ছোটগল্প

আগুনের ফণা

রিপনচন্দ্র মল্লিক
| আপডেট : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:২৭ | প্রকাশিত : ২৯ ডিসেম্বর ২০১৬, ১৬:১২

কুয়াশা কেটে যাওয়ার পরে রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে আকাশের নিচে, যখন আমি একা এলোমেলো মনে পাথর বিছানো পিচঢালা দীর্ঘ রাস্তায় হেঁটে চলেছি। ঠিক তখনই পাখিটিকে প্রথম আমার চোখে পড়লো।

ওদিকে আমার চোখ পড়তেই, কিছু হালকা ঠান্ডা বাতাস এসে আমার গায়ে লাগলো। শিরশির করে বয়ে আসা হিম বাতাসে আমি কিছুটা শিউরে উঠি।

গাঢ় সবুজ রংয়ের টিয়ে পাখিটি শুষ্ক রক্তাক্ত নিথর দেহে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। পাখিটির পা দুটির হাঁটু আদর্শলিপি বইয়ের ব্যঞ্জন বর্ণের ‘দ’ বর্ণের মতো করে কিছুটা ভাঁজ হয়ে কুঁকড়ে গেছে।

লাল টকটকে মুখটির দুই ঠোঁট আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। চোখ দুটি দেখতে ঠিক তিন দিন হাড়িতে জমিয়ে রাখা তালের রসের মতো হয়ে গেছে। এমন গাঢ়ো কুয়াশার মতো যে পাখিটির প্রায় বুজে আসা দুই চোখের পাতা দেখলেই তা বোঝা যায়। কিংবা প্রায় বুজে আসা পাতার ফাঁক গলে যেটুকু চোখ দেখা যায়, তাতেই ব্যাপারটি শরতের আকাশের মতোই ঝকঝকে, ফকফকে দেখায়।

পাখিটিকে কেন্দ্র করে আমার মনে হঠাৎ কিছু প্রশ্ন চলে আসে, যা আগে কখনো মনে করতে পারিনি। অথবা মনে পড়েনি। অথবা বলতে পারি মনে করার মত কোন চেষ্টাই আমি কখনো করিনি।

ভাবতে থাকি আকাশ থেকে পাখিটি কী উড়তে উড়তে হঠাৎ ধপাস করে পাথর বিছানো এই পিচ ঢালা রাস্তায় পড়ে গেছে?

আবার ভাবি না তো। এভাবে তো পাখিটির উড়তে উড়তে পড়ে যাওয়ার কথা নয়। তাহলে কী নিহত হওয়ার আগে পাখিটি কোন গাছের মগডালে কারো প্রতিক্ষায় বসেছিল? এভাবে মরে যেতে হবে পাখিটি কী কখনো সে কথা বুঝতে পেরেছিল? নাকি সে বুঝতে পেরে পালিয়ে বেঁচে থাকার জন্য দ্রুত গতিতে উড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল? অথবা সত্যি সত্যিই ঘটনাটি পাখিটির পুরোটাই অজান্তে ঘটে গেছে।

ভোরের হালকা গাঢ় কুয়াশা মাখা প্রকৃতিতে অথবা রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে আকাশের নিচে সুবজ পালকে ঢাকা পাখিটি কত রকমের রঙিন স্বপ্ন চোখে কিংবা বুকে নিয়ে উড়েছিল।

অথচ পাখিটি কিভাবে নিহত হয়েছে কিংবা কারা মেরে ফেলেছে আমরা সেই খবর রাখা তো অনেক দূরের কথা, পাখিটিকে নিয়ে একটু ভেবে দেখার মত সামান্য সময়টুকু আমরা কখনো পাই না।

অথবা কথাগুলো আমরা অন্যভাবেও বলতে পারি যেমন, পাখিটি কিভাবে নিহত হয়েছে কিংবা কারা মেরে ফেলেছে, সে কথা ভেবে দেখার সময়টুকু কখনো আমরা পেতে চাই না। আমরা ভাবি সামান্য একটি পাখির মরে যাওয়া অথবা খুন হয়ে যাওয়া এ আর এমন কী গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা!

শুধু চোখের পলকে একটু দেখা বলেই হয়তো কারো কারো বুকের ভেতরে পাখিটির জন্য একটু আধটু আফসোসের দুলুনি লাগছে।

এই তো অনেক বেশি। আমার মতো হয়তো আরো কারো কারো মনে একটু আধটু আফসোসের দুলনি লেগেছে বা লাগতে পারে।

তবে তার সংখ্যা যে খুব বেশি হবে না, সে কথা আমি মোটা হরফেই বলতে পারি।

আমরা এখন আর কখনো জানতে চেষ্টা করি না মায়ের পিছে পিছে রাস্তার ওপাশ থেকে হেলে দুলে নেচে নেচে দৌড়ে আসার সময়ে রাস্তার মাঝে কুচকুচে কালো রঙের কুকুর ছানাটি রক্তাক্ত দেহে চিরতরে কেন ঘুমিয়ে পড়েছে?

নাকি কুকুর ছানাটিকে কেউ চাপা দিয়ে মেরে ফেলেছে অথবা পিটিয়ে মেরে কেউ রাস্তায় ফেলে রেখেছে?

অথচ মা কুকুরটির পেছনে হেলে দুলে হাজারো স্বপ্ন চোখে বুকে নিয়ে নিমিষেই কুকুর ছানাটির চোখের ও বুকের সমস্ত স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল।

আমার চারপাশের মানুষগুলো কখনো সেই খবর রাখে না। কুকুর ছানাটির মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গেলে তো কোন লাভ নেই। তার চেয়ে বরং আমরা কোন চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘন্টা রাজনীতির মাঠ কাঁপিয়ে তুলতেই ব্যস্ত থাকি। কোন নেতা কী ছিল। ক্ষমতায় আসার কয়েক বছরের মধ্যেই অঢেল সম্পদের মালিক হয়ে গেল। কিংবা অমুক নেতার পেছনে সময় দিতে দিতে জীবন শেষের পথে, কিন্তু সে আমাকে কিংবা আমাদের জন্য কিছুই করলো না। এমন আক্ষেপের সুরও চায়ের টেবিল গরম ধোঁয়ার ফনা তুলতে থাকে। কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলায় জিতে যাওয়ার কিংবা হেরে যাওয়ার প্যাঁচালেই নিজেদের মগ্ন রাখতেই ভালোবাসি। এইসব আলোচনার মধ্যে রাস্তার উপরে একটি কুকুরের ছানার নিহত হওয়ার কথা অনুভব করার সময় পাই না।

অথবা, আমরা তা কখনোই অনুভব করার কোন চেষ্টাও করি না। তবে হয়তো কখনো কখনো কেউ কেউ স্বেচ্ছায়, স্ব-প্রণোদিত হয়ে অনুভব করার চেষ্টার শুধু ভান করে থাকি।

অথবা আমরা এখন আর কখনোই খোঁজ নিয়ে দেখতে চাই না, পথের পাশে পেট ভর্তি ডিম নিয়ে থপ থপ করে লম্বাটে লেজ মাটিতে/দুর্বায়/জঙ্গলে লতা পাতায় লেপ্টে লেপ্টে হেঁটে চলা নিরহ গুই সাপটিকে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠে কারা মেরে ফেলেছে?

অথবা মেরে ফেলার সময় কেউ কী কোন বাঁধা দিয়েছিল, নাকি মুখে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে অন্য মানুষগুলো হত্যাকান্ডের দৃশ্য দেখতে দেখতে ধীর গতিতে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছিলো, আর বলছিলো ‘মার গুইডারে জোরে জোরে পিডাইয়া মার। শালারা এলাকার কোন খাল বিল, পুকুরের মাছ বাঁচতে দেয় না। সব খাইয়া ফেলায়। মার পিডাইয়া মার।’

লোকগুলোর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো, মানুষ পুকুর কিংবা নদী খাল বিল থেকে মাছ ধরে রসালো স্বাদে রান্না করে খাবে, এটা তার অধিকার।

আবার গুই সাপেও খাল, বিল কিংবা নদী ও পুকুরের জলে ডুবে ডুবে সাঁতার কেটে ছোট/অতি ছোট/বড়/মাঝারি সাইজের তরতাজা কাঁচা মাছ কচকচিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকবে।

গুই সাপেরা বেঁচে থাকার জন্য খাল, বিল কিংবা নদী, ডোবা নালা ও পুকুরের জলে সাঁতার কেটে কেটে লেজটাকে হেলিয়ে দুলিয়ে নেচে নেচে মাছ শিকার করে তাদের খাবার হিসেবে খাবে, এটা তাদের অধিকার। তাতে মানুষের এতো আপত্তি কিসের? এখানে তো কোন আপত্তি থাকার কথা নয়।

আমরা কী কখনো ভেবে দেখেছি বন জঙ্গলের ডালপালায় কত স্বপ্ন নিয়েই পাখ পাখালিরা বেঁচে আছে। কখনো কী বুঝতে চেষ্টা করি পাখিদেরও আছে প্রেমিক-প্রেমিকা। মা, বাবা, ভাই, বোন। তাদেরও আছে স্বামী স্ত্রী সন্তান।

যখন সন্ধ্যা নেমে আসে, তখন পাখিরাও আগামী দিনের রঙিন স্বপ্ন দেখতে থাকে। তাদের চোখে ও বুকে স্বপ্নরা ঝিলমিল ঝিলমিল করে দোল দুলিয়ে হেসে ওঠে। কে জানে অথবা আমরা কী কেউ জানি গুলি খেয়ে কোন গাছের মগডাল থেকে ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগে, হয়তো সবুজ পালকে ঢাকা পাখিটি তার প্রিয় সন্তানের খাবারের খোঁজে বাসা ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েছিল।

কিংবা কুয়াশার কেটে যাওয়ার পরে রৌদ্রজ্জ্বল ঝকঝকে কোমল প্রেমের হাওয়ায় দুলতে দুলতে সে তার প্রিয় সঙ্গী খুঁজে ফিরছিল।

অথবা তার হারিয়ে ফেলা সন্তানকে ডানা মেলে খুুঁজতে বেরিয়েছিল। অথচ আমরা মনের আনন্দে পাখিটিকে দেখে শখের গুলি ছুড়ে কী সহজেই মেরে ফেলি। দিনে কিংবা রাতে ট্রাক চাপায় মরে যাওয়া সন্তানের লাশের পাশে বসে, যখন মা কুকুরটি কেঁদে কেঁদে ক্লান্ত হয়ে কোথায় যে চলে গেল, আমরা একবারো কী কুকুরটির দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখেছি!

অথবা গাড়ির চাকার চাপে রাস্তার সাথে কুকুর ছানাটি থেতলে মিশে গেল। আমরা কী কেউ কোন দিন ভেবে দেখেছি সন্তানহারা মা কুকুরটি প্রসবকালীন ব্যথার মতো শোকে কেন পাগল হয়ে গেল।

আমরা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা মা কুকুরটিকে দেখে একে অন্যকে বলাবলি করি‘এই কুকুরটি পাগলা কুকুর। যাকে তাকে সময় অসময়ে কামড় বসিয়ে দেয়। সাবধান, সবাই কুকুরটি থেকে সাবধান।’

কুকুরটির ভাষা বুঝতে না পেরে আমরা তখন পৌরসভায় খবর দেই। ‘কুকুর নিধন প্রকল্প’ বাস্তবায়ন পৌর মেয়রের খুব গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

গুরুত্বপূর্ণ এই অর্থে আমরা বলে থাকি যে নাগরিক জীবন যাপনে পৌর কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে জন্ম সনদ/মৃত্যু সনদ গ্রহণ করা ছাড়া নাগরিকদের পৌর মেয়রদের কাছে তেমন আর কোন সেবা গ্রহণের আকাঙ্খা নেই। কিংবা তারা এখনো আর কোন সেবা দাবিও করে না।

আমরা যারা দেশের সাধারণ নাগরিক আছি মেয়রের কাছে তাদের আর কোনো সেবা পাওয়ার চাহিদা নেই। যদিও কোন সেবার চাহিদা থেকে থাকে সে সেবা পূরণে মেয়রের কোন মাথা ব্যথা নেই। ফলে আমরা এখন এমন অবস্থায় আছি যে আমাদেরও কোন চাওয়া পাওয়া নেই। আমরা এখন মেয়রের উপরে নির্ভরশীল। সে যে সেবা দেবে, সেটুকুতেই আমরা সন্তুষ্ট।

যাই হোক খবর পেয়ে পৌর মেয়রের নির্দেশে দলবল নিয়ে ‘কুকুর নিধন বাহিনী’ লোহার তৈরী সাড়াশি নিয়ে অভিযানে নেমে পড়ে।

বাহিনীর হাতে লোহার তৈরি সাড়াশি অথবা ‘চেঙ্গি’ দেখেই কুকুরগুলো বুঝতে বেশি সময় নেয় না।

‘কুকুর নিধন বাহিনী’কে দেখলেই কুকুরগুলো মৃত্যু ভয়ে এদিকে ওদিকে পালাতে শুরু করে। কিন্তু ওরা তো নাছোড়বান্দা। ধাওয়াতে ধাওয়াতে এক সময় কুকুরটির গলায় সাড়াশি দিয়ে খপ করে ধরে ফেলে। তখন কুকুরের সে কী করুণ দাপাপি আর ঘেউ ঘেউ চিৎকারের কান্না। উহ!

মৃত্যুর এমন জটিল ফাঁদে আটকে পড়ে ভীষণ করুণ আর্তনাদে নানা রংয়ের কুকুরগুলো কাঁদতে থাকে।

সাঁড়াশির চাপে ব্যথায় কুঁকুরে কেঁদে কেঁদে আটকে পড়া কুকুর যেন বলতে থাকে-‘আমাকে কেন আটকে ধরে মেরে ফেলছো? আমি তোমাদের কী এমন ক্ষতি করেছি? আমি তো তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি। আমাকে মেরো না। ছেড়ে দাও। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও।’

কিন্তু ওই ‘কুকুর নিধন বাহিনী’র মনে কুকুরের প্রাণভিক্ষার ভীষণ করুণ আর্তনাদ/প্রাণপণ ছুটে যাওয়ার সে চেষ্টা/চোখের জল, একটুও দয়া-মায়া/করুণার ছায়া কখনই ফেলে না।

হত্যাকান্ডের এমন নিষ্ঠুর দৃশ্য ও কুকুরের করুণ আর্তনাদ শুনে কখনো কখনো কোন সরল বিশ্বাসী মানুষের মন বেদনায় হয়তো বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।

তো যে গল্প বলছিলাম-খবর পেয়ে নিষ্ঠুর ‘কুকুর নিধন বাহিনী’ চলে আসে। নিজের চোখে প্রিয় সন্তানের মরে যাওয়ার দৃশ্য দেখার শোকে পাগল হয়ে যাওয়া সাদা কালো রঙয়ের মা কুকুরটিকেও সাড়াশি দিয়ে আটকে ফেলে।

শুধু কী আটকে ফেলে!

সীমিত সংখ্যক সদস্যের বাহিনীটি একটি লোহার সাঁড়াশি দিয়ে (সাঁড়াশিটিকে আমরা মৃত্যুর পরোয়ানা বলতে পারি) সন্তান হারানো শোকে মুহ্যমান মা কুকুরটির গলা এবং অন্য একটি সাড়াশি দিয়ে শরীরের পেছনের অংশে চেপে ধরে আটকে ফেলেই ইনজেকশন পুশ করে দেয়।

এরপর শুধুই দাপাদাপি!

আর্তনাদ!!

চিৎকার!!!

অনেক দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখা যায় মরতে থাকা কুকুরটির কিছু প্রতিবেশি কুকুর, পরিচিত কুকুর কিংবা বন্ধু কুকুর তাদের স্বজন হারানোর ব্যথায় কুঁকরে কুঁকরে দু-একটি হাকডাক দেয়।

কিন্তু ওই প্রতিবেশি কুকুর, পরিচিত কুকুর কিংবা বন্ধু কুকুরগুলোর বেশিক্ষণ তাদের সেই হাক ডাক থাকে না। প্রাণ ভয়ে তারাও পালিয়ে যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মা কুকুরটি দাপাতে দাপাতে, চিৎকার চেঁচামেচি করতে করতে চোখের সামনেই ঢলে ঢলে মরে যায়। কিন্তু কুকুরটি কেন পাগল হয়েছে? আমিও কখনো ভেবে দেখি না?

আমাদের কাছে সময়ের খুব বড় অভাব। এখন জীবনের চেয়ে আমাদের কাছে সময় অনেক বেশি দামী।

গ্রামের মেঠে পথে দল বেঁধে কিশোরেরা, যখন ডিমওয়ালী গুই সাপটিকে বাতাসে উল্লাস ধ্বনি ভাসিয়ে খেলতে খেলতে ধাপুস, ধুপুস শব্দে পিটিয়ে মারলো, আমরাও কিশোরদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গুই সাপটির ধীরে ধীরে মরতে থাকার দৃশ্য দেখে দেখে আনন্দ করেছি। শুধু আনন্দ বলা ঠিক হবে না।

আমাদের বলা উচিত শুধু মাছ খাওয়ার অপরাধে গুই সাপটির পরিকল্পিত এই হত্যাকান্ডের আনন্দ উৎসব করেছি।

যখন গুই সাপটিকে উল্লাস ধ্বনিতে গণপিটুনি দিয়ে মারা হচ্ছিল, তখন গুই সাপটি পালিয়ে বেঁচে থাকার জন্য সে কী চেষ্টাই না করেছে। কিশোরেরা যখন হাতের লাঠি দিয়ে গুই সাপটিকে সজোরে এক বারি দেয় সাপটি একটু ফোঁস করে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করে। আবার যখন আরেকটি বারি দেয়Ñতখন সে একটু লাফ দিয়ে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করে। ঠিক তখনই অন্য এক কিশোর পিছন থেকে মাথায় সজোরে এক আঘাত বসিয়ে দেয়। সেকি ভীষণ জোরে আঘাত। আঘাতের ব্যথায় গুই সাপটি মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। তার মাথা ফেটে কলকলিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসতে শুরু করে।

তখনই আরেক জন কিশোর ধাপুস ধুপুস শব্দে গুই সাপটির পেটে, পিঠে দুই/তিনটি সজোরে লাঠির বাড়ি বসিয়ে দেয়। এতো জোরে সে বাড়ি এসে গুই সাপটির গায়ে লাগে, যেন লাঠির এক একটি বাড়ির আঘাত মনে হয় যেন এক একটি হাড্ডি ভেঙে যাওয়ার ব্যথার সমান।

এরপর আর কেউ থামে না। কিশোরের দলে যে কয় জন আছে। সবার হাতে বৃষ্টির ফোটার মতো চলতে থাকে ধাপুস, ধুপুস। ধাপুস, ধুপুস। ধাপুস, ধুপুস। এক সময় কিশোরদের চোখে পড়ে রক্তাক্ত নিথর গুই সাপটির পেট ফেটে সাদা সাদা ডিম বেরিয়ে আসছে। প্রথমে একটি ডিম। তারপরে আরেকটি। তারপরে আরো অনেকগুলো ডিম। ডিমগুলো দেখেই কিশোরেরা হৈ-হৈরৈ-রৈ চিৎকারে লাফিয়ে ওঠে। যেন ঈদের চাঁদ ওঠার মতো, আনন্দ যেন অন্তরে আর ধরে না। এমন খুশির জোয়ার যে, তাদের চিৎকার চেঁচামেচিতে এক এলাকার সমস্ত মানুষ জড়ো হয়ে যায়।

আমরা এখন একটি গুই সাপকে পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলাকে খেলা হিসেবেই শুধু মেনে নেইনি, দিনে দিনে আমাদের কাছে তা এখন আনন্দ উদযাপনেরও একটি উৎসবই হয়ে উঠেছে। অথচ এইসব হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র আমাদের হাতে আইনের লাইন ধরিয়ে দিয়েছে। আমরা কী কেউ তা নিয়ে ভাবি।

আমরা আসলে এসব নিয়ে এখন আর কেউ কিছু ভাবতে চাই না। ভাববোই বা কেন? নিজেরাই তো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ততায় মগ্ন থাকি। যেখানে প্রতিদিনই একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে।

সকালে এখানে কেউ খুন হচ্ছে, দুপুরে ওখানে কেউ খুন হচ্ছে। আবার বিকেলে সেখানে কেউ খুন হচ্ছে। খুনের সাক্ষী থেকে রাতকেও আমরা কখনোই বাদ দিতে পারি না। আমরা এখন আর খুনি শ্রেণির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি না।

আমাদের নিম্নবিত্ত কিংবা দরিদ্র জীবন এখন সবুজ পালকে ঢাকা টিয়ে পাখি, কুচকুচে কালো কুকুরছানা আর পেট ভর্তি ডিমওয়ালী গুই সাপ।

আমাদের প্রতিবাদের ভাষা এখন বোবা হয়ে গেছে। যেন বরফের স্তুপে জ্বালানো সেই নেতিয়ে পড়া আগুন ফনা। যে এখন দাউ দাউ করে জ্বলতেও পারে না, নিজেকে জ্বালাতেও পারে না। আমি নিজেও ক্রমশ সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি। তবুও আমার চোখের কোনে আগুনের ফনা ফোঁস ফোঁস করে জ্বলে উঠছে।

লেখক: গল্পকার ও সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :