৪৪ বছর পর টিএসসির মঞ্চে উঠছেন দেশের প্রথম নারী ড্রামার

প্রকাশ | ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১১:৩০ | আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৮:১০

কাওসার শাকিল, ঢাকাটাইমস

বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার তিনি। মুক্তিযুদ্ধের পর পর গানের ব্যান্ড স্পন্দনের হয়ে ড্রাম বাজাতেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আবারও উঠছেন তিনি মঞ্চে। ৪৪ বছর পর আজ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে গানের তালে তালে ড্রাম বাজাবেন তিনি।  

তার নাম জর্জিনা হক। বয়স তখন ১৩ কি ১৪। বড় ভাইরা ব্যান্ডের দল বেধে গান গাওয়া শুরু করেছে। তাদের ব্যান্ডের নাম আইওলাইটস। সাব্বির কাদির সেই ব্যান্ডের ড্রামার। তাকে দেখেই শখ হলো ড্রাম বাজাবেন। কিন্তু পাবেন কোথায়? সেই ১৯৬৮ সালে কি আর আজকের দিনের মতন চাইলেই অনলাইনে অর্ডার দিলে ড্রাম চলে আসতো নাকি?

কিন্তু জর্জিনাকে দমায়, এমন সাধ্য কার? বাড়িতে বসে হাড়ি কুড়ি দিয়ে তৈরি করে নিলেন ড্রাম। হাতে তুলে নিলেন স্টিক। শুরু করলেন ড্রাম বাজানোর মকশো। মাঝে মাঝে বড় ভাইয়ারা প্র্যাকটিসের ফাকে চা খাওয়ার ব্রেক নিলে তিনি বসে যেতেন ড্রাম সেটটার সামনে। তবে সেটাও করতে হতো লুকিয়ে লুকিয়ে।

আস্তে আস্তে রপ্ত হয়ে গেলো ড্রামের বাজনা। তখন আর তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। রিতিমত ড্রামার হিসেবে নাম ছড়িয়ে পড়লো জর্জিনা হকের। এরই মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ হলো। দেশ স্বাধীন হলো। ১৯৭২ সালে বাংলা গানের ব্যান্ড হিসেবে সূচনা হয় ‘স্পন্দন’ এর। বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু হয় স্পন্দনের পথচলা।

জর্জিনা হকের বাবা তখনকার দিনের জেষ্ঠ্য মন্ত্রী। তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন, ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে খুবই পছন্দ করতেন। হক পরিবারের ছেলে মেয়েরা শেখ পরিবারের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে এক স্কুলে লেখা পড়া করতো। সেই হিসেবে এ বাড়ির লোকজনকে খুব ভালো করেই চিনতো ও বাড়ির লোকজন। সেই চেনা জানা থেকই শেখ কামাল জানতেন জর্জিনা ড্রাম বাজান, আর সেটা বেশ ভালোই রপ্ত করেছেন তিনি। জোর করে তিনিই তাকে স্পন্দনের ড্রামার হিসেবে বাজাতে বললেন।

তখন জর্জিনার বয়স কত হবে? ১৬ কি ১৭ বছর? সেই বয়সেই বাংলাদেশের প্রথম নারী ড্রামার হিসেবে মঞ্চে আত্মপ্রকাশ করলেন জর্জিনা। স্পন্দনের সাথে ড্রাম বাজাতে লাগলেন তিনি। খুব মনে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে করা কনসার্টটার কথা। ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাতে দেশের জন্য গান গেয়ে ১৬ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর উদযাপন করে স্পন্দন। সেই স্মৃতি জর্জিনা হকের সমস্ত অস্তিত্বে এখনো শিহরন তোলে।

তারপর অনেক বছর কেটে গেলো। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হয়েছেন। শেখ কামাল মারা গেলেন সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডে। স্পন্দনও আগের মতন রইলো না। জর্জিনার স্বামী সংসার সন্তান হলো। তিনি দেশ ছেড়ে গেলেন বিদেশে। সংসারের ডামাডোলে পড়ে, দেখতে দেখতে ৪৪ বছর কাটলো। কোনো ব্যান্ডে আর না বাজালেও জর্জিনা ড্রামের চর্চাটা চালিয়ে গেছেন ঠিকই। মাঝে মাঝে অবশ্য নানান জনের অনুরোধে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজিয়েছেন এর মধ্যে।

দেশে ফিরে এসছেন কিছুদিন হলো। এসে দেখেন সবকিছু বদলে গেছে। নতুন নতুন কত কত ব্যান্ড! কত বাহারি নাম তাদের! তাদেরই মধ্যে ‘ল্যাম্পপোস্ট’ ব্যান্ড এবার চাইছে জর্জিনা তাদের সাথে এক মঞ্চে উঠুক। তাও আজ, ১৫ ডিসেম্বর রাতে, টিএসসিতে! জর্জিনা জানালেন- জর্জ হ্যারিসনের বাংলাদেশ গানটার সঙ্গে ড্রামে তাল তুলবেন তিনি।

আর এ প্রস্তাবে রীতিমত আবেগ আর উত্তেজনায় টানটান হয়ে আছেন জর্জিনা হক! ড্রামস তো বাজাবেনই, সেই সঙ্গে মন ভরে গাইবেন বাংলাদেশের গান। জর্জিনা বললেন- ‘৪৪ বছর পর আবার সেই টিএসসিতে বাজাবো। মনে হচ্ছে একটা টাইম মেশিনে করে সেই ১৯৭২ এ ফেরত যাচ্ছি। তখন আর এখনকার মধ্যে তো অনেক পার্থক্য। জানি না লোকজন কেমন হবে, কেমন ভাবে নেবে আমাকে, এতোদিন পর বাজাবো। আমার এখনো মনে আছে সেদিন স্পন্দনের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল, আর আমি বোকা মেয়ের মতন মাথা নিচু করে ড্রাম টিউন করছিলাম। কামাল ভাই বললেন জর্জিনা মাথা উঁচু করে দাড়াও। কামাল ভাই যে আজ নেই, সাহস দেয়ারও কেউ নেই, টিএসসিতে খুব ফিল করবো এটা।’

আবেগ তাড়িত হয়ে যান জর্জিনা। বললেন, ‘আশা করি ভেঙে পড়বো না, অবশ্য বয়সওতো হয়েছে। জানি না কি হবে। কেঁদে না ফেলি আবার। কাঁদলে তো গানের বারোটা বেজে যাবে।’

ঢাকাটাইমস/১৫ডিসেম্বর/কেএস