মুক্তিযুদ্ধ, এই দেশ এই সময়

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
 | প্রকাশিত : ১৬ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৯:০৫

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আমাদের সমাজ যেমন স্পষ্ট ও গভীরভাবে দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, তেমন বোধ হয় আর কখনো হয়নি। শত্রুর ও মিত্রের পক্ষে ও বিপক্ষের বড় দুই ভাগ। কিন্তু এই বড় দুই ভাগের মধ্যেও ছোট ছোট ভাগ ছিল। সে ভাগগুলো সামাজিক সত্য।

হানাদারদের পক্ষে যারা গেছে তাদের কেউ কেউ ছিল নিরুপায়। সব রাজাকারই যে স্বেচ্ছায় ও পথে গেছে তা নয়, প্রাণভয়ে যোগ দিয়েছে কেউ কেউ। একটা বড় অংশ গেছে লোভের আশায়, তাদের যোগ ছিল পাকিস্তান শাসন অর্থাৎ শোষণব্যবস্থার সঙ্গে। সেই যে শোষণ, যাকে গ্রহণযোগ্য করার জন্য নাম দেওয়া হয় শাসন তার উচ্ছিষ্ট পেত যারা, তারাই সেই পাওয়াটাকে হারাতে চায়নি এবং আরো পাবে, এমন আশা মনের মধ্যে পুষেছিল।

বিপরীত পক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের মিত্রপক্ষের উদ্দেশ্য ও আশার বিভিন্নতা ছিল বৈকি। প্রাণভয়ে মরিয়া হয়ে কেউ কেউ এসেছে। কেউ এসেছে জাতিসত্তার নিপীড়ন সহ্য না করতে পেরে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির একাংশের আশা ছিল তারা উচ্চবিত্ত হবে। সাধারণ, শ্রমজীবী মানুষের কিন্তু সেই স্বপ্নটা ছিল না। তারা আশা করেছে স্বাধীনতা। তাদের খাবার দেবে, রুজি দেবে, বস্ত্র ও গৃহ দেবে। সন্দেহ নেই যে, আওয়ামী লীগ ছিল মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। দেশ স্বাধীন করবে- এমন কথা আওয়ামী লীগ ছাব্বিশে মার্চের আগে কখনো বলেনি। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গের আওয়াজ ঊনসত্তরের পরে উঠেছিল ঠিকই, কিন্তু সে আওয়াজ পূর্ববঙ্গে সর্ববৃহৎ ও সর্বাধিক শক্তিশালী এবং সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশরূপে বিজয়ী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ওঠেনি। আওয়াজ জোরদার হয়নি, বরং তার উত্থানকারীদের সন্দেহই করা হয়েছে বিভ্রম সৃষ্টিকারী অথবা হঠকারিতা বলে। না, স্বাধীনতার কথা পঁচিশে মার্চের সেই অবিশ্বাস্য রাতের আগে সাধারণভাবে কল্পনাও করেনি এ দেশের মধ্যবিত্ত। আওয়ামী লীগ ছিল দরকষাকষির প্রতিষ্ঠান। শেখ মুজিব ছিলেন মধ্যবিত্তের সাহসী ও অনমনীয় নেতা, পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে দরকষাকষির ব্যাপারে বাঙালি মধ্যবিত্তের পক্ষে তার চেয়ে যোগ্য প্রতিনিধি খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল।

কিন্তু দরকষাকষির পর্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিল সত্তরের নির্বাচনের পরেই। ছয় দফা যে বেদ, বাইবেল, কোরআন নয়, এ নিয়ে যে আলোচনা চলতে পারে- এ কথা নির্বাচনের আগে বলা সম্ভব ছিল, কিন্তু সত্তরের সেই নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ছয় দফা রদবদলের বাইরে চলে গেছে। আওয়ামী লীগ নিজেই বন্দি হয়ে গেছে নিজের দেওয়া রাজনৈতিক দাবির হাতে। ছয় দফা নয়, এক দফাই যে বেরিয়ে আসবে এবং সেই এক দফা যে হবে দেশের স্বাধীনতা। এই অমোঘতার পূর্বাভাস ছিল সত্তরের নির্বাচন। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাঙলা দেশ স্বাধীন কর’- এই আওয়াজ তাই ছয় দফার বুক চিরে বেরিয়ে এলো একাত্তরের পয়লা মার্চের পরেই। কারো পছন্দ-অপছন্দের চাওয়া না-চাওয়ার তোয়াক্কা না করেই।

কিন্তু এই নতুন আন্দোলনের নেতৃত্ব যে শেখ মুজিব দেবেন না তা ইতিহাসই নির্ধারণ করে দিয়েছিল। ওদিকে অনুপস্থিত থেকেও তিনি যে ভাবমূর্তি হয়ে সর্বাঙ্গনে উপস্থিত থাকবেন ওই যুদ্ধে তার এই ভূমিকাও ইতিহাস নির্দিষ্ট বটে। এর কারণ বামপন্থিরা আর কমিউনিস্টরা বিকল্প একটি নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেননি। তাদের আন্দোলন গোপন ছিল শুধু পুলিশের কাছে নয়, দেশের বেশির ভাগ মানুষের কাছেও। তাই দেখি তাদের সেøাগানগুলো এসে গেছে, ‘ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে এবার রক্ষা নাই’ কিংবা ‘অন্ন চাই, বস্ত্র চাই, বাঁচার মত বাঁচতে চাই’- এসব ধ্বনি লোকে জোরে জোরে দিচ্ছে; কিন্তু তাদের সংগঠন সামনে আসতে পারছে না; জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ যেভাবে মানুষের আবেগ কেড়ে নিয়েছে সমাজতন্ত্রী বামপন্থিরা তার এক আনাও পারেননি। শেখ মুজিবের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ দেবে, এমন শক্তি পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর যেমন ছিল না, বাংলাদেশি বামপন্থিদেরও তেমনি ছিল না। তাই দেখি বামপন্থিদের একাংশ আওয়ামী লীগের লেজুড় হয়ে পড়ল, অন্যাংশ তার বিরোধিতা করতে গিয়ে জনজীবন বিচ্ছিন্নতার ঘূর্ণিতে পড়ে গেল। শেখ মুজিব নেতৃত্ব না দিয়েও নেতা হয়ে রইলেন এবং তিনি যে মধ্যবিত্ত স্বার্থের প্রতিনিধি সেই স্বার্থ তাতে ভেতরে ভেতরে আশ্বস্ত হলো।

মুক্তিযুদ্ধের এ একটি প্রাথমিক বিজয়। সমাজতন্ত্রের কথা এমনভাবে আগে আর কোনোদিন শোনা যায়নি। জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যেই বলত, সমাজতন্ত্রের কথা পাকিস্তানের পাক ভূমিতে যদি কেউ তোলে তবে তার জিভ নেবে কেটে। মওলানা ভাসানীও সরাসরি বলতে সাহস করতেন না যে, তিনি সমাজতন্ত্র চান, তার পক্ষেও দরকার হতো ‘ইসলামিত্বের’ মিশেল দিয়ে সমাজতন্ত্রের দাবিকে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কাছে সহনীয় করানো; নইলে নির্ভেজাল সমাজতন্ত্র হতো বড়ই ভয়ংকর। অথচ যে আওয়ামী লীগের পক্ষে সংগত ও স্বাভাবিক ছিল জাতীয়তাবাদীদের সুপ্রাচীন পদ্ধতিতে শ্রেণি-সমন্ব^য়ের অর্থাৎ শ্রেণিশোষণের পক্ষে বলা তাকেই ধ্বনি তুলতে হলো শ্রেণিহীন সমাজের। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপাদান বায়ান্ন থেকেই নিজেদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা শুরু করেছিল, একাত্তরে এলো সমাজতন্ত্র; যদিও বলা হলো না এ সমাজতন্ত্র কেমন হবে, কাল্পনিক নাকি বৈজ্ঞানিক।

একাত্তরে একটি মৈত্রী ঘটেছিল, বাঙালি সমাজের শ্রেণিগুলোর মধ্যে। মৈত্রীর তাৎপর্য কিন্তু সামান্য নয়। কেননা পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটল কার? সে তো শুধু কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির নয়, কোনো একটি প্রতিষ্ঠানেরও নয়, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ঘটেছে একটি পুরোনো ব্যাধির, নাম যার প্রতিক্রিয়াশীলতা। এই ব্যাধি ছিলই, তাকে নতুন জীবনদান করা হলো দালালদের পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে। যদিও বলা হয় এ হচ্ছে তুলনাবিহীন উদারতা, অতি বড় মহানুভবতা, কিন্তু এর আসল অভিনবত্ব উদারতায় বা মহানুভবতায় কিংবা ক্ষমায় নেই, আছে মুক্তিযুদ্ধ চেতনার অবমাননায়, তার অবমূল্যায়নে, তার নিপীড়নে। আলবদর মানসিকতা ফিরে এলো। সামন্তবাদী প্রবণতাগুলো যেমন অদৃষ্টবাদ, ভক্তি, আগেই ভালো ছিলাম মানসিকতা, তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা, পারলৌকিকতা ফিরে এলো। সঙ্গে যোগ দিল পুঁজিবাদের অনেক অনেক বিচ্যুতি যেমন অর্থ দিয়ে সব কিছু ক্রয়-বিক্রয় করা, ব্যক্তিবিচ্ছিন্নতা, স্থূল বস্তুতান্ত্রিকতা, উত্তেজনাপ্রিয়তা, অবসাদ।

নতুন দালালেরাও বেরিয়ে এলো লম্ফ দিয়ে। আলবদর ও হিন্দু মহাসভাপন্থিতে তো চরিত্রগত কোনো তফাৎ নেই। পুরোনো পাকিস্তানপন্থিদের পাশাপাশি দেখা গেল নব্য ভারতপন্থিদের। শাসন কর্তৃপক্ষের দালাল প্রয়োজন, তাই দালালি বিশেষভাবে প্রশ্রয় পেল এবং বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। এই কাজ আজও সামনে চলছে।

এর তুলনায় বিদেশের দালালি বরং আরো বেশি কার্যকর। বাংলাদেশের সমাজে আজ তাদেরই সবিশেষ মর্যাদা, যারা কোনো না কোনোভাবে বিদেশের সঙ্গে যুক্ত হোক, সে চাকরিতে কিংবা বিদ্যার্জনে অথবা ইনডেন্টিং বা এজেন্সি ব্যবসায়ে। বীরের আসন তাদের জন্যই নির্দিষ্ট। বিদেশি টাকা আসছে, কাজেই তার প্রতি আনুগত্যও আসছে। নব্য উপনিবেশবাদ তৎপরতা অবাধে চলছে। আমাদের অর্থনীতি গভীর ও ব্যাপকভাবে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছে। বাংলা ভাষা যে প্রশাসনিক কাজে ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যথার্থরূপে প্রচলিত হচ্ছে না তার আসল কারণ নিহিত আছে এই সত্যে যে, গোটা সমাজ আজ বিদেশমুখো, তার সংবিতে গভীরভাবে প্রবিষ্ট ও প্রোথিত আছে আত্মবিশ্বাস ও পরদেশ মুখপেক্ষিতা। স্বনির্ভরতার ও স্বয়ংসম্পূর্ণতার আওয়াজ ওই শূন্যতাতেই বাজছে বেশি জোরে।

অথচ মুক্তিযুদ্ধ তো ছিল এই দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেই। সেই যুদ্ধ তো এনে দিয়েছিল গভীর আত্মবিশ্বাস, ব্যাপক স্বদেশপ্রেম। তাহলে এই বিরোধী মানসিকতাটা এলো কেন? এসেছে একাধিক কারণে। প্রথমত, মানসিকতাটা অত্যন্ত পুরোনো। পরাধীন আমরা ছিলাম যুগ-যুগান্তর ধরে। বাঙালি বাংলাদেশে রাজত্ব প্রায় করেইনি এর আগে। যারা জন্য বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার আগে কখনো বাংলা এখানকার রাষ্ট্র্রভাষা ছিল না। দ্বিতীয়ত, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে যেটুকু উপাদান ছিল পরদেশনির্ভরতার, তাকে বড় করে দেখানো হয়েছে, যুদ্ধের শত্রুপক্ষ দেখিয়েছে, মিত্রপক্ষও দেখিয়েছে, যদিও পরস্পরবিরুদ্ধ কারণ। কারো কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিল রুশ-ভারতের ষড়যন্ত্র, কারো কাছে এ ছিল রুশ-ভারতের মহানুভবতা। ফলত উভয় দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের যে ভূমিকা, যে বিজয়, সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ তার অবমূল্যায়ন ঘটল। এমনকি পাকিস্তানের লাখ খানেক সৈন্য যে ঢাকায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলো, তার আনুষ্ঠানিক দিকটাতেও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধিকে উপস্থিত করা হলো না। ফলে ব্যাপারটার চেহারা দাঁড়াল ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ। তৃতীয়ত, এ দেশের শাসকশ্রেণি সব সময়েই ছিল বিদেশি স্বার্থের দ্বারা পুষ্ট। আশা করা গিয়েছিল যে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থেই স্বাধীন হবে কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না এই কারণে যে, যারা ক্ষমতায় এলো তারা স্বাধীন ছিল না। যে দেশি বুর্জোয়া শ্রেণি ‘স্বাধীনভাবে’ (অর্থাৎ পাকিস্তানি বুর্জোয়াদের কর্তৃত্বের বাইরে) ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত হলো তার চরিত্র জাতীয় বুর্জোয়ার নয়, বরং মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ার বটে।

বিপ্লব কি ঘটেছে বাংলাদেশে? একাত্তরের পরও আরো অনেক বিপ্লবের সংবাদ পাওয়া গেছে। কিন্তু বিপ্লবের ফল কী পাওয়া গেছে আমাদের জীবনে? খুব অল্প কিছু লোকের জীবনে অবশ্য বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছ, ধন-সম্পদ এত বেড়েছে, যা পাকিস্তান থাকলে সম্ভব হতো না কিন্তু তার বাইরে? তার বাইরে কোথায় কী? আইন, অর্থনীতি, রাজনীতি কোথায় খুঁজলে মৌলিক পরিবর্তনের সন্ধান পাব আমরা, অথবা দেখতে পাব তার লক্ষণ? আইন বদলায়নি, নতুন সংবিধান বারবার সংশোধিত ও স্থগিত হয়ে গেছে, পুরোনোকালের মতোই সামরিক শাসন আসছে, যাচ্ছে, আবার আসছে। এবং পাকিস্তানের কালে অর্থনীতিতে যে পুঁজিবাদ নির্মম হাতে আপন পথ পরিষ্কার করছিল তার বিকাশ আরো বেশি অবাধ হয়েছে বাংলাদেশের কালে। জনমতের, আবারে সেই জনমতেরই চাপে সমাজতন্ত্র লক্ষ্য হিসেবে চকিতে দেখা দিয়ে আবার অলক্ষ্যে চলে গেছে প্রথম একটু লজ্জা লজ্জা পদক্ষেপ, পরে স্বাচ্ছন্দ্য গতিতে। প্রথমে রাষ্ট্রীয়করণ হওয়ায় যারা সুবিধা পেয়েছিল, পরে বিরাষ্ট্রীয়করণ হওয়ায় তারাই সুবিধা পেল দ্বিতীয় দফা, ঠিক যেমনি পাকিস্তান হওয়ায় যাদের অবস্থা ভালো হয়েছিল তারা আরো ভালো করতে পারল বাংলাদেশ হওয়ায়। পাকিস্তানি বড় ধনীরা অবাঙালি ছিল, বাংলাদেশি বড় ধনীরাও যে ক্রমান্বয়ে অবাঙালি হয়ে পড়ছে ভাষায়, রুচিতে, আকাক্সক্ষায় ও আচরণে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। প্রতিটি সরকারই চেষ্টা করছে দরিদ্রদের সাহায্য করতে, তাতে করে দরিদ্ররা আরো বেশি দরিদ্র হয়েছে। এতে বুঝতে কষ্ট হয় না যে চেষ্টা আসলে কিসের ছিল। পরিবর্তন যা অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ওপরে ঘটেছে, ভেতরে ঘটেনি। ভেতরে ঘটাকেই বিপ্লব বলে, ওপরে ঘটাকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন।

একাত্তরের যুদ্ধ একাত্তরেই থেমে গেল। তবে কেবল ধনীর জন্যই, গরিবের জন্য নয়। ধনীদের রাস্তা শুধু খুলে যায়নি, ক্রমেই প্রসারিত হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পুরোপুরি নিয়োজিত ছিল ওই উদ্দেশ্যেই। কিন্তু গরিবের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্নতর। তাদের যুদ্ধ তখন থামেনি, আজও থামেনি, দিন দিন সে যুদ্ধ তীব্রতর হয়েছে। একাত্তরে আমরা বলেছি যুদ্ধ আমরা চাইনি, যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধের পরে বিত্তহীনদের বেলায়ও ওই একই ঘটনা, যুদ্ধ চাইবে কী, তারা কোনোমতে বাঁচতে পারলে বাঁচে, যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের ওপর। সেদিক থেকে এই যুদ্ধ পাকিস্তানি যুদ্ধের মতোই, কিন্তু প্রকৃত চরিত্র একেবারেই আলাদা। কেননা, এতে অনিচ্ছুক পক্ষ, অর্থাৎ গরিবেরা জিতবে এমন কোনো আশা নেই, তারা আত্মসমর্পণ করে যে বাঁচবে যেমন বেঁচেছিল পাকিস্তানি সেনারা তা সম্ভব নয়। এ যুদ্ধ বাঁচা ও মরার- এতে গোটা ব্যবস্থাটা হচ্ছে দরিদ্রের বিরুদ্ধে। আর তাছাড়া মানুষ তো এখানে ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে না, লড়ছে একা একা। এ যুদ্ধে পঙ্গু হয়ে বাঁচার আশাও নেই, যোদ্ধাদের ধ্বংস মনে হয় একেবারে অনিবার্য। ধ্বংস অন্যায়ের নয়, ধ্বংস ন্যায়ের। এ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াকেও নিশ্চয়ই বিপ্লব বলা যাবে না।

বিরাষ্ট্রীয়করণ ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী পুঁজির অবাধ বিকাশ এমনি এমনি ঘটেনি, প্রত্যেক রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যই ছিল তাদের সবচেয়ে বড় মূলধন। অবাঙালি পুঁজিপতিদের জায়গায় বাঙালি পুঁজিপতিরা বিকশিত হবে এবং অবাঙালি হয়ে যাবে। এছাড়া অন্য রকম কিছু হওয়ার আশা ছিল কি? হ্যাঁ, ছিল। নইলে স্বাধীনতা কেন? স্বাধীনতা কিসের? স্বাধীনতার যুদ্ধে বিত্তবানরা লড়েনি, গরিবরাই লড়েছে। ধনী ঘরের ছেলেরা যখন শরিক হয়েছে যুদ্ধে, তখন তারা আর ধনী থাকেনি, সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তবে তাদের আসতে হয়েছে, শ্রেণিচ্যুত না হলে লড়বার কোনো উপায় ছিল না। যুদ্ধ একটা বনভোজন ছিল না, ছিল না হোটেলের পার্টি। যারা লড়েছে, যুদ্ধে প্রাণ পর্যন্ত দিয়েছে, তাদের জন্যই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা প্রয়োজন ছিল। সে জন্যই তো বিপ্লবের কথা ওঠে।

এ ক্ষেত্রে বিপ্লবের অর্থ একটাই। পুরোনো সমাজ ভেঙে ফেলে তার জায়গায় একটা নতুন সমাজ গড়ে তোলা। এর বাইরে সব কিছুই কথার কথা। নতুন সমাজের কথা শাসকরা অহরহ বলে থাকেন, প্রেসিডেন্ট মার্কোস পর্যন্ত বলেছেন, এমনকি নিজের রাজনৈতিক দলের নাম রেখেছেন নতুন সমাজ আন্দোলন। কিন্তু সে সমাজ গড়তে হলে পুরোনো উৎপাদন ও বিতরণব্যবস্থার জায়গায় যে নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়, সেটা তারা করতে চায় না, বরং চেষ্টা চলে নানা রকমের আওয়াজ তুলে জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে পুরোনো ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার। মার্কোস যা করেছেন, সব স্বৈরশাসকই তা করে থাকেন।

এই বিপ্লবকে সম্ভব করে তোলার জন্য বিপ্লবী রাজনীতি আবশ্যক হয়। বাংলাদেশে সেই রাজনীতিটাই আমরা পাইনি। পাকিস্তানি রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক বিভেদ ছিল, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেটা উঠে গেল ঠিকই, কিন্তু শ্রেণিবিভাজন ভেঙে ফেলা, অর্থাৎ যথার্থ বিপ্লব সম্পন্ন করা। বলাই বাহুল্য, এই রাজনীতি বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। বুর্জোয়াদের পুরোনো রাজনীতিই বহাল রয়েছে। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সঙ্গে এর দ্বন্দ্বটা মৌলিক নয়, সেখানে আপন, সমঝোতা, সংলাপের পথ সবসময়েই খোলা থাকে।

আমরা নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা বলি। ব্যর্থতা কোন দিক দিয়ে, সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণ রাখার ক্ষেত্রে সাফল্যের অভাব ঘটেছে বলা যাবে, কিন্তু আমলাতন্ত্রের সঙ্গে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ক্ষমতার বাইরে থাকলেই কেবল ঘটে, ভেতরে থাকলে সম্পর্কটা গভীর মৈত্রীর এবং বাইরে থাকা অবস্থাতেও দ্বন্দ্বটা সাপে-নেউলের মোটেই নয়। ব্যর্থতা এই দিক থেকে বলা অবশ্য যাবে যে, এই নেতৃত্ব বিদ্যমান ব্যবস্থাকে দক্ষতার সঙ্গে চালাতে পারছে না। লক্ষ্য ঠিকই আছে, যোগ্যতার অভাব ঘটেছে। কেননা, এর চেয়ে অতিরিক্ত কিছু তো নেতৃত্বের কাছে আশা করবার ছিল না। সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবার দায়িত্ব এর নয়, এর লক্ষ্যও ভিন্ন। ব্যর্থতা যদি কারো খুঁজতে হয় তবে তা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের রাজনৈতিক ধারার। সেই রাজনীতি সফল হয়নি।

সফল না হওয়ার কারণগুলো একটা হচ্ছে এই যে, এ দেশের বামপন্থিরা পরিমাণে বস্তুবাদী নন। কোনটা বৈরী দ্বন্দ্বে কোনটা অবৈরী, কোন পরিস্থিতিতে প্রধান শত্রু কে, মিত্রকে সেটা মনে হয় বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। বাস্তব অবস্থার বিশ্লেষণও তারা সঠিকভাবে করতে পারেননি। যে জন্য বারবার তাদের রাজনীতিতে ভুল দেখা দিয়েছে, জনগণের আকাক্সক্ষাকে ধরতে না পেরে কেউ বা অনেক দূরে এগিয়ে হঠকারী হয়েছেন, কেউ পিছিয়ে পড়ে লেজুড় হয়েছেন বুর্জোয়াদের।

শুনলে আজ প্রায় অবিশ্বাস্য দিবাস্বপ্ন মনে হবে, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একদিন সত্যি সত্যি ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ কোনো প্রকার মার্কিন সাহায্য নেবে না। এই ঘোষণায় এক ধরনের অহংকার ছিল। আত্মবিশ্বাস ছিল। সে অহংকার ও আত্মবিশ্বাস তার একার নয়, তা ছিল সকল যথার্থ মুক্তিযোদ্ধার, ছিল নিপীড়িত বাঙালি জাতির। তার পরের ঘটনা খুবই সরল। শেখ মুজিব ফিরে এসে বলেছিলেন যে, মার্কিন সাহায্য নেবেন, তা তাকে অবশ্য শর্তহীন হতে হবে। পরে শর্তটর্ত কোথায় উড়ে গেল, কত বেশি মার্কিন সাহায্য কত দ্রুত পাওয়া যায়, সেটাই হড়ে দাঁড়াল একমাত্র লক্ষ্য এবং এটা নিশ্চয়ই তাৎপর্যবিহীন নয় যে, সেই মুক্তিযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদ, প্রথমে অর্থমন্ত্রীর পদ হারালেন, পরে জেলে গেলেন এবং তার কিছু পরেই নিহত হলেন। এ ব্যক্তির লাঞ্ছনা মাত্র নয়, বক্তব্যের লাঞ্ছনা। আজ তো গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নেশায় পেয়েছে ঋণের। ঋণের জালে জাতীয় স্বাধীনতা আটকা পড়েছে। হয় এ জাল ছিন্ন হবে, নয়তো দড়ি যাদের হাতে তারা টেনে তুলবে। মাছকে যেমন টেনে তোলে, আত্মবিশ্বাসী বীর।

অস্বীকার করার কোনোই উপায় নেই যে দেশে আজ গভীর হতাশা বিদ্যমান। এই হতাশার মূল কারণ দেশ যে ঠিক পথে এগোচ্ছে না এটা বোঝা যাচ্ছে। পুঁজিবাদী পথেই চলেছি বটে কিন্তু সে পথে এগিয়ে যে ব্যাপক জনসাধারণের কোনো উন্নতি হওয়ার আশা নেই তা জানা হয়ে গেছে। দেশ স্বাধীন হয়েছিল মানুষকে স্বাধীন করার জন্যই, মানুষকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানিতে ফেলে দেওয়ার উদ্দেশ্যে নয়।

আজ তাই যা প্রয়োজন সে হলো সমাজ পরিবর্তনের সে লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই দিকে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু সবটাই মূল অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপরে, পরিবর্তন আসা দরকার তার অভ্যন্তরে। তাছাড়া মুক্তির উপায় কী?

আমাদের সমাজে সংস্কৃতির চর্চা আছে, গান-বাজনা, শিল্প-সাহিত্য, যাত্রা-নাটক অল্পস্বল্প হলেও রয়েছে, কিন্তু সাংস্কৃতিক মানের ঊর্ধ্বগতিটা তেমন নেই। শিল্পমাধ্যমগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য আসছে সেটা লক্ষ করা হচ্ছে না। চিন্তাধারা ব্যাপক ও গভীর প্রসারতা লাভ করেনি। অবৈজ্ঞানিকতা এমনকি বিজ্ঞানীদেরও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এ ক্ষেত্রেও দায়িত্ব ছিল মূলত বামপন্থিদেরই। দক্ষিণপন্থিরা তাদের কাজ স্বাভাবিকভাবেই করে যাবে, গোটা শাসনব্যবস্থাটাই তাদের পক্ষে, নগদ পরিতোষিকই বলি, প্রতিশ্রুতি-সম্মানই বলি, সবকিছুই তাদের উসকানি দিচ্ছে, অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে। তা ছাড়া শাসনব্যবস্থা নিজেই তার প্রচারমাধ্যম, তার আমলা-কর্মচারী, তার বিদেশি সমর্থক ও দেশি তাঁবেদার, তার অর্থ ও আনুকূল্য সব কিছুর মধ্য দিয়ে অনবরত কোলাহল করছে প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে। এর বিপক্ষে গেলে লাভের সম্ভাবনা যত কম, ক্ষতির আশঙ্কা তত বেশি। তাছাড়া প্রগতিশীলতা স্বাভাবিক, নয়তো প্রতিক্রিয়াশীলতাই স্বাভাবিক আমাদের পরিবেশে। কেননা প্রগতিশীলতা হচ্ছে স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়ানো। সেটা হচ্ছে মানসিকভাবে নিজেকে স্বাধীন করা। তার জন্য শক্তি লাগে, সাহস লাগে। ব্যক্তিগত ও একক প্রচেষ্টায় এই শক্তি ও সাহস সঞ্চয় এবং সঞ্চিত হলে তার সংরক্ষণ ও প্রবৃদ্ধি কষ্টসাধ্য প্রায় অসম্ভব। সেই জন্য চাই সমষ্টিগত সুসংগঠিত প্রচেষ্টা। আর এখানেই আসে বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকা।

বামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠনগুলো কিন্তু সংস্কৃতির দিকটাকে ভয়ংকরভাবে উপেক্ষা করেছে। তারা রাজনীতি করেছে সংস্কৃতিকে প্রায় বাদ দিয়েই। তারা সাহিত্য তৈরি করেনি, সংগীতে খুব একটা এগোয়নি, নাটক উপস্থিত করেনি, চলচ্চিত্রের কথা ভাবেইনি। এখানেই তাদের বড় দুর্বলতা, প্রাথমিক দারিদ্র্য বলা যায় দার্শনিক দারিদ্র্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যেতে চাচ্ছে তারও একটি কারণ বামপন্থিদের এই সাংস্কৃতিক ব্যর্থতা। ওই যে চেতনা সংগ্রামের, আপসহীনতার, বিজয়ের এবং শ্রেণিচ্যুতির তাকে প্রেরণা হিসেবে দেশজুড়ে পরিব্যাপ্ত করার দায়িত্ব প্রতিক্রিয়াশীলদের নেওয়ার কথা নয়, নেওয়ার কথা প্রগতিশীলদেরই।

কিন্তু ওই চেতনা হারিয়ে গেছে বলা সম্পূর্ণ ভুল বলা হবে। একাত্তরের পরের বাংলাদেশ আর একাত্তরের আগের বাংলাদেশ এক নয়। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাদেশ হওয়া একটি নামের পরিবর্তন শুধু নয়, একটি গুণের আবির্ভাবও বটে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মানুষের জীবনের অভিজ্ঞতার অবস্থানের অংশ হয়ে গেছে। শাসকশ্রেণির প্রতি আস্থা গেছে ভেঙে, তার দুর্বলতা গেছে উন্মোচিত হয়ে। এ উন্মোচন শাসকশ্রেণির নিজের কাছেও বটে। জনতার শক্তিই যে আসল, সে যে পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে, অতিনিষ্ঠুর এবং অতিসুসজ্জিত ও সুশিক্ষিত একটি সেনাবাহিনীকে পরাভূত করতে- এই অভিজ্ঞতা মানুষের চেতনায় আছে বৈকি। সত্য বটে, হতাশা আছে বাংলাদেশে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তো কম বড় দৃষ্টান্ত নয়। ধনবৈষম্য বাড়ছে এবং সত্য বটে, শ্রেণিশোষণ যে পরিমাণে আছে সেই পরিমাণে শ্রেণিসচেতনতা নেই তবে সচেতনতা বাড়ছে বৈ কমছে না এবং ধনবৈষম্য যে দারিদ্র্যের কারণ সেই বোধও ব্যাপকতা লাভ করছে। সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের ওপর জোর পড়ছে, বামপন্থিরা অভিজ্ঞতা থেকে এই শিক্ষা লাভ করেছেন যে, সাংস্কৃতিক মানোন্নয়ন বাদ দিয়ে সমাজবিপ্লবের কাজ কিছুতেই এগোবে না। নতুন সমাজ যে দরিদ্র সাজ হবে না, বর্তমান সমাজের চেয়েও উন্নত সমাজ হবেÑ এই বিশ্বাস বিস্তৃত হচ্ছে। সর্বোপরি, বর্তমান সমাজব্যবস্থা যে চলবে না এই প্রত্যয় দক্ষিণপন্থি ও বামপন্থি উভয়েই ঐকমত্য এবং সেই বোধটা নেতিবাচক। যদিও ইতিবাচকতার পক্ষে যে এর একটা বড় ভূমিকা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং বামপন্থিরাও যেমন জানেন তারা জয়ী হবেন দক্ষিণপন্থিরাও প্রকাশ্যে মানুন না মানুন, অবচেতন মনে হলেও তেমনি জানেন যে দক্ষিণপন্থির ভবিষ্যৎ মোটেই উজ্জ্বল নয় যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :