অর্থাভাবে বন্ধের পথে চিটাগাং অটিস্টিক স্কুল

চট্টগ্রাম ব্যুরো, ঢাকাটাইমস
 | প্রকাশিত : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ০৮:৩৫

একজন প্রতিবন্ধী শিশুর মা নিজের প্রশিক্ষণ আর অভিজ্ঞতা দিয়ে অন্য প্রতিবন্ধীদের সেবা দিতে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। স্বামীর কাছ থেকে অনুদান নিয়ে আট বছর চালিয়েছেন সেই চিটাগাং অটিস্টিক স্কুল। কিন্তু বর্তমানে অর্থর অভাবে সেটি বন্ধের পথে। ব্যক্তিপর্যায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে প্রতিবন্ধীদের এই বাতিঘরটি।

২০০৯ সালে নগরীর বাটালি রোডের বিআরটিসি স্টেশনে কাসেম ভান্ডারির মাজারের উত্তর পাশে ভাড়া ভবনে প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুলটি গড়ে তোলেন প্রধান শিক্ষিকা নাজনিন রোকেয়া। এখন এর ভাড়া বাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার টাকা। স্কুলটির ছয়জন শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের আনা-নেওয়ার জন্য ভ্যানচালকের বেতন দিতে হয়। স্কুলটির আয় বলতে শুধু তিনজন প্রতিবন্ধী শিশুর অভিভাবকের দেয়া মাসিক বেতন।

স্কুলের সিনিয়র সহকারী শিক্ষিকা রেজিয়া আক্তার জানান, এ স্কুলে বর্তমানে ১৪ জন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র তিনজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক মাসে ৩-৪ হাজার টাকা করে দেন। বাকি ১১ জন দরিদ্র পরিবারের প্রতিবন্ধী শিশুকে বিনা বেতনে পড়ানো হচ্ছে।

সহকারী শিক্ষিকা বলেন, তিনজন শিক্ষার্থীর অভিভাবকের কাছ থেকে মাসে ১০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। কিন্তু স্কুলটি পরিচালনায় প্রতি মাসে খরচ হয় ৩৫-৪০ হাজার টাকা। দীর্ঘদিন ধরে এই খরচ বহন করে আসছেন প্রধান শিক্ষিকা নাজনিন রোকেয়ার স্বামী ও পরিচালনা কমিটির সদস্যরা।

পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর সলিমুল্লাহ জানান, প্রধান শিক্ষিকার স্বামী ইকরামুল হাফিজ খান পেশায় ব্যবসায়ী। তার আয় থেকে স্কুলের খরচ বহন করা হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আয় কমে যাওয়ায় ব্যয়ভার বহনে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

সলিমুল্লাহ আরও জানান, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রধান শিক্ষিকার স্বামীর অনুদানের টাকায় স্কুলটি পরিচালিত হলেও সম্প্রতি চরম অর্থসংকটে পড়েছেন তিনি। স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি বা দাতা গোষ্ঠী এগিয়ে না এলে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সমাজকল্যাণ দপ্তরের অনুমোদিত এই প্রতিষ্ঠানটি বছর শেষে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মাত্র ২৫ হাজার টাকা সরকারি অনুদান পায়। এ ছাড়া আয়ের আর কোনো পথ নেই প্রতিষ্ঠানটির। এ ব্যাপারে সরকারি সহযোগিতা পেলে হয়তো প্রতিষ্ঠানটি রক্ষা করা সম্ভব হবে।

আলাপকালে প্রধান শিক্ষিকা নাজনিন রোকেয়া বলেন, ‘আমার একমাত্র মেয়ে নাবিলা হাফিজ খান মুমু জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধী। মুমু কথা বলতে পারে না, কানেও শোনে না, পাশাপাশি তীব্র মাত্রায় অটিজমে আক্রান্ত। তার জীবন নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে সমাজ ও পরিবারের আরও শত শত প্রতিবন্ধী শিশুর জীবন আমাকে তাড়িত করে। এই সংবেদনশীলতা আর সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রতিবন্ধী শিশুদের কষ্ট ভাগ করে নিতে আমি এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করি।’

১৯৯৯ সালের ৭ জানুয়ারি জন্ম মুমুর প্রতিবন্ধিতা আর অটিজমের সঙ্গে নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে নাজনীন রোকেয়া বলেন, ২০০১ সালে চিকিৎসার জন্য মুমুকে ভারতে নিয়ে যান তারা। সেখানে দফায় দফায় নানা প্রশিক্ষণ নিতে হয় তাকে (রোকেয়া)।

রোকেয়া বলেন, ‘মুমুর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাকে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ আর ¯িপচ থেরাপির ওপর প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। পাশাপাশি ওকে জামা-কাপড় পরানো, খাওয়ানোসহ স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত করতে ওকুপেশন থেরাপি আর আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনসরি থেরাপিও শিখে নিতে হয়েছে। এসব শেখার পর দেশে ফিরে তা মুমুর ওপর প্রয়োগ করি। হাতে হাতে ফল না মিললেও এখন মুমু লেখাপড়া তো করছেই, নিজে নিজে কম্পিউটারও চালাতে জানে।’

রোকেয়া বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদান স্বাভাবিক কোনো বিষয় নয়। আলাদা কেয়ার, আলাদা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়, যা মোটেই সহজ নয়। সেই কঠিন কাজটি পরিচালনা করছি আমরা। পড়ালেখার পাশাপাশি এ স্কুলে সবস ধরনের প্রাথমিক থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। এর জন্য কোনো বেতন নেওয়া হয় না।’

স্কুলের পাঠদান সম্পর্কে প্রধান শিক্ষিকা বলেন, স্কুলে পাঠদানের জন্য তিনটি ক্লাসরুম ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে বেলীতে পাঠদান ও কেয়ার করা হয় শিক্ষার্থীদের। দ্বিতীয় পর্যায়ে নয়নতারা এবং তৃতীয় পর্যায়ে জবাতে পাঠদান ও কেয়ার নেয়া হয়। এর মধ্যে যারা ভালো করে তাদের অবস্থাভেদে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। বর্তমানে স্কুলের চারজন শিক্ষার্থী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে বলে জানান তিনি।

দীর্ঘ বছর লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে রোকেয়া বলেন, তিনি বুঝতে পেরেছেন অটিস্টিক শিশুদের মেধা ও যোগ্যতার বিকাশ সম্ভব। অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বাবা-মায়ের মধ্যে যেন এই বিশ্বাসটা জন্মায়। তারা যেন ভেঙে না পড়েন।’

(ঢাকাটাইমস/২৮ডিসেম্বর/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বন্দর নগরী বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা