গোলাম আযমের অনুসারীরাই লিটনের খুনি: স্ত্রী

উত্তম সরকার, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:১৬ | প্রকাশিত : ০৩ জানুয়ারি ২০১৭, ২১:১৩

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের শাহবাজ মাস্টারপাড়া গ্রামে এমপি লিটনের যে বাড়িটি কর্মী সমর্থকদের উৎফুল¬ পথচারণায় এক সময় মুখর হয়ে থাকতো সেই বাড়িটিতে এখন সুনসান নীরবতা। ওই বাড়িতে এখন এমপি লিটনের কবর জিয়ারত করতে এবং ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে আসা শোকার্ত মানুষের ভিড়। সামিয়ানাজুড়ে চলছে কোরআনখানি ও কাঙালিভোজ পর্ব। গোটা বাড়িতেই পুলিশ র‌্যাব সদস্যদের ভিড়।

মঙ্গলবার বাড়ির সামনে সেই প্রিয় গাবগাছ তলায় উপস্থিত ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকদের অনুরোধে লিটনের শোকে মুহ্যমান অসুস্থ স্ত্রী ও জেলা আওয়ামী লীগ নেত্রী খুরশিদ জাহান স্মৃতি কিছুক্ষণ কথা বলেন। শোকাহত এই ঘটনার পর এই প্রথম এমপির স্ত্রী মুখোমুখি হলেন সাংবাদিকদের।

স্মৃতি বলেন, ‘১৯৯৮ সালের ২৬ জুন সুন্দরগঞ্জ ডি ডাবি¬উ ডিগ্রি কলেজ মাঠে জামায়াত-শিবির আয়োজিত জনসভায় গোলাম আযমের বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল। সেসময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এই সভা পণ্ড করে দিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ লিটন তার বন্দুক হাতে কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ওই জনসভায় প্রবেশ করে গোলাম আযমকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়েন। এতে জনসভাটি পণ্ড হয়ে যায়। ফলে সেই থেকে জামায়াত-শিবিরের ক্যাডার বাহিনী লিটনকে যেকোনো মূল্যে হত্যার টার্গেট করে রেখেছিল।’

লিটনের স্ত্রী বলেন, ‘সেসময় তার গুলিতে আহত জামায়াতের ফতেখাঁ গ্রামের ক্যাডার হেফজসহ আরও দুর্ধর্ষ জামায়াত ক্যাডাররা লিটনকে মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠিয়ে এবং ফোনে দীর্ঘদিন থেকেই হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল।’

৩১ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় গুলি করে এই নির্মম হত্যা ওই ঘটনারই জের বলে উলে¬খ করেন স্মৃতি। তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেন, ‘ওই গোলাম আযমের অনুসারী জামায়াত-শিবিরের খুনিরাই আমার স্বামীকে হত্যা করেছে।’ তিনি মর্মান্তিক এই হত্যার বিচার চান এবং দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্মৃতি বলেন, ‘২০১৫ সালের ২ অক্টোবর ভোরে শিশু শাহাদত হোসেন সৌরভকে গুলি ছোঁড়ার একটি পরিকল্পিত মিথ্যা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এমপি লিটনের লাইসেন্সকৃত রিভলবার ও শর্টগান জব্দ করে নেয়া হয়। খুনি জামায়াত-শিবির চক্র জানতো তার বাড়িতে তাদের প্রতিরোধ করার মতো কোনো অস্ত্র নেই। সেই সুযোগে তারা বাড়িতে এসে পরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করতে সাহসী হয় খুনিরা।’

এমপি লিটনের স্ত্রী জানান, প্রতিদিন বিকালে অনেক নেতাকর্মী বাড়িতে থাকতেন। এছাড়া তার বাড়িতে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা ছিল রাতে। সাধারণত সন্ধ্যার আগেই নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে এমপি লিটন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে বামনডাঙ্গা রেল স্টেশন সংলগ্ন তার অফিসে গিয়ে বসেন এবং রাত ৯টা থেকে ১০টা অবধি সেখানে থাকেন। কিন্তু কেন জানি সেদিন কোনো নেতাকর্মী তার বাড়িতে ছিল না সে জানেন না এমপির স্ত্রী।

তিনি জানান, বাড়িতে শুধু তিনি তার ভাই সৈয়দ বেদারুল আহসান বেতার, ভাগ্নি শিমু, চাচি স্মৃতি খাতুন এবং বাড়ির কেয়ারটেকার ইসমাইল, ইউসুফ ও সৌমিত্র ছিল। এসময় তিনি ও তার ভাই বাড়ির উঠোনের রান্না ঘরের কাছে ছিলেন। সেসময় গুলির শব্দ শুনতে পান এবং লিটন ঘর থেকে বাড়ির ভেতর দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে বলেন, ওরা আমাকে গুলি করেছে, আগে ওদের ধরো। এসময় তিনি বুকে হাত দিয়ে ছিলেন এবং বুকের বাম পাশ দিয়ে রক্ত ঝরছিল। বাড়ির সামনে ড্রাইভার এমপির চিৎকার শুনে এবং আততায়ীদের ছুটতে দেখে গাড়ি নিয়েই তাদের ধাওয়া করেন।

তিনি জানান, আহত লিটনকে সাথে নিয়ে তিনি, ইসমাইল ও বেতার গাবগাছ তলায় বেরিয়ে আসেন। সে সময় আহত লিটন দাঁড়িয়ে থাকতেও পারছিলেন না। ড্রাইভার ও গাড়ি না থাকায় একটি মোটরসাইকেলের মাঝখানে বসিয়ে আহত লিটনের কথামত তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এসময় ড্রাইভার এসে পড়লে সেই গাড়িতে চড়েই প্রতিবেশী নয়ন ও রেজাউল এবং বেতারসহ এমপি লিটনকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেন বলে জানান স্মৃতি।

এমপির স্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘সুন্দরগঞ্জে দলীয় কোনো কোন্দল নেই। লিটন এমপি হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। তবে তার একমাত্র শত্রু ছিল স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির চক্র। যাকে তিনি আওয়ামী লীগের আদর্শে অনুপ্রাণিত রাজনীতিতে কোণঠাসা করে ফেলেছিলেন। যার প্রতিশোধ তারা এই ত্যাগী নেতার রক্ত ঝরিয়ে নিয়েছে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এমপির শ্যালক সৈয়দ বেদারুল ইসলাম বেতার কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘যে দুই খুনি এমপি লিটনের সাথে কথা বলার অনুরোধ জানিয়ে তার সাথে ঘরে ঢোকেন তারা গিয়ে সামনের সোফায় বসে পড়েন। খুনি দুজনের মুখ খোলা থাকলেও মাথা ও কান মাপলারে ঢাকা ছিল এবং তাদের পরনে ছিল কালো জ্যাকেট ও কালো প্যান্ট। তারা বহিরাগত ছিল না, কারণ তারা গাইবান্ধা এলাকার আঞ্চলিক ভাষা দিয়ে কথা বলছিল।’

তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, ‘গুরুতর আহত লিটনকে নিয়ে যখন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাচ্ছিল তখন তার শেষ দুটো কথা ছিল, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। তার অক্সিজেনের দরকার। এরপর তিনি চিৎকার করে স্ত্রী স্মৃতিকে বলেন, স্মৃতি হাসপাতাল আর কতদূর। এটাই তার শেষ কথা। এরপর তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।’

লিটনের কবর জিয়ারত করেছেন কাদের সিদ্দিকী

কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রধান বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী মঙ্গলবার তার দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে এসে এমপি লিটনের কবর জিয়ারত করেন। পরে লিটনের স্ত্রী এবং ঘনিষ্ঠ আর্ত্মীয়-স্বজনদের সাথে সাক্ষাৎ করে গভীর শোক জ্ঞাপন করেন।

উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের মতো সরকার দলীয় একজন সংসদ সদস্য যদি তার নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে খুনিদের হাতে নিহত হন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা কোথায়? অথচ সরকার বলছেন, দেশে কোনো সমস্যা নেই, অশান্তি নেই, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাকি অনেক উন্নত।’

তিনি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করে ন্যায্য বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।

গাইবান্ধার আলোচিত সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন শনিবার সন্ধ্যায় সুন্দরগঞ্জের নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দ্রুত রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়। রাত সাড়ে ৭টায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

(ঢাকাটাইমস/০৩জানুয়ারি/প্রতিনিধি/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :