মুক্তিযোদ্ধার বয়ান-২

ভয়ে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াচ্ছিল মানুষ

মুক্তিযোদ্ধা মনজুর মোরশেদ সাচ্চু
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৯

উনারা চলে যাবার পর স্বাধীন বাংলার পতাকার যাতে কোন অবমাননা কারও হাতে না হয় সেই জন্যই সেদিন অনিচ্ছা সত্ত্বেও পতাকাটা নামিয়ে সুন্দরভাবে ভাঁজ করে পকেটে রাখলাম। নানারকম গুজব আসতে থাকলো। কেউ বললো রাজবাড়ীতে পাক সেনা এসে পাংশার দিকে রওয়ানা হচ্ছে। চারিদিকে আগুন দিয়ে তছনছ করতে করতে সামনের দিকে আসছে আরও কত কি।

এই মুহূর্তে আব্বা আর এমপি সাহেব কারোই পাংশা থাকা ঠিক হবে না। সোজাসুজি বাসায় চলে এলাম। বাসায় এসে উনাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে ঠিক হলো আজ সন্ধ্যায়ই আব্বা ও এমপি সাহেব পাংশা ছেড়ে গ্রামের দিকে চলে যাবেন। মা আমার ছোট ভাইবোনদের নিয়ে আমার মামা বাড়িতে চলে যাবেন। আমি পাংশার পরিস্থিতি বুঝে আগামীকাল পাংশা ছাড়বো। অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে কথা হলো তারা আমাদের গ্রামের বাড়ি চরঝিকড়ীতে আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে।

সন্ধ্যার আগেই এমপি সাহেব,আব্বা পাংশা ছেড়ে চলে গেলেন। আমার ছোট ভাই বোনদের নিয়ে মামা বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন মা। আমি একাই পাংশার বাসাতে রয়ে গেলাম। সন্ধ্যার পর কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে বাসায় আসতে বললাম। তার ভেতর পাংশা থানার ওসির ছেলেও ছিল। ওর সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল। সে কারণে ওসি সাহেব আমাদের খুবই স্নেহ করতেন। ওই মুহুর্তে তিনি বহুভাবে আমাদের সাহায্য করেছেন। সন্ধ্যার পর থানার ওসি সাহেবের বাসায় গেলাম। ওসি সাহেব বাসাতেই ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন সাচ্চু আর এক মুহুর্ত তোমার পাংশা থাকা ঠিক হবে না। রাজবাড়ীতে মিলিটারি এসে গেছে যে কোনো সময় পাংশা চলে আসতে পারে। ওসি সাহেবকে বললাম চাচা আজকের রাতটা পাংশা থাকবো কালকে পাংশা ছেড়ে চলে যাবো। মিলিটারি যদি পাংশাতে এসেই পরে তবে যেভাবেই পারেন বাসাতে একটা সংবাদ দিয়েন।

চাচা বললেন তুমি সজাগ থেকো মিলিটারি আসলে সঙ্গে সঙ্গে সংবাদ দেবো। চাচি রাতে কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে আসতে বলেছি। রাতে বাসাতে বন্ধুবান্ধবসহ নিজেরা রান্না করে খাবো। খোকনকেও নিয়ে গেলাম ওর আসতে একটু রাত হবে। চাচা ও চাচি দুজনই আমাকে ছেলের মত দেখতেন। রাত্রে বাসায় এসে চারটে মুরগি জবাই করলাম। ভাত রান্না করলাম। বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব রাত্রে বাসায় এল। গল্প গুজবের মাধ্যমে আমরা সবাই এক সঙ্গে খানাপিনা করলাম। কথা হলো সবাই চরঝিকড়ীতে আমাদের গ্রামের বাড়ির সাথে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে। একে একে বন্ধুবান্ধব সবাই বিদায় নিল। রাতও অনেক হয়েছে। হারিকেনটা অল্প করে কমিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম।

রাত আনুমানিক ৩টা হবে। হঠাৎ বাসার গেটে সজোরে ধাক্কার শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল। হারিকেনটা জ্বালিয়ে দিলাম। প্রথমে ভাবলাম পাংশাতে মিলিটারি এসে পড়েছে। ওসি সাহেব হয়তো সংবাদ পাঠিয়েছে। হারিকেন নিয়ে গেটের দিকে আসতে থাকলাম। এখন আমার নাম ধরে ডাক শুনতে পেলাম। আস্তে আস্তে সাচ্চু ভাই সাচ্চু ভাই বলে ডাকছে। কিন্তু কণ্ঠস্বর পরিচিত বলে মনে হলো না। বললাম কে? ওরা ভিতু গলায় বললো আগে দরজা খুলুন সব বলছি। আমিও ভয়ে ভয়েই দরজা খুললাম। দরজা খোলার সাথে সাথেই হুড়মুড় করে চারটা লোক বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। সবার কাঁধেই রাইফেল বিদ্ধস্ত চেহারা গায়ে শার্ট পড়নে লুঙ্গি। প্রথমেতো ভয়ে আঁৎকে উঠলাম। পরক্ষণেই চিনতে পারলাম পাংশা থেকে গোয়ালন্দ প্রতিরক্ষা বুহ্যে আমাদের পাংশা থেকে বেশকিছু আনসার যোগ দিয়েছিল। গোয়ালন্দে পাক মিলিটারির গোলার আঘাতে টিকতে না পেরে ওরা যার যার মত যে যেদিকে পারছে সরে পড়েছে। ওরা চারজন আর কোন পথ না পেয়ে পাংশার দিকে চলে এসেছে। চারটা রাইফেল দিয়ে বললো এগুলি রাখেন আমরা এখন বাড়ির দিকে যাই। ওদের মুখের দিকে চেয়ে মনে হলো ওরা ভীষণ ক্ষুধার্ত। রাতের রান্না করা মাংস আছে ভাতও আছে। আমি ওদের খেয়ে যেতে বললাম। ওরা বললো এত রাত্রে খাবার পাবেন কোথায়।

আমি বললাম রান্না করা আছে। হয়তো সবার পেট পুড়ে হবে না। তবুও কমও হবে না। মাংসের পাতিল ও ভাতের পাতিল ওদের সামনে এনে দিলাম ওরাই প্লেট ধুয়ে ওই খাবার চারজনে ভাগ করে খেলো। খাওয়ার পর বললো সাচ্চু ভাই খুবই ক্ষুধা লেগেছিল। এখন যে কি তৃপ্তি লাগছে তা আর বলার না। আমিও বললাম আমি তোমাদের মুখ দেখেই বুঝেছি যে তোমরা খুবই ক্ষুধার্ত।

গোয়ালন্দে পাক বাহিনীর আক্রমণের কথা ওদের মুখে শুনলাম। পাক বাহিনীর একের পর গোলার আঘাতে আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য তছনছ হয়ে গেছে। অনেকে অস্ত্র ফেলে রেখেই পালিয়ে গেছে। আমরা অনেক কষ্ট করে রাইফেল চারটি সাথে করে নিয়ে এসেছি। যদি ভবিষ্যতে কাজে লাগে। ওরা আর দেরি করলো না। যে যার বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো। আমি এবার আর এক বিপদে পরে গেলাম। এখন এই রাইফেল চারটার কি করি?

সকাল বেলায় পাংশা ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিল। আপাতত প্রোগ্রাম বাতিল করলাম। রাইফেল চারটা ও গুলি ঘরের ছাদের উপর রেখে দিলাম। চরঝিকড়ীর আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত এবং দুঃখে বিপদে আপদে যে আমার সর্বদা পাশে থাকতো সেই ছাদেককে খবর দিলাম সন্ধ্যার আগেই পাংশা আসতে। সারাটা দিন খুবই আতঙ্কের ভিতর কাটলো। এই বুঝি রাজবাড়ী থেকে মিলিটারি এসে পড়লো। আমার বন্ধুবান্ধবসহ কর্মীরা জানে আমি সকালেই পাংশা চেড়ে চলে যাবো। যার ফলে ওই দিন কেউ আর বাসায় আসে নাই। আমিও বাসার বাইরে গেলাম না। কিন্তু বাসা থেকেই দেখতে পেলাম পাংশার প্রায় প্রতিটি দোকানেই পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। মানুষ ভয়ে পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলন করছে। কিন্তু মনের দিক থেকে তারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়। এভাবেই বাসার ভিতরেই বিকাল গড়িয়ে গেল।

সন্ধ্যার কিছু আগেই ছাদেক এসে হাজির। ছাদেককে সব কথা বললাম এবং রাইফেল চারটা চরঝিকড়ী নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বললাম। ছাদেক রাইফেল চারটা বস্তার ভিতর ভরে দড়ি দিয়ে ভালভাবে বেঁধে নিল। আমি আমার কিছু কাপড় চোপড় ও গুলি একটা ব্যাগে ভরে নিলাম। সন্ধ্যার পর পরই পাংশার সমস্ত দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেছে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাসার সমস্ত ঘর তালা লাগিয়ে গেটে একটা বড় আকারের তালা ঝুলিয়ে এই অন্ধকারের ভেতর পাংশা ছাড়লাম ছাদেকের কাঁধে ওই রাইফেলের বস্তা আমার কাঁধে ওই রাইফেলের গুলি ও কাপড় চোপড় ভর্তি ব্যাগ। পাংশা পার হয়ে এসে চরঝিকড়ীর উদ্দেশ্যে মেঠো পথ ধরলাম। পথে মনে হলো লোকজনের কোন সাড়া শব্দ নাই। এই অল্পরাতেই তারা ঘুমের সাগরে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। ঘণ্টা দেড়েকের ভিতর সোজাসুজি ছাদেকদের বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। ওদের বাড়িটা ছিল খুবই নিরাপদ। গ্রামের এক প্রান্তে অবস্থিত তারপরই বিশাল মাঠ। মাঠের পরই পদ্মা নদী।

ওদের বাড়ির কথা না বললে আমার অনেক কিছুই অতৃপ্ত থেকে যাবে। ছোট বেলা থেকে আমি এই চরঝিকড়ীতে মানুষ। আব্বা, মা ও আমার ছোট ভাইবোনেরা পাংশা থাকে। আমি চরঝিকড়ীতে থেকেই পড়াশুনা করি। এরও একটা ইতিহাস আছে। (চলবে...)

লেখক- গোয়ালন্দ মহকুমা মুজিব বাহিনীর প্রধান

(জন্ম ১জুন ১৯৫১-মৃত্যু ২১জুলাই ২০১৫)

অনুলিখনঃ সাজ্জাদ বাবু

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :