বাংলার বুদ্ধিজীবীদের লাশ ডোবায় পড়ে আছে

ফজলুল কাদের কাদেরী
| আপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৮ | প্রকাশিত : ১৪ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৩:৪৬

বৃহস্পতিবার ঢাকায় আত্মসমর্পণ করার আগে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাজধানীতে তখনো বেঁচে থাকা বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ৫০ জনেরও বেশিকে গ্রেপ্তার করে গুলি করে হত্যা করে। বিশিষ্ট বাঙালি নাগরিকদের নিশ্চিহ্ন করার এক সুচিন্তিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঝটিকা সামরিক অপারেশন চালিয়ে এ কাজটি করা হয়। কাজেই কমান্ডিং অফিসার জেনারেল নিয়াজীসহ পাকিস্তানি হাইকমান্ড এ ব্যাপারে পূর্ণমাত্রায় অবগত ছিল।

বুদ্ধিজীবীদের এই লাশ পাওয়ার ঘটনা ঢাকাতে উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলবে। এতে প্রতিশোধমূলক হত্যা ও দাঙ্গার সম্ভাবনা বাড়তে পারে। এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ও ভারতীয় সেনাদের মধ্যে সংঘাতও সৃষ্টি হতে পারে।

হত্যাকা-ের শিকার বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো পাওয়া যায় নগরের উপকণ্ঠের রায়েরবাজারে এক ডোবায়। আমি নিজে সেখানে ৩৫টি লাশ দেখেছি। লাশগুলো দেখে মনে হয়, চার থেকে পাঁচদিন আগে তাদের হত্যা করা হয়েছে। তবে আরও অনেককেই হয়ত এভাবে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণের খবর অনুযায়ী অনেকে ধারণা করছেন, নিহতের সংখ্যা ১৫০ পর্যন্ত হতে পারে।

ইউপিআইয়ের খবরে বলা হয়, নিহতের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান কার্ডিওলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. মুনীর চৌধুরী।

হত্যাকাণ্ডের স্থানটির অবস্থান ঢাকার মধ্যবিত্তদের আবাসিক এলাকায় ধানমন্ডি ছাড়িয়ে একটি ইটের ভাটায়। ডোবার মধ্যে ফুটে থাকা কচুরিপানার ফুলের শোভা সত্ত্বেও জায়গাটা অদ্ভুত রকমের বিরান। ঢাকার শত শত লোক জায়গাটা দেখতে আসে। তাদের অনেকেই নিজেদের আপনজনকে খুঁজছিলেন।

সম্ভবত মঙ্গলবার ভোরে এদের অপহরণ করা হয়। পাঞ্জাবি সেনাদের স্কোয়াড ঠিকানা ধরে ধরে হানা দেয় এবং সশস্ত্র পাহারায় আটককৃত নারী ও পুরুষদের নিয়ে যায়। তাদের সম্ভবত রায়েরবাজারের ইটভাটাতেই নিয়ে গিয়ে তৎক্ষণাৎ গুলি করা হয়। লাশগুলো যাতে ডোবায় পড়ে সে জন্য তাদের মাটির তৈরি গর্তের ধারে লাইন করিয়ে গুলি করা হয়।

বুদ্ধিজীবীদের লাশগুলো এখনো সেখানে পড়ে আছে। পচতে শুরু করা তাদের শরীরে জমেছে ধুলোর স্তর। বাঁধের ওপর এক জায়গায় বেওয়ারিশ কুকুরের টেনে তোলা এক কঙ্কালের নগ্নতা চোখকে ধাক্কা মারছিল।

অদ্ভুত আর শান্ত এক ভঙ্গিতে মানুষ ডোবাগুলো দেখছিল। এখানে তাদের বিক্ষুব্ধ মনে হচ্ছে না। অন্যত্র তারা ছিল উদ্দাম। কিন্তু এখানে তারা ধীরে হাঁটছে, কথা বলছে অস্ফুট স্বরে, যেন কোনো ক্যাথিড্রালে আসা টুরিস্টের মতো।

একটা ডোবায় দেখা গেল বেশ বড়সড় ভিড়। সেখানে লাশের স্তূপটাও সবচেয়ে বড়। ডোবার পাশে একজন লোক আহাজারি করছিল। মাফলার দিয়ে মুখ চেপে আসে সে। তার কণ্ঠনিঃসৃত শব্দকে মোয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনির মতো মনে হলো আমার কাছে।

লোকটার কাছে তার পরিচয় জানতে চাইলাম আমরা। সে বলল তার নাম আবদুল মালেক, ঢাকার একজন ব্যবসায়ী। সামনের পানিতে পাশাপাশি পড়ে থাকা তার তিন ভাই বদরুজ্জামান, শাহজাহান এবং মুলুকজাহানের লাশ সে শনাক্ত করতে পেরেছে। তারাও ঢাকায় ব্যবসা করত। পারিবারিক একটা ব্যবসা ছিল তাদের। আবদুল মালেকের আর কোনো ভাই নেই।

মালেক বলল, ‘মঙ্গলবার সকাল সাতটায় পাকিস্তানি সেনারা ওদের ধরে নিয়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে আমি সেদিন একটু আগেই বাইরে গিয়েছিলাম।

এই পর্যায়ে আমার সঙ্গীটি কাঁদতে শুরু করল, সে ঢাকার এক ছাত্র। নাম নাজিউর রহমান। সেই আমাকে পথ দেখিয়ে এই ইটভাটাতে নিয়ে এসেছে। নাজিউর তার বোনের স্বামীকে খুঁজছিল। অক্সফোর্ডের পিএইচডিধারী ড. আমিন উদ্দীন বেঙ্গল রিসার্চ ল্যাবরেটরিজের প্রধান। মঙ্গলবার সকাল সাতটায় পাকিস্তানি সেনারা তাকে ধরে নিয়ে যায় তারপর আর তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। রহমান বলল, ‘আমি দুঃখিত, আমাকে ওনার খোঁজ করতে হবে এখন।’ তার মাফলারও এখন মুখে ওঠে এসেছে।

আমি গতকাল মাত্র তিন ঘণ্টা ঢাকায় ছিলাম। এ খবরটা তখনো ছড়ায়নি বললেই চলে। জনতাকে উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, কিন্তু তারা ছিল সুশৃঙ্খল। তখনো তারা হাসিমুখে ভারতীয় সেনাদের হাত নেড়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিল এবং ইতস্তত এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছিল।

কিন্তু বেশকিছু গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে, বিশেষ করে রাতে। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থানরত সাংবাদিকরা জানিয়েছেন পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ। লোকজন অভিযোগ করছে, সীমান্তের ওপার থেকে আসা মুসলিম বিহারিরা বাঙালিদের হত্যা করতে পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য করছে।

আট মাস আগে আমি যখন যশোরে ছিলাম তখন ঠিক এ কারণেই সেখানে এক দাঙ্গা বাধে এবং বেশ কিছু বিহারিকে হত্যা করা হয়।

ঢাকার বুদ্ধিজীবীদের এ হত্যাকা- নিঃসন্দেহে যশোরে যা ঘটেছিল তার চেয়ে অনেক খারাপ ব্যাপার। কাজেই কিছু প্রতিশোধমূলক ঘটনা অনিবার্য।

নানা গুজব-গুঞ্জন আর অন্যান্য সাংবাদিকের মুখে এ ধরনের প্রতিশোধমূলক হত্যাকা-ের কথা শোনা ছাড়া আমি নিজে কেবল মুক্তিবাহিনীর দুজন তরুণের কথা বলতে পারি। তারা আমাকে গাড়ি চালিয়ে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল। পারভেজ মামা সালেক নামের তাদের একজন আমাকে গর্বভরে বলল, আগের দিন যে বিহারি খুঁজে বেরিয়েছে।

‘আমরা হঠাৎ কিছু গুলির শব্দ শুনতে পাই। আগেই জানতে পেরেছিলাম এই বেজন্মা বিহারিরা আমাদের ছেলেদের হত্যা করছে। আমরা ওদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলি। স্টেন হাতে আমাদের দুজন ওদের বাড়িতে ঢোকে।’ বিহারিরা বাগানের একটা গাছে গিয়ে উঠেছিল। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের কাকের মতো গুলি করে মারে। ‘অবশ্যই আমরা ওদের মেরেছি। ওরা এতদিন আমাদের মেরেছে।’

[ঢাকা থেকে দ্য সানডে টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক নিকোলাস টোমালিনের প্রতিবেদন। লেখাটি নেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশ জেনোসাইড অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড প্রেস’ বই থেকে। বইয়ের মূল সংগ্রহ ও সম্পাদনা : ফজলুল কাদের কাদেরী; বাংলা অনুবাদ সম্পাদনা : দাউদ হোসেন; সংঘ প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম সংস্করণ- ফ্রেবুয়ারি ২০০৩]

ফজলুল কাদের কাদেরী : প্রয়াত লেখক ও গবেষক

ঢাকাটাইমস/১৪ডিসেম্বর/এফকেকে/টিএমএইচ

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :