দিবসগুলো ক্যালেন্ডারের সিঁড়ি ভেঙে হৃদয়ের ঘরে প্রবেশ করুক

আরিফ রহমান
| আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৫৭ | প্রকাশিত : ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৫:৪৬

স্বাধীনতার ৪৫ বছরের দ্বারপ্রান্তে আমরা। ৪৫ বছর কম সময় নয়। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এসে যদি ভাবতে বসি একাত্তরের যুদ্ধের প্রায় ৩০-৪০ লাখ মানুষ মারা যায়, ৪-৬ লাখ মা বোন ইজ্জত হারায়, কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে দেশ ছাড়ে, দেড় কোটি মানুষের বাড়িঘর পোড়ে। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করেন মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে বড় কোন জিনিস আমরা হারিয়েছি? আমি একটুকুও না ভেবে বলে দেবো আমাদের বুদ্ধিজীবীদের। আসুন একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

পৃথিবীব্যাপী নিয়ম হচ্ছে যুদ্ধে পরাজিত পক্ষের সেনা অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা এবং বেতন পেনশন ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা। একাত্তরের যুদ্ধে পরাজিত জেনারেল নিয়াজি এবং তার অধীনস্থ অধিকাংশ অফিসারদের বেলাতেই এই নিয়ম খাটানো হয়। তবে একজনের বেলায় ব্যাতিক্রম দেখা যায়। সেই ব্যাতিক্রম একজনের নাম মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে পাকিস্তান সরকার সম্মানের সাথেই বহাল রাখে তাদের ছায়াতলে। ১৯৭২ সালে তাকে পাকিস্তানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘ফৌজি ফাউন্ডেশন’-এর পরিচালক করা হয়। পাক্কা ১০ বছর পাকিস্তানের সবচাইতে বড় এই সামরিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক করে রাখা হয় এই ফরমান আলীকে।

কেউ কি ধারণা করতে পারেন আর সব অফিসারদের বাদ দিয়ে ফরমানের ওপরেই কেন পাক বাহিনীর এই ভালোবাসা? উল্লেখ্য জেনারেল নিয়াজিকে কিন্তু চাকরি পেনশন সবকিছুই হারাতে হয়েছিলো বাংলাদেশের মাটিতে পরাজয় বরণ করার অপরাধে।

পাকিস্তানের ফরমান প্রীতির কারণ ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যা...

একাত্তরে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের রক্ত পরাজিত পাকিস্তানীদের দগদগে ঘা-এর ওপর কিছুটা শান্তির মলম হিসেবে কাজ করে। তারা বুঝতে পারে এই জাতির ‘এথনিক ক্লিনজিং’ (জাতিগত নিধন)-এর জন্য যেই গণহত্যা তারা পরিচালনা করেছিলো সেই প্ল্যান অন্তত ফরমানের হাত ধরে আংশিক হলেও সফল হয়ে উঠবে। এজন্যই অন্য অফিসারদের চাকরিচ্যুত করা হলেও জেনারেল ফরমানের জন্য ছিলো অজস্র পুরস্কার।

ফরমানই যে বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল হোতা তার প্রমাণ হিসেবে পাওয়া যায় স্বাধীনতার পর তার অফিস থেকে পাওয়া একটি ডায়েরি যেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নাম ধরে তালিকা পাওয়া যায়। সেই ডায়েরিতে থাকা অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীদের অল্প সময়ের মধ্যেই মধ্যে হত্যা করা হয়। এই ডায়েরি যে সে নিজেই মেন্টেইন করতন সেটা স্বীকার করে একাধিক সাক্ষাৎকার ফরমান দিয়েছেন।

বাঙালি হত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানিদের কোন কালেই কোন অপরাধবোধ ছিল না। তারা কিন্তু ঠিকই স্বীকার করে যে তারা হত্যা করতে এসেছিলো। আইউব খান নিজের ডায়েরিতে লিখেছে যে কীভাবে একজন সৈনিক একলা ১৪ হাজার মানুষকে হত্যা করেছিলো। কুমিল্লা ক্যান্টমেন্টে আটক পাক সেনারা হাসতে হাসতে বলেছে যে তাদের কাছে টিক্কা খানের নির্দেশনা ছিল যে সন্তান কখনো পিতার অবাধ্য হয় না সুতরাং তাদেরকে যত বেশি সম্ভব বাঙালি মেয়েদের গর্ভবতী করে যেতে হবে।

অস্বীকার করি কেবল আমরা, গণহত্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলি কেবল আমরা। আমাদেরকে অংক করে দেখিয়ে দিতে হয় একাত্তরে কত মানুষ মারা গিয়েছিলো। আমরা ৪৫ বছর ধরে অবিরত আমাদের নিজেদেরকেই প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছি গণহত্যার নির্মমতা কতখানি। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ৯৪২ বধ্যভূমি কিংবা তিন হাজার গণকবরের অস্তিত্ব থাকা স্বত্বেও আমরা সন্দেহে ভুগি আসলেই কি তিরিশ লাখ মানুষ একাত্তরে শহীদ হয়েছিলো?

বুদ্ধিজীবী হত্যা বুঝতে চেষ্টা করতে করতে গণহত্যা গবেষণার জগতের দিকপাল ড. রুডলেফ জোসেফ রামেলের ‘Freedom, Democracy, Peace; Power, Democide, and War’- গ্রন্থের একটা লাইনে এসে চোখ আটকে যায়। হিটলারের বাহিনীর হাতে ইহুদি বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে তিনি লেখেন এমন করে-

‘Not only did the Nazis eliminate actual critics and opponents as a matter of course, but they also prevented any serious potential opposition by simply exterminating the top leadership, intellectuals, and professionals.’

পাঠক কেবল দুটো শব্দ বুঝে নিন। ‘Actual Critics’ এবং ‘Serious Potential Opposition’। সোজা কথা একটাই। জিতে গেলেও যেন মাজা ভেঙে যায়। টিকতে না পারে।

মাঝে মাঝে ভাবি গণহত্যা যারা করে সেই হিটলার সেই ইয়াহিয়া খানেরা হয়তো নৈতিকভাবে পরাজিত। কিন্তু তাদের চিন্তা আজও কত সত্য। স্বাধীনতার ৪৫ বছর বাদেও আমাদের খোঁজ করতে হয় ‘জীবন থেকে নেয়া’ আমাদের খুঁজে বের করে চালাতে হয় ‘স্টপ জেনসাইড’। গণহত্যা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র কয়টা গবেষণা কয়টা আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারি করতে পেরেছে আর অবধি?

যদি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখেন বাংলাদেশে আজকের যতোটা পিছিয়ে আছে তার পেছনের দুটো মৌলিক কারণ হচ্ছে এক. পাকিস্তানের পরাজিত প্রশাসনের পুনঃনিয়োগ, দুই. বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা। এখানে উল্লেখ করার মত বিষয় হচ্ছে আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই ছিলেন বামপন্থি চিন্তাধারার। স্বাধীনতার পর ইতিহাস লিখতে গিয়ে অনেকেই বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানালেও তাদের চিন্তার পদ্ধতিকে পদদলিত করেছেন। বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানাতে চাইলে তাদের চিন্তা ভাবনাকেও সম্মান জানাতে হবে। না হলে এই সম্মাননাও দিনের শেষে ছায়া সম্মাননা হয়ে দাঁড়াবে।

বিজয় দিবস কিংবা শহীদ দিবস এ সমস্ত দিবসগুলো আনুষ্ঠানিকতা থেকে বের হয়ে এসে মানুষের হৃদয়ের ঘরে প্রবেশ করুক। রাও ফরমান আলীর ডাইরি ধরে ধরে যে হত্যা করেছে আমাদের প্রজন্ম যেন নাম ধরে ধরে সেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম মুখস্ত না করে তাঁদের কাজগুলোকে জানে এবং সেই চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয় সেটাই কামনা।

সুত্র

১) অমি রহমান পিয়ালের অনুবাদে ডাক্তার জেফ্রি ডেভিসের ডাইরি

২) সহুল আহমেদ মুন্নার ব্লগ ‘গণহত্যা ১৯৭১: ভয়াবহ চিত্র’

৩) ড. মুনতাসির মামুনের বই ‘পাকিস্তানি জেনারেলদের মন’

৪) ড. রুডলেফ জোসেফ রামেলের বই ‘Freedom, Democracy, Peace; Power, Democide, and War’

৫) ড. এম এ হাসানের গবেষণাগ্রন্থ ‘যুদ্ধ ও নারী’

৬) মুক্তিযুদ্ধ গবেষক এম এম আর জালাল ভাইয়ের পূর্বদেশ পত্রিকার সংকলন

লেখক: অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :