‌এ‌ নোবেল পেয়ে যাব!‌ শৈশব থেকেই জানি কোনো কোনো মহারথীরা এই পুরস্কার পেয়ে আসছেন। কিপলিং, বার্নাড ‘‌শ, টমাস মান, পার্ল বাক, অ্যালবেয়ার কামু, হেমিংওয়ে, এই সমস্ত নোবেল প্রাপকদের লেখনি পড়ে বড় হয়েছি। তাদের সাহিত্য স্কুল কলেজে পাঠ্য। এবার এই দিকপালদের তালিকায় আমার নাম যুক্ত হলো?‌ আমি বাকরুদ্ধ!‌ আমি জানি না তারা কখনও নোবেল লাভের কথা ভেবেছিলেন কি না, কিন্তু আমার স্থির ধারণা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে কেউ যখন কিছু সৃষ্টি করেন, সে গান কবিতা নাটক যাই হোক না কেন, মনে মনে নিশ্চয়ই নোবেল পাওয়ার গোপন স্বপ্ন বহন করেন, যা নিজেরাও জানেন না!‌

আমি যদি ঘূণাক্ষরেও জানতে পারতাম আমি নোবেল পেতে পারি তাহলে বলতাম, এর থেকে চাঁদের মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকাও সহজ!‌ আমি যখন জন্মেছি সেই সময় থেকে অনেক বছর ধরে সারা বিশ্বে নাকি এমন কাউকে পাওয়াই যায়নি যাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা যেতে পারে!‌ অতএব এটা ধরে নেয়া ছাড়া উপায় নেই যে আমি বিরলতম মানুষদের একজন!‌ আমি তখন রাস্তায়, যখন এই অবাক করা খবরটা পাই, বেশ কয়েক মিনিট সময় নিয়েছিলাম ধাতস্থ হতে!‌ প্রথমেই মনে পড়ল শেক্সপিয়রের কথা। তিনি নিজেকে তো নাট্যকার হিসেবেই গণ্য করতেন যতদূর জানি। তিনি যে ‘সাহিত্য‌’‌ রচনা করছেন এমন ভাবনা তাঁর মাথাতেও আসেনি নিশ্চয়ই!‌‌ তিনি লিখতেন মঞ্চের কথা ভেবে, তাঁর শব্দবন্ধ ছিল বলার জন্য, পড়ার জন্য নয়!‌

আমি নিশ্চিত ‘‌হ্যামলেট’‌লেখার সময় অনেকগুলো বিষয় মাথায় রেখেছিলেন তিনি, যেমন হ্যামলেটের চরিত্রে কোন অভিনেতা যথাযোগ্য, কীভাবে হ্যামলেট মঞ্চস্থ হবে, বা এর প্রেক্ষাপট কি ডেনমার্ক হলেই ভালো?‌ শেক্সপিয়রের সৃষ্টিশীলতা তাঁর প্রধান মূলধন হলেও কিছু নিতান্তই স্থূল বাস্তব সমস্যা নিয়েও ভাবতে হতো তাঁকে নিঃসন্দেহে!‌ যেমন, নাটকটি মঞ্চস্থ করার মতো যথেষ্ট পয়সাকড়ি যোগাড় হয়েছে?‌ বা, পৃষ্ঠপোষকদের জন্য নির্দিষ্ট আসনগুলো ঠিকঠাক তো?‌ মানুষের মাথার খুলি যোগাড় করা যায় কোথা থেকে ইত্যাদি। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি, মহান ‘সাহিত্য‌’ রচনা করছেন এমন ভাবনা শেক্সপিয়রের মাথায় কখনও আসেনি!‌

আমার কৈশোরে যখন গান লিখতে শুরু করি, বা যখন একটু আধটু পরিচিতি হয়েছে, তখন বড়জোর ভাবতাম আমার গানগুলো কফিহাউস বা পানশালাতে বাজবে, পরে আর একটু সুদূরপ্রসারী আশা ছিল যে কার্নেগি হল বা লন্ডন প্যালেডিয়ামেও অনুষ্ঠান হতে পারে!‌ এরপর সবথেকে বড় স্বপ্ন দেখার যে সাহসটুকু জুটিয়েছিলাম তা হলো, আমার গান রেকর্ড হবে, রেডিওতে বাজবে!‌ ব্যাস, এর বেশি আর কীই বা চাইতে পারি?‌ আমার গান শ্রোতাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাবে মানেই আমি যা করতে চেয়েছিলাম তাই করে যাওয়ার ছাড়পত্র জুটলো। করেও চলেছি বহুবছর ধরে।

কয়েকশো রেকর্ড রয়েছে আমার গানের, সারা বিশ্বে হাজারের ওপর কনসার্ট করেছি, আর সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু আমার সঙ্গীত। পৃথিবীর যেকোনো ভাষা যেকোনো সংস্কৃতির মানুষের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে আমার সঙ্গীত, আমি কৃতজ্ঞ। এখানেই একটা বিষয় বলতে চাই। আমি যেমন ৫০ হাজার মানুষের সামনে পারফর্ম করেছি, তেমনই ৫০ জন ব্যক্তির সামনেও গান গেয়েছি। আর তাই মনে হয়েছে দ্বিতীয় কাজটা ছিল বেশি কঠিন। কারণ বিশাল জনতার স্পন্দনে একটা তালমিল আছে, যা কমসংখ্যক মানুষের মধ্যে থাকে না। ৫০ জন মানুষের প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ জাহির করতে পারেন, নিজস্ব মতামত জানাতে পারেন, কিন্তু ৫০ হাজার জনতা একসঙ্গে স্রোতে ভাসে। নোবেল কমিটিও তো সীমিত সংখ্যক মানুষ নিয়ে!‌ তাঁরা যে আমার পুরস্কার পাওয়ার ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন এতেই আমি ধন্য!‌

তবে হ্যাঁ, শেক্সপিয়রের মতো আমারও সৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে ভীষণ কেজো বিষয়গুলো মাথায় ঘোরে। যেমন, আমার অমুক গানটির সঙ্গে যন্ত্রানুষঙ্গে থাকবেন কে, মনমতো স্টুডিও পাব তো, বা গানটা ঠিক পথে এগোচ্ছে?‌ আসলে কিছু বিষয় চারশো বছরেও বদলায় না!‌ কিন্তু সারা জীবনে একবারের জন্যও নিজেকে প্রশ্ন করিনি যে আমার গানগুলো কি ‘সাহিত্য‌’‌!‌ তাই সুইডিশ একাডেমিকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি, এই প্রশ্নটাকে খতিয়ে দেখে এমন চমৎকার উত্তর দেয়ার জন্য!‌’‌

(ঢাকাটাইমস/১৪ডিসেম্বর/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :