মুক্তিযোদ্ধার বয়ান-১

৭ মার্চের পরই বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে

মুক্তিযোদ্ধা মনজুর মোরশেদ সাচ্চু
 | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১২:৩৪

বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসে মফস্বল শহর তথা একটা থানা সদরে আমাদের বাড়িটা ছিল স্বাধীনতা কমিটির একটা পদচারণের ভরসাস্থল। তার কারণ সেই সময় আমাদের পিতা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পাংশা থানা শাখার সভাপতি শুধু সেই সময়কার সভাপতি হিসাবেই নয় তিনি ছিলেন পাংশা থানা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দীর্ঘ ২৭ বৎসর তিনি ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। আর আমি ছিলাম পাংশা থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। স্বভাবতই ঐ সময় আমাদের বাড়িটা ছিল যে কোনো আন্দোলনের সুতিকাগার।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর কাছে কিছুতেই ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না। আন্দোলন দানা বেধে উঠছিল। ২৫ মার্চের আগ থেকেই কেন্দ্র থেকে যেসব কর্মসূচি পালন করার নির্দেশ আসত আমরা যথাযথভাবে সেটা পালন করতাম। তখনকার পাংশা থানার নির্বাচিত এম পিএ সর্বজন শ্রদ্ধেয় মোসলেম উদ্দিন মৃধা সাহেব তখন পাংশা থানা সদরে আমাদের বাড়িতেই অবস্থান করতেন।

কারণ পাংশা সদরে তার কোনো বাড়ি ছিল না। তিনি ছিলেন হাবাসপুর কাশিম বাজার রাজ হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক। আমি ঐ স্কুলেরই ছাত্র ছিলাম। তিনি শিক্ষকতা জীবনের আগ থেকেই ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। সে কারণে রাজনীতির সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সাধারণত মাধ্যমিক স্কুলে কলেজের মত কোনো ছাত্র সংসদ কোনো স্কুলে ছিল না। কিন্তু রাজনীতির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণেই স্যারের আগ্রহেই আমাদের স্কুলে ছাত্র সংসদ ছিল। সাধারণ ছাত্রদের ভোটে ছাত্র সংসদ নির্বাচিত হতো। আমি যখন দশম শ্রেণির ছাত্র তখন স্কুলের ছাত্র সংসদের নির্বাচনে জি,এস নির্বাচিত হই।

স্যারের সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ঐ স্কুল থেকে কোনো ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় নাই। আমি সংসদের জিএস থাকাকালে স্যারের সহযোগিতায় প্রথম ঐ স্কুল থেকে ম্যাগাজিন বের করি। তাতে স্কুলের ছবি, স্যারের ছবি, শিক্ষকদের ছবি ও ছাত্র সংসদের ছবিসহ বেশ কিছু ছবি দিয়ে সুন্দর অবয়বে হাবাসপুর কাশিম বাজার রাজ হাইস্কুলের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয়।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকেই আমরা বুঝতে পারলাম দেশে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ইতিহাসে আওয়ামী লীগের চেয়ে ছাত্রলীগের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। যে কোনো মিটিং মিছিলে আন্দোলনে ছাত্রলীগেরই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হতো। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল খুবই খারাপ। যোগাযোগের জন্য রেলই ছিল একমাত্র ভরসা।

টেলিফোন থানা সদরে ছিল না বললেই চলে। আমরা রাজবাড়ী তথা অন্য স্থানের সাথে যোগাযোগের জন্য রেলের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতাম। সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখার জন্য ২৪ ঘণ্টার জন্য রেলওয়ে স্টেশনে পর্যায়ক্রমে আমাদের ছাত্রলীগের কর্মীরা ডিউটি করত। পাংশা ডাকবাংলোতে আমরা সব এলাকার সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য একটা অফিস খুললাম।

রাজবাড়ী গোয়ালন্দ থানার তখন এমপিএ ছিলেন কাজী হেদায়েত হোসেন। তিনি সবসময় আমাদের সাথে রেলওয়ের টেলিফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতেন। তখনকার নির্বাচিত এমএনএ থাকতেন ঢাকায়। স্বাধীনতার ইতিহাসে বা আন্দোলনে তার কোন অবদান ছিল না। পরবর্তীতে বিতর্কিত ভূমিকার জন্য তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন।

৭ মার্চের পর ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত প্রতি ইউনিয়ন থেকে হাজার হাজার লোকের জঙ্গি মিছিল পাংশা থানা সদরে এসে হতো। সে এক ঐতিহাসিক ব্যাপার। এতদিন পর আজও চোখের সামনে ভাসে সেই মিছিলের গগণবিদারী স্লোগান। আমরা পুলকিত হতাম। প্রতিদিনই এই মিছিলের সামনে বক্তৃতা করতে হতো। দূরদূরান্ত থেকে আসা এই মিছিলের লোকজনকে আমাদের সাধ্যমত আপ্যায়নের চেষ্টা করতাম। এই ভাবেই ২৫ মার্চের সেই কালোরাত এসে গেল।

২৫ মার্চের রাতে একটু দেরি করেই বাসায় ফিরলাম। শুতেও একটু দেরি হলো। হঠাৎ রাত ২/৩টার দিকে পাংশা রেলওয়ে স্টেশনের ২ কর্মচারী হারিকেন নিয়ে আমাদের বাসায় এসে ডাকাডাকি শুরু করলো। আমিই উঠে দরজা খুলে দিলাম। উনারা বললেন- রাজবাড়ী থেকে রাজবাড়ীর এমপিএ সাহেব আপনাদের সাথে কথা বলার জন্য রাজবাড়ী স্টেশেনে অপেক্ষা করছেন। আমি আমাদের এমপিএ সাহেব ও আব্বাকে ডেকে উঠালাম। উনারা বললেন তুমি যাও, যেয়ে শুনে এস কী খবর। আমি উনাদের সাথে রেলওয়ে স্টেশনের দিকে রওয়ানা দিলাম। স্টেশনে যেয়ে দেখি রেলওয়ের স্টেশন মাস্টারসহ প্রায় সব কর্মচারীই টেলিফোনকে ঘিরে বসে আছেন। আমি যাওয়ার পরপরই রাজবাড়ী স্টেশনের সাথে যোগাযোগ করে দিলেন। অপর প্রান্ত থেকে কাজী সাহেবের গলা শুনতে পেলাম। উনি বললেন ঢাকায় পাক মিলিটারি অপারেশনে নেমে পড়েছে সারা ঢাকায় আগুন জ্বলছে। মিলিটারি রাজারবাগ পুলিশ লাইন পিলখানায় ইপির হেড কোয়ার্টার ও ইউনিভার্সিটির দিকে নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে। ঢাকা থেকে নির্দেশ আসছে সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে হবে। তোমরা পাংশা স্টেশনের দুই দিক থেকে কিছু রেললাইন উঠিয়ে ফেলো। আমি টেলিফোন ছেড়ে দিয়ে উপস্থিত রেলওয়ের কর্মচারী ভাইদের কাছে ঢাকার সমস্ত ঘটনা বললাম। বললাম আমাদের এখন সমস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিতে হবে। পাংশা রেলওয়ের দুই পাশ থেকে রেললাইন তুলে ফেলতে হবে। কর্মচারী ভাইরা প্রায় সবাই একযোগে বলে উঠলো এটা কোনো ব্যাপারই না। আপনি অল্প কিছু লোক যোগাড় করেন আমরা লাইনের নাট বল্টু খুলে দিচ্ছি। লোকজন লাইনের পাত টেনে একটু দূরে নিয়ে যাবে। দুই একজনের মনে মনে আপত্তি থাকলেও ঐ মুহূর্তে কিছু বলার সাহসই পেল না। আমি আশেপাশের দুই একজন ছাত্রলীগ কর্মীর বাসায় যেয়ে তাদেরকে ডেকে উঠিয়ে পাশের গ্রাম থেকে লোকজন ডেকে আনতে বললাম। আমি পুনরায় স্টেশনে এসে দেখি রেলওয়ের কর্মচারী ভাইয়েরা তাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে এসে লাইনের নাট বল্টু খোলা আরম্ভ করেছে। ঘণ্টা খানেক পর লোকজন আসা শুরু করলো। ইতোমধ্যে আমাদের ছাত্রলীগ ও অন্যান্য স্বাধীনতার পক্ষের বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্র কর্মীরা স্টেশনে আসতে শুরু করলো। খবরটা দাবানলের মত আশেপাশের গ্রামে রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে পড়লো। ভোরের আলো কিছুটা উজ্জ্বল হতেই দেখি স্টেশনের দুই পাশে হাজার হাজার লোক তারা শ্লোগান সহকারে রেল লাইন টেনে অনেক দূরে নিয়ে যাচ্ছে। সে এক অভূত দৃশ্য। আমরা যারা ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছি আর স্বাধীনতাকামী এই জনগণও স্টেশনের ঐ কর্মচারী ভাইদের অবদান কোনো অংশেই আমাদের চেয়ে কম নয়। ভোর হতেই হাজার হাজার লোকের সমাগমে স্টেশন তথা স্টেশন বাজার সয়লাব হয়ে গেল।

লোকজনের সাথে স্টেশনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি ভোর হয়ে গেছে হঠাৎ দেখি অল্প দাড়ি মুখে পায়জামা পাঞ্জাবি পরা এক সুন্দর ভদ্রলোক আমাদের এক কর্মীর সাথে করে আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। এসেই একটা কাগজ আমার হাতে দিলেন। কাগজটা পড়ে দেখি বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার ওয়ারলেস বার্তা। ঐ সুন্দর ভদ্রলোক ছিলেন ওয়ারলেসের সুপারিন্টেড। তখন আমাদের পাংশাতে বিরাট এন্টিনাসহ একটা ওয়ারলেস ছিল। আজ স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে অনেক বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। ঐ সুপারিন্টেড সাহেব যদি আজ বেঁচে থাকেন তবে তিনি সত্য জবাব দিতেন স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে অখ্যাত গলার ঘোষণাতে স্বাধীনতা আসে নাই। যার ঘোষণায় স্বাধীনতা এসেছিল আমার মুক্তিযোদ্ধাসহ সারা বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষ সেদিন একটি নামেই শ্লোগান দিতাম আর আমরা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা তার ভাবমূর্তিকে সামনে রেখেই অস্ত্র হাতে হানাদার পাক বাহিনীকে খতম করার শপথ নিয়েছিলাম।

২৫ মার্চের পর আমরা পাংশা ছাত্র যুবক অস্ত্রহাতে ট্রেনিং নিতে যারা আগ্রহী তাদেরকে নিয়ে একটা ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলাম। এক অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর তাদেরকে ট্রেনিং দিত। পাংশা থানা ট্রেনিংয়ের জন্য অস্ত্র দিয়ে আমাদের সক্রিয় সহযোগিতা করেছিল।

একদিন একটা ঘটনা ঘটলো। আমরা ডাকবাংলোতে বসে আলাপ করছি এমন সময় দুইজন বিদেশি সাংবাদিক একজন নারী একজন পুরুষ ডাকবাংলোতে এসে হাজির। ওরা ইন্ডিয়া বর্ডার পার হয়ে বাংলাদেশে আসছে। আলাপচারিতায় তারা জানতে চাইলো পাকিস্তানের মত একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনীর সাথে তোমরা কীভাবে যুদ্ধ করবে। তখন ডাকবাংলোর সামনেই আমাদের ছেলেদের ট্রেনিং চলছিল। আমি বললাম তোমরা দেখবে চলো। বাইরে এসে সাংবাদিকদ্বয়কে ট্রেনিংরত ছেলেদের সামনে নিয়ে গেলাম। ইপিআরএর সুবেদার মেজর সাহেবকে ঘটনা বলার সাথে সাথেই ট্রেনিংরত ছেলেদের লাইনে সোজা হয়ে দাঁড়াতে বললো এবং হুঙ্কার দিয়ে ছেলেদের বিভিন্ন পজিশনের কসরৎ দেখালো। মেয়ে সাংবাদিকটা বিভিন্ন পজিশনের ছবি তুলে নিল। আমি যখন ভারতের দেরাদুনে মিলিটারি একাডেমিতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছি তখন হলরুমে টাঙানো বিভিন্ন ছবির ভেতর ঐ পাংশার ডাকবাংলোতে বিদেশিনির তোলা একটা বড় আকারের ছবি দেখতে পেলাম। মনটা গর্বে ভরে গেল। আজও হাসি পায় সামান্য কয়েকটা বন্দুক, রাইফেল, বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম তা শুধু সম্ভব হয়েছিল আমাদের দৃঢ় মনোবল ও সাহসের জন্য।

হঠাৎ একদিন রাজবাড়ী থেকে সংবাদ এলো রেললাইন পুনঃস্থাপন করতে হবে। কুষ্টিয়াতে অবস্থানরত পাক বাহিনীকে আক্রমণ করতে হবে। কুষ্টিয়ার চারদিক থেকে ইপিআর আনছার পুলিশের যৌথ বাহিনী একযোগে আক্রমণ করবে। আসাদের রাজবাড়ী থেকে পুলিশ ও আনছারের একটা বাহিনী এতে যোগ দেবে।

পুনরায় ঐ একই কায়দায় আমরা রেললাইন পুনঃস্থাপন করলাম। পরের দিন ২টার দিকে রাজবাড়ী থেকে ট্রেন ছেড়ে আসবে। ঐ ট্রেনে পুলিশ আনছারের যৌথ বাহিনী কুষ্টিয়াতে পাক বাহিনীকে আক্রমণ করার জন্য যাবে। আমাদের পাংশা থেকে কিছু আনছার স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পোশাক পরে এসে হাজির। চারিদিকে সাজ সাজ রব। আমরা পাংশা থেকে একটা মেডিকেল টিম এদের সাথে যাওয়ার জন্য গঠন করলাম। ডাক্তাররা বললো আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে। আমি যাওয়ার প্রস্তুতি নিলাম।

বেলা ৩টার দিকে রাজবাড়ী থেকে আনছার পুলিশের যৌথ বাহিনীকে নিয়ে ট্রেনটি পাংশা স্টেশনে এসে পৌছলো। সে এক অভূত দৃশ্য। স্টেশনে লোকে লোকারণ্য। গগণবিদারী শ্লোগান। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো গ্রামের লোকজন ছুটে এসেছে এদের স্বাগত জানানোর জন্য কিন্তু কেউই খালি হাতে আসে নাই। কারও হাতে ডাক কারও হাতে রুটি কারও হাতে গুড় যে যেভাবে পেরেছে তাই সাথে করে নিয়ে এসেছে। আমরা এগুলি গ্রহণ করে ট্রেন আসার সাথে সাথেই একটা কামড়ায় উঠলাম। আমাদের পাংশা থেকেও কয়েকজন আনছার এদের সাথে যোগ দিল। আমি ও আমাদের মেডিকেল টিম ঐ খাদ্যের কামড়াতেই উঠলাম। পাংশা স্টেশনে উপস্থিত লোকজন ও আমার সহকর্মীরা হাত নেড়ে ও শ্লোগানের মাধ্যমে আমাদের বিদায় দিল। ট্রেন সামনের দিকে চলতে আরম্ভ করলো।

সামনের দিকে যে স্টেশনেই ট্রেনটি আসতে থাকলো সেখানেই অগণিত লোক সমাগম ও গগন বিদারী শ্লোগান। প্রায় লোকের হাতেই ডাব, রুটি, কলা, গুড়। আমরা প্রতি স্টেশন থেকেই আমাদের কামড়াতেই এসব খাদ্যগুলি গ্রহণ করলাম। এভাবে আমরা মাছপাড়া খোকসা কুমারখালী ও চড়ুইখোল স্টেশন পার হলাম। খোকসা স্টেশনে খোকসা থানার ওসি (আমাদের পাংশা থানার ছেলে) স্বয়ং বিদায় জানালো। কুমারখালী স্টেশনে তৎকালীন এমপিএ গোলাম কিবরিয়া সাহেব লোকজনসহ উপস্থিত থেকে আমাদের বিদায় জানালেন।

ট্রেনটি গড়াই ব্রিজ পার হয়ে আর অগ্রসর হলো না। কুষ্টিয়ার নেতৃবৃন্দ আমাদের এখানেই নামতে বললেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা ওখানেই নেমে পড়লাম। কুষ্টিয়ার নেতৃবৃন্দের সাথে আসা লোকজন আমাদের কামরা থেকে সমস্ত খাদ্য সামগ্রী নিচে নামালেন এবং এগুলো গন্তব্যস্থলে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। আনছার বাহিনী তাদের অস্ত্রসহ কামরা থেকে নিচে নামলেন এবং তাদের কমান্ডারের নির্দেশে দুই লাইন করে দাঁড়ালেন। তারা মার্চ করে সামনের দিকে এগুতে থাকলেন। তাদের পিছনে আমরা। সর্ব পিছনে আমাদের সাথে নিয়ে আসা খাদ্য সামগ্রী কুষ্টিয়ার কর্মীরা মাথায়, হাতে যে যেভাবে পারছে সেভাবেই নিয়ে আমাদের পেছনে আসতে থাকলো। কিছুদূর আসার পর আমরা কুষ্টিয়ার নেতৃবৃন্দের নির্দেশে বামদিকে মোড় নিলাম। বেশ কিছুদূর বাম দিকে আসার পর এক বিশাল বাগানবেষ্টিত এক বাড়িতে এসে উঠলাম। বাড়ির মালিক নিজেও ডাক্তার আজ এতদিন পর তার নামটা আমার মনে পড়ছে না। বাড়ির উঠানে বহু চেয়ার পাতা অমারা ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেখানে বসে পড়লাম। বাড়ির একটা ঘরে আনছার ভাইদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আর একটা কামরায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। কুষ্টিয়া নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ হলো উনারা বললেন- কিছুক্ষণের ভেতরই এক ইপিআর কমান্ডার আসবেন। উনি নির্দেশ দেবেন এই গ্রুপটি কোথায় আক্রমণ চালাবে। রাতের খাবারের ব্যবস্থা আগে থেকেই করা ছিল। সে এক ভূরিভোজের আয়োজন। হাত মুখ ধুয়ে আমরা সবাই এক সাথে খেয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ পর সেই ইপিআর কমান্ডার তার কিছু ইপিআর সদস্য নিয়ে আমাদের মাঝে এলেন। উনারা চুয়াডাঙ্গা ইপিআর হেড কোয়ার্টার থেকে এসেছেন। মূলত কুষ্টিয়ার যুদ্ধটা উনাদের নেতৃত্বেই সংঘটিত হয়েছিল।

উনি আমাদের আনছার বাহিনীর সমস্ত সদস্য ও আমাদের নিয়ে বললেন, অনেক আলোচনার পর ঠিক হলো পাশেই ওয়ারলেসে বেশ কিছু সংখ্যক পাক বাহিনী অবস্থান করছে ওখানেই আমাদের এই গ্রুপটা আক্রমণ চালাবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল আমাদের এই গ্রুপটার কাছে শুধু মাত্র হাত রাইফেল ছাড়া আর কোনো অটোমেটিক অস্ত্র নাই। পাক বাহিনীর হাতে আছে অত্যাধুনিক অস্ত্র। ঠিক হলো উনার সাথে আসা তিনজন ইপিআর আমাদের এই গ্রুপটার সাথে থাকবে। তাদের হাতে অটোমেটিক অস্ত্র আছে। উনি সমস্ত রকম ব্রিফিং দিয়ে চলে গেলেন। বলা হলো রাত তিনটার সময় যেখানে যেখানে পাক বাহিনী অবস্থান নিয়েছে সেখানে সেখানে একযোগে আক্রমণ করবে।

যদিও শরীর ক্লান্ত। তবুও ঘুম আসছে না। রাত আড়াইটার দিকে আমাদের গ্রুপটি রেডি হলো ওয়ারলেসের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। সবাইকে কোলাকুলি করে বিদায় দিলাম। সে দৃশ্য অনুভব করা যায় ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।

ঠিক রাত তিনটার সময় পাক বাহিনীর সমস্ত অবস্থানের উপর একযোগে আক্রমণ করা হলো। গুলির শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকলো। ভোর ৫টা পর্যন্ত গুলিবর্ষণ হতে থাকলো। পাক বাহিনীও পাল্টা জবাব দিতে থাকলো। ভোর হওয়ার সাথে সাথে গুলির শব্দও কমে আসতে থাকলো। আমরা আর ঘরের ভিতর বসে থাকতে পারলাম না বের হলাম কোথায় কী ঘটেছে দেখার জন্য। প্রথমেই হাঁটতে হাঁটতে গেলাম ওয়ারলেসের দিকে। তখন আর গুলির শব্দ নাই। ওয়ারলেসের দূর থেকেই দেখতে পেলাম ওয়ারলেস বিল্ডিং এর পাশেই আমাদের আনছার ভাইয়ের এক জনের লাশ পড়ে আছে। আমাদের আনছার বাহিনী ও ঐ তিনজন ইপিআর সদস্য চারদিকে ঘিরে পজিশন নিয়ে আছে। আমাদের কাছে যেতে নিষেধ করলো। থেমে থেমে ওয়ারলেসের ভেতর থেকে গুলি আসছে। বেলা উঠার পর দেখি ওয়ারলেসের চারদিকে হাজার লোক। গুলির শব্দও আর নেই। আনছার ইপিআর কেউ আর লোকজনকে ঠেকাতে পারছে না। সবারই গন্তব্য ওয়ারলেসের ভেতর। আমরাও ওয়ারলেস কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়লাম। ঐ আনছার ভাইয়ের লাশের পাশে গিয়ে দেখি আমাদের পাংশা স্টেশন থেকে যে কয়জন আনছার এই বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল তাদেরই একজন এই স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রথম শহীদ হয়েছেন। নাম দিয়ানত। পাংশা মৃগী এলাকায় বাড়ি পরে মৃগীতে তার নাম অনুসারে শহীদ দিয়ানত নামে একটা কলেজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আর কিছুই দেখা হয়ে উঠলো না। আমরা দিয়ানতের লাশ নিয়ে ঐ বাগান বাড়িতে চলে এলাম। পরে শুনলাম ওয়ারলেসের ভেতরে কয়েকজন পাক সেনার লাশ রয়েছে। অনেকে পালিয়ে গেছে। আবার কেউ পথে ধরা পড়েছে গুজবের পর গুজব আমাদের কানে আসতে থাকলো। আমাদের আর সেদিকে নজর নাই। এখন আমরা লাশ নিয়ে ও আমাদের বাহিনী নিয়ে পাংশা তথা রাজবাড়ীর উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিলাম। কুষ্টিয়া স্টেশনে লোক পাঠালাম রাজবাড়ীর সাথে যোগাযোগ করে রাজবাড়ী থেকে ট্রেন আসার জন্য। ঘণ্টা দুয়েক এর ভেতরই ট্রেন এসে গেল। কুষ্টিয়ার যুদ্ধে জয়লাভ করে আমরা বীরদর্পে ট্রেনে আবার গন্তব্যের দিকে রওয়ানা দিলাম। কিন্তু সব আনন্দই ম্লান হয়ে গেল আমাদের এক সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আনছার ভাইয়ের অকাল মৃত্যুতে।

পথে পথে অগণিত মানুষের ভীড়। স্টেশনে স্টেশনে লাশ দেখার জন্য মানুষের আকুল আগ্রহ। গগনবিদারী শ্লোগান আনছার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। এমনই এক পরিবেশে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে পাংশা স্টেশনে এসে পৌঁছলাম।

আবার শুরু হলো পাক হানাদের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতির ট্রেনিং। এবার গোয়ালন্দ ঘাটে ব্যারিকেড দিয়ে রাখতে হবে যাতে আরিচা থেকে কোনো পাক সেনার দল নৌপথে এদিকে না আসতে পারে। আমাদের পাংশা থেকেও কিছু আনছার এই ব্যারিকেডে অংশ নেওয়ার জন্য গোয়ালন্দ রওয়ানা হলো। আমরা পাংশাতেও রাতের বেলা পাহারা দেওয়ার জন্য একটা দল গঠন করলাম যাতে পাক বাহিনী পাংশাতে প্রবেশ করতে না পারে। আজও সেই প্রস্তুতির কথা মনে হলে মনে মনে হাসি পায়। আমাদের হাতে ছিল কয়েকটা একনলা দোনালা বন্দুক, লাঠি, দা, কুড়াল এইসব অস্ত্র।

দেরাদুনে ট্রেনিং এর সময় ইন্ডিয়া সেনাবাহিনীর অফিসারের মুখে যখন পাক বাহিনীর শক্তির কথা শুনতাম তখন মনে হতো সেদিনের সেই একনলা দোনালা বন্দুক নিয়ে সেই বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া একটা হাসির খোরাক ছিল মাত্র। তবে আমাদের মনোবল ছিল প্রচুর। যার ফলে এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে একটা বিশ্বসেরা সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা আমাদের কাছে কোনো ব্যাপারই মনে হতো না।

হঠাৎ সংবাদ এল আরিচা থেকে পাকবাহিনী গোয়ালন্দর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সামনের দিকে গোলাবর্ষণ করতে করতে সবকিছু তছনছ করে দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছে। ওদের গোলার আঘাতে আমাদের বাহিনী আর তাদের পজিশনে থাকতে পারছে না। পাংশার স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিও প্রকাশ্যে দল বেধে চলাফেরা করছে এতদিন তারা ঘাঁপটি মেরে ছিল। পাংশার যারা বাজারে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা উড়াতো। ডাকবাংলোতে আমরা কেন্দ্রীয় ভাবে একটা বড় পতাকা উঠাতাম। গুজবের পর গুজব ছড়াতে থাকলো। হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ল গোয়ালন্দ প্রতিরক্ষা বুহ্য তছনছ করে দিয়ে পাক বাহিনী রাজবাড়ীর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সংবাদ এলো পাংশা স্টেশন বাজারে এক মৌলানা তার নিজস্ব দোকানে টাঙানো স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে এবং স্বাধীনতাবিরোধী কিছু লোক পাকিস্তানের পক্ষে শ্লোগান দিচ্ছে। আমরা তখন ডাকবাংলোতে নেতৃস্থানীয় ছাত্র নেতারা বসে পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছি এমন সময় স্বাধীনতাবিরোধী এক লোকের নেতৃত্বে একদল লোক ডাকবাংলোতে এসে উপস্থিত। তার উগ্র মেজাজ এখনই স্বাধীন বাংলার পতাকা নামিয়ে ফেলতে হবে। নইলে পাক মিলিটারি পাংশার সব ঘর-বাড়ি দোকানপাট জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেবো। আমরা না নামালে তারাই পতাকা নামিয়ে দিবে। এক পর্যায়ে তার সাথে আমার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হলো। কিন্তু ওর এমন সৎ সাহস নাই যে পতাকার গায়ে হাত দেবে। ডাকবাংলোর চত্বরে লোক সমাগম বাড়তে থাকলো। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন মত। আমাদের সহকর্মীদের ভেতরও অনেকে ডাকবাংলো ছাড়তে থাকলো। পরিস্থিতি তখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তবুও স্বাধীনতাবিরোধীদের ভেতর এমন মনোবল নাই যে আমাদের স্বাধীন পতাকার গায়ে হাত দেয়। এমনি পরিস্থিতিতে পাংশার একজন উঠতি গণ্যমান্য ব্যক্তি যে মনে প্রাণে পাকিস্তানের পক্ষে কিন্তু উগ্র প্রকৃতির নয়। বয়সে আমার অনেক ছোট কিন্তু সে আমাকে ভাই বলে ডাকতো। সে এসে ডাকবাংলোর এক কোণায় ডেকে নিয়ে গেল। আমাকে বুঝিয়ে বললো এই পরিস্থিতিতে জেদ করা ঠিক হবে না। পতাকাটা নামিয়ে ফেলানোই সমীচীন হবে। আমি তাকে বললাম এত লোকের সামনে আমরা পতাকা নামাতে পারবো না। আপনি লোকজনকে ডাকবাংলো থেকে নিয়ে যান। আমরা আমাদের পতাকা নামিয়ে নেব। উনি সমস্ত লোক ডাকবাংলো থেকে নিয়ে গেলেন। ডাকবাংলোতে তখন আমি আর জিল্লুল হাকিম দুজনে আছি। আরও দু একজন ছিল কিনা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। নিজেদের ভেতর আলাপ করছি এমন সময় আমার আব্বা ও জিল্লুল হাকিমের আব্বা দুজনে ডাকবাংলোতে এলেন। তারা বললেন- আমরা তোমাদের আল্লাহর উপর ছেড়ে দিলাম তোমরা ভারতে যেয়ে অস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে দেশ স্বাধীন করে ঘরে ফিরবা। আমরা মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি যাতে তোমরা কামিয়াব হও। দুজনের ভেতর খুবই বন্ধুত্ব ছিল। যাবার সময় দুজনই আমাদের মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে গেলেন। জিল্লুর আব্বা স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ই মারা যান। উনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। আব্বা স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে গেছেন। উনাদের দোয়ার বরকতেই আমরা দুইজনই স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা গোয়ালন্দ মহকুমার নেতৃত্ব দিয়েছি। জিল্লু ছিল গোয়ালন্দ মহকুমা মুক্তি বাহিনী প্রধান আর আমি ছিলাম গোয়ালন্দ মহকুমা মুজিব বাহিনী প্রধান। (চলবে.....

লেখক- গোয়ালন্দ মহকুমা মুজিব বাহিনীর প্রধান

(জন্ম ১জুন ১৯৫১-মৃত্যু ২১জুলাই ২০১৫)

অনুলিখনঃ সাজ্জাদ বাবু

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :