অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-১১

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৪:২৩

পে-মাস্টার হিসেবে সাপ্তাহিক ঝরণা সম্পাদক জমির আলী সম্ভবত ইউনিক। বেতন দিতেন একাধিক কিস্তিতে। মাসের শুরু হলেই তার বেতন দেয়া শুরু হতো, শেষ হতো মাস শেষ হবার আগেই। নিজের হাতেই সকলকে বেতন দিতেন, তার কোন হিসাবের খাতা ছিলো না। তবু হিসাবে তার কোন ভুল হতে দেখিনি। তিনি সবকিছু নির্ভুল মনে রাখতে পারতেন। কোন টেলিফোন গাইডও ব্যবহার করতেন না, সকল নাম্বারই ছিলো তার মুখস্ত।

বেতন দেবার ব্যাপারে জমির আলী অদ্বিতীয় হওয়া সত্ত্বেও সাপ্তাহিক ঝরণা ছাড়তে বেশি সময় নেইনি। এ সাবধানতার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সাপ্তাহিক জনকথার অভিজ্ঞতা। আমেনা বেগমের পৃষ্ঠপোষকতায় সাপ্তাহিক জনকথা ছিলো ’৭৫-এর খুনিচক্রের অঘোষিত মুখপাত্র, কিন্তু জমির আলীর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ঝরণা এক পর্যায়ে হয়ে গেলো কর্নেল ফারুকের অতি ঘনিষ্ঠ। শেরাটন হোটেলে এক সেমিনারে বিষয়টি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায় আমার কাছে। শেরাটন হোটেলের সেমিনারে বসেই সিদ্ধান্ত নিলাম, ঝরণায় অবগাহন আর নয়। সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম হলে। আর সাপ্তাহিক ঝরণা মুখো হইনি। তবে মালিক ও স্বজ্জন ব্যক্তি হিসেবে জমির ভাইকে চিরকালই বিনয়ের সঙ্গে শ্রদ্ধা করে যাবো।

সাপ্তাহিক ঝরণা বন্ধ হয়ে যাবার পর জমির ভাইর সঙ্গে আবার দেখা সাক্ষাৎ শুরু হয় তার উত্তরার নিজের বাড়িতে বসবাস শুরুর করার পর। সে সময় আমিও উত্তরায় থাকতাম। তার সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় সম্পর্ক হবার পর দেখেছি, মায়ের ব্যাপারে একটি মানুষ কতটা আবেগ প্রবণ ও দায়িত্বশীল হতে পারে। বার্ধক্যের কারণে তার মা গ্রাউন্ড ফ্লোরে থাকতেন, তাকে দেখাশুনার জন্য উপযুক্ত লোকও ছিলো। কিন্তু এরপরও মায়ের রুমেই রাতে থাকতেন জমির আলী। রোগের কারণে প্রায় সারারাত তার মা ঘুমাতে পারতেন না, আর এ সময় নির্ঘুম রাত কাটাতেন জমির আলী। মায়ের প্রতি সন্তানের এ ধরনের আবেগ ও শ্রদ্ধা কত সন্তানের মধ্যে আছে তা বলা কঠিন। তবে সরাসরি দেখার সুযোগ না হলেও ঘটনা প্রবাহে অনুমান করা যায়, মায়ের প্রতি মাই টিভি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন সাথীরও প্রচণ্ড আবেগ ও শ্রদ্ধা রয়েছে। যে কারণে মাকেই জীবদ্দশায় করেছেন তার গড়া কোম্পানির চেয়ারম্যান; মায়ের প্রতি ভালবাসার টানেই সম্ভবত মাই টিভিতে প্রচার করছেন ‘মা আমার মা’ নামে হৃদয়গ্রাহী একটি অনুষ্ঠান।

সাপ্তাহিক ঝরণা ছাড়ার পর চাপ বাড়লো আর একটি পত্রিকা খুঁজে বের করার, সময়টা সম্ভবত ১৯৮৩ সাল। কিন্তু খুঁজতে হয়নি। মেঘ না চাইতেই পেয়ে গেলাম আসাদুজ্জামান রিপনের সাপ্তাহিক জনতার ডাক। এ ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে হলের এক ছোট ভাই আলাউদ্দিন; সমাজ বিজ্ঞানে পড়তো, বরিশালের ছেলে। একদিন সন্ধ্যায় সে বললো, খুলনার একটি পত্রিকা, ঢাকায় ছাপা হবে, লোক দরকার। সে আরো বললো, আপনি দায়িত্ব নিলে আমি জেনারেল সেকশনে একটা জব করতে পারবো, টিউশনি আর ভালো লাগে না!

ঃ ঠিক আছে; আলোচনা করো।

ঃ চলেন, আজ রাতেই কথা বলি, আমাদের হলেই থাকে, রিপন ভাই।

রাতে যার রুমে গেলাম তিনি হচ্ছেন আসাদুজ্জান রিপন, তখন খুলনার একটি কলেজে বিএ’র ছাত্র; সম্ভবত বিএল কলেজের। ছাত্রদল নেতার প্রিভিলেজে থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলে। বিএ পাস করার পর তিনি অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন বলে শুনেছি। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছেন। জিয়া সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও খালেদা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মোস্তাফিজুর রহমানের বিশেষ আস্থাভাজন ছিলেন আসাদুজ্জামান রিপন। তিনি বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন দলের মুখপাত্রও। বর্তমানে দলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। পত্রিকার মতো তার রাজনীতিও সম্ভবত মরুদ্দানে পথ হারিয়েছে। তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছেন ড. রিপন হিসেবে। খবর সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজানেরও ড. মিজান হিসেবে বেশ পরিচিতি আছে।

রাতে অনেকক্ষণ আলাপ হলো রিপন ভাই’র সঙ্গে, খুবই স্বজ্জন ও আন্তরিক স্বভাবের মানুষ। পত্রিকা নিয়ে বিশাল এক স্বপ্নের ছক তুলে ধরলেন তিনি। সঙ্গে এও বললেন, আলাউদ্দিনের কাছে যা শুনেছি তাতে আপনাকে পেলে তার আর পিছনে তাকাতে হবে না। কিন্তু শুরুতেই আমার ধারণা হয়েছিলো, পিছনে আমাকে তাকাতে হবে। কারণ, যে পরিকল্পনা নিয়ে তিনি আগাচ্ছেন তাতে তার পত্রিকা বেশি দূর যাবে না। কিন্তু আমার যেহেতু জমির আলীর সাপ্তাহিক ঝরণা ছাড়া প্রয়োজন সেহেতু বেশি আলোচনায় না গিয়ে আসাদুজ্জামান রিপনের সাপ্তাহিক জনতার ডাক-এ যোগ দিলাম। আমার পদ নির্ধারিত হলো, নির্বাহী সম্পাদক। অফিস আপততঃ থাকলো মহসিন হলে আমার ও রিপন ভাই’র রুম। কম্পোজের ব্যবস্থা করা হলো পুরান ঢাকার শাহ শাহেব বাজার এলাকার একটি প্রেসে, এ প্রেসের নামও মালিকের স্ত্রীর নামে, নাজমা প্রেস। আর ছাপাখানা নির্ধারণ করা হলো ঐতিহ্যবাহী আজাদ প্রেস।

অনেক জোড়াতালি দিয়ে ডাবল ডিমাই সাইজের প্রথম সংখ্যা সাপ্তাহিক জনতার ডাক রেডি করা হলো। চার পৃষ্ঠার পত্রিকা রেডি করতে যে ঝক্কি হয়েছে তার চেয়ে অনেক কমে এখন বিশ পৃষ্ঠার পত্রিকা রেডি করা যায় প্রযুক্তির কল্যাণে। শেষতক পত্রিকা ছাপার জন্য রেডি হলো। রাতে পেস্টিং করার সময় রিপন ভাই একটি কাজ করলেন। প্রিন্টার্স লাইন থেকে আমার নাম কেটে এনে লিড আইটেমে পেস্ট করতে বললেন পেস্টারকে। এর অর্থ হচ্ছে, পিন্টার্স লাইনে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আমার নাম যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে আমি বললাম, রিপন ভাই, আমি যাই; কাজ করবো না! এ বলায় আমার কণ্ঠে কোন উত্তাপ ছিলো না। তবে সম্ভবত দৃঢ়তা ছিলো, অবস্থা বেগতিক দেখে জনতার ডাক সম্পাদক তার সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টালেন। প্রিন্টার্স লাইনে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আমার নাম থাকলো। সম্পাদক যথারীতি আসাদুজ্জামান রিপন।

ধারণার চেয়ে অনেক বেশি পাঠক ধরলো পত্রিকাটি। কিন্তু তখনও এর ডিক্লারেশন খুলনার। এ অবস্থাতেই পত্রিকাটি প্রকাশ হতে থাকলো ঢাকা থেকে। কয়েক দিনের মধ্যে সম্পাদক সাহেব একজন ফিন্যান্সারও জোগাড় করে ফেললেন; আবদুল আওয়াল মিন্টু। তখন তার অফিস ৪৮ পুরানা পল্টনের নিচতায়। জনতার ডাক-এর অফিস নেয়া হলো তোপখানা রোডে, সম্ভবত ৩২ তোপখানা রোড। এ ভবনের নিচতলায় ছিলো রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টির অফিস। এ অফিস থেকে বাম ধারার একটি পত্রিকাও প্রকাশিত হতো। ভবনের মালিক একদিন বললেন, মেনন ছাবের পত্রিকা তো কেউ কেনে না; আপনাদের পত্রিকা এতো বিক্রি হয় কেন?

এ প্রশ্নের তো কোন জবাব হয় না। তবে প্রশ্নটি অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও এর কারণ ছিলো প্রাসঙ্গিক। সেটি হচ্ছে, হকার্স সমিতিতে পত্রিকা দেয়া সত্ত্বেও পত্রিকা প্রাকাশের দিন অনেক হকার অফিসে চলে আসতো সরাসরি পত্রিকা নেবার জন্য। আর এদের ভিড়ে মাসে অন্তত চার দিন ভবনের পরিবেশ বিঘ্নিত হতো। এ কারণেই জনতার ডাক বিক্রি হবার কারণে উদ্বিগ্ন হয়ে ছিলেন ভবন মালিক। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলেন না; পত্রিকা অফিস বলে কথা! আজকের দিনে সাংবাদিক ঠ্যাঙানোর বিষয়টি প্রায় ডাল-ভাত হয়ে গেলেও সে সময় সমীহ করার সাথে ভয়ও করতো অনেকে। সম্ভবত এ ভয়ের কারণে ভবন মালিক অফিস ছাড়ার নোটিশ দিতে পারছিলেন না। এ ছাড়া পত্রিকার মালিক হিসেবে সামনে ছিলেন আবদুল আওয়াল মিন্টু। সে সময় আবদুল আউয়াল মিন্টু ধনকুবের হিসেবে পরিচিতি লাভ না করলেও একজন ভবন মালিকের কাছে অতি ধনী লোক হিসেবেই বিবেচিত হয়েছেন। ফলে পত্রিকার জন্য হরকারদের উপদ্রপের পরও অফিস ছাড়ার নোটিশ দেননি ভবন মালিক।

তবে পত্রিকা মালিক ও সম্পাদক আসাদুজ্জান রিপনকে প্রায়ই বেশ কয়েক দিনের জন্য ঢাকা ছাড়তে হতো খুলনায় বিএ পরীক্ষা দেবার জন্য। এ সময় প্রডাকশন কস্ট আনার জন্য প্রতি সপ্তাহে আমাকে যেতে হতো ৪৮ পুরানাপল্টনে আবদুল আওয়াল মিন্টুর অফিসে। এর আগে তিনি একাউন্টটেন্ট কবীরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আর প্রয়োজন ছিলেন না বলে মিন্টু সাহেবের সঙ্গে পরিচয় করাননি। তবে তার কক্ষ দেখিয়েছেন। কিন্তু পরে দেখেছি, আসাদুজ্জামান রিপন যে কক্ষ জনাব মিন্টুর কক্ষ হিসেবে দেখিয়েছেন তা আসলে ফ্রেসরুম এলাকা!

এক পর্যায়ে আবদুল আওয়াল মিন্টুর সঙ্গে আসাদুজ্জান রিপনের সম্পর্কে শীতলতা সৃষ্টি হলো। এদিকে সম্পাদকও আমার ওপর বিরক্ত হয়েছিলেন। তার আমার ওপর বিরক্ত হবার উৎস হলো পত্রিকার প্রডাকশন-এর হিসাব। ঘাগু একাউন্টট্যান্ট ও আবদুল আওয়াল মিন্টু অত্যন্ত বিশ্বস্ত কবীর প্রতি সপ্তাহে প্রডাকশন ব্যয়ের হিসেব নিতেন। একটি নির্দিষ্ট ছকে এ হিসাব দিতেন জনাব রিপন নিজে। কিন্তু বিএ পরীক্ষার জন্য তিনি খুলনায় অবস্থানকালে তার ছকটি আমার কাছে দিয়ে প্রতি সপ্তাহে হিসাব দিতে বলেছিলেন। এতে আমি পড়লাম উভয় সংকটে। এ ব্যাপারে বরিশাল অঞ্চলে একটি প্রচলন আছে, সত্য বললে মা কিল খায়, মিথ্যা বললে বাবা হারাম খায়। এ অবস্থায় কোন কিছুই না বলার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাতে সম্পাদক এসে নিজেই হিসেব দিতে পারেন তার ছকে। কৌশল হলো, হেনতেন ভাবে হিসাব দেয়ার বিষয়টি বিলম্ব করা। কিন্তু কবীর সম্ভবত আগে থেকেই কোন গন্ধ পেয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি কনকনে শীতেও সারারাত প্রেসে কাটিয়ে ছিলেন কয়েকবার। যদিও প্রথম দিন লেপও নিয়ে গিয়েছিলেন প্রেসে। কিন্তু গিয়ে দেখলেন লেপ মুরি দিয়ে ঘুমানোর জায়গা প্রেস নয়, বসতেও হয় পত্রিকার বান্ডিলের ওপর। এ বান্ডিলের ওপরই শেষ রাতে ঘুমানোর জন্য শুয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এক বাইন্ডার যখন আলো আধারিতে তার ওপরই বসলো তখন সে বুঝলো, পত্রিকা ছাপার প্রেস আর যাই হোক, ঘুমাবার জন্য উপযুক্ত স্থান নয়। শুরুতে প্রেসের পরিবেশ সম্পর্কে আঁচ করতে না পারলেও সম্পাদকের দেয়া হিসাবে গড়বরের একটা গন্ধ হয়তো পেয়েছিলেন শুরুতেই। যে কারণে প্রডাকশন কস্টের হিসাব দেবার জন্য তিনি আমাকে বেশ চাপ দিচ্ছিলেন। প্রায় তিন সপ্তাহ পাশ কাটিয়ে শেষতক আমি হিসাব দিলাম।

হিসাব দেখে কবীর হাসলেন; বললেন আগেই আমার সন্দেহ হয়েছিলো; বিষয়টি আমি মামাকেও জানিয়েছি। এ বলে আমাকে মিন্টু সাহেবের রুমে নিয়ে গেলেন, মিন্টু সাহেবকে কবীর ‘মামা’ বলতেন। আমার সামনে পুরো বিষয় মিন্টু সাহেবকে বললেন কবীর। মিন্টু সাহেব সংক্ষেপে বললেন, বিএনপির এক নেতা রিপন সাহেববকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমারও সখ ছিলো পত্রিকা করার। কিন্তু আমি আর রিপন সাহেবের সঙ্গে আগাবো না, আপনি আমার সঙ্গে থাকেন; আমি পত্রিকা করবো।

কিন্তু মিন্টু সাহেব এখন পর্যন্ত কোন পত্রিকা করেননি; আর ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকলেও সেই অর্থে তার সঙ্গে আর থাকাও হয়নি আমার। এদিকে মেয়র নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়া প্রশ্নে আমার সোজা সাপটা মন্তব্যে খুবই নাখোশ হয়েছিলেন আব্দুল আওয়াল মিন্টু, যাকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি সাপ্তাহিক জনতার ডাক থেকে শুরু করে নানা ইস্যুতে।

লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, মাই টিভি

ছবি: আবদুল আওয়াল মিন্টু ও আসাদুজ্জামান রিপন

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :