দায়িত্বহীনতা আর জবাবদিহির অভাবে পাঠ্যবইয়ে ভুল

মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:০৫ | প্রকাশিত : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:২৫

বছরের প্রথম দিন উৎসব করে শিশুদের হাতে বই তুলে দিতে পারার সাফল্য ম্রিয়মাণ হয়ে গেছে পাঠ্যবইয়ের নানা ভুল-ভ্রান্তির কারণে। এ নিয়ে দেশে বইছে সমালোচনার ঝড়। সমালোচনা আছে বর্ণ শেখাতে গিয়ে লিঙ্গবৈষম্যের, তেমনি আছে হাস্যকর ছবি ছাপানোর। প্রচলিত একটি কবিতার লাইনে শব্দ উলট-পালট, ভুল ইংরেজিতে বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ছাপানোর ‘গুরুতর অন্যায়’ও আছে। এসব ভুল আর অন্যায়ের পেছনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতা আর জবাবদিহি না থাকাকে দায়ী করছেন বিশিষ্টজনরা।

পাঠ্যবইয়ের ভুলের তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার দাবি উঠছে জোরালোভাবে। দাবি উঠছে এসব ভুল সংশোধনের। তা না হলে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা ভুলই শিখতে থাকবে, যা সারা জীবন বইয়ে বেড়াবে তারা।

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্রে জানা গেছে, একটি বই চূড়ান্তভাবে প্রকাশের আগে অনেকগুলো ধাপ পার হতে হয়। তাতে এ ধরনের ভুল কী করে ছাপা হয়, তাও প্রশ্নের উদ্রেক করে। নানা সমালোচনার মুখে এনসিটিবি অবশেষে একটি পর‌্যালোচনা কমিটি গঠন করেছে।

বই অনুমোদনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে এনসিটিবি সূত্র জানায়, লেখক প্যানেল, সম্পাদনা প্যানেল, পরিমার্জন প্যানেল- এই তিন ধাপ শেষে প্রাথমিক স্তরের বইগুলো দেয়া হয় এনসিটিবির প্রাথমিক উইংয়ের প্রধানের কাছে। তিনি বইগুলোর ভুলভ্রান্তি যাচাই করে তারপর অনুমোদন দেন। এরপর এটি প্রাথমিক স্তরের জাতীয় কমিটি ন্যাশনাল কারিকুলাম কমিটিতে (এনসিসি) যায়। এই কমিটি বইগুলো চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। এনসিসি আছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ শিক্ষাবিদরা। আর এনসিটিবির প্রাইমারি উইংয়ের প্রধান হলেন অধ্যাপক আব্দুল মান্নান। এনসিসির অনুমোদনের পর বই সিডি আকারে ছাপাখানায় যায়।

এখানেই শেষ নয়, বই ছাপার আগে এনসিটিবির একটি কমিটি ‘ট্রাই আউট’ করে। তারা স্কুলের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পাঠ্যবই সম্পর্কে। এখানেও কোনো ভুলভ্রান্তি ধরা পড়লে সংশোধনের সুযোগ থাকে। এতগুলো ধাপ পেরিয়ে কীভাবে পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকে, এ নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকের সঙ্গে খোদ এনসিটিবির কর্মকর্তারাও। এ নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া ও দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দরকার বলে মনে করেন তারা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনসিটিবির এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এমন ভুল মানা যায় না। দায়িত্ব নিয়ে কাজ না করা, আর দায়সারা গোছের কাজের কারণে পাঠ্যবইয়ে এই ভুল।’

ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘এনসিটিবির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থায় জাতীয় প্রয়োজনের কাজ হয়। বই প্রণয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুধু চাকরি বিবেচনায় করলে হয় না, শতভাগ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু এখানে অনেকে আসেন শুধু চাকরি করতে, দায়িত্ব পালনের জন্য নয়।’ তাদের চিহ্নিত করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

প্রায় একই মন্তব্য প্রতিধ্বনিত হয় শিক্ষাবিদদের বক্তব্যেও। তবে পাঠ্যবইয়ে এমন ভুলের জন্য তারা এনসিটিবির কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতা ও জবাবদিহি না থাকাকেও দায়ী করছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ওখানে (এনসিটিবি) কোনো জবাবদিহি নেই। সেই সংস্কৃতি গড়েও ওঠেনি। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে পাঠ্যবইয়ে গুরুতর ভুল হয়েছে।’

‘পাঠ্যপুস্তকে ভুল হবে- এটা মেনে নেয়াই যায় না’ উল্লেখ করে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটি শব্দ ভুল হলে শিক্ষার্থীরা সারা জীবন ওই ভুল শিখবে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এক প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক বিষয় পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। আমার কাছে মনে হয়েছে হেফাজতিদের চাপে এটা করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে হেফাজতিদের সঙ্গে আপোষ করা হয়েছে।’ এসব কাজে জড়িতদের খুঁজে বের করে শাস্তির দাবি জানান তিনি।

এ ছাড়া ইংরেজি মাধ্যমের মূল ধারার বইয়ে কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় হাতাশা ব্যক্ত করেন এই ইমেরিটাস অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যারা পড়ে, তারা কিন্তু কোনো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। তাদের বইয়ে পরিবর্তন হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো মূল ধারার ইংরেজি বইয়ে। এই বইগুলো অনেক দিন ধরে একই ধারায় চলে আসছে। ফলে শিক্ষার্থীরা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিখতে পারছে না। তারা পিছিয়ে যাচ্ছে।’

বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে ভুলত্রুটি পার‌্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে এনসিটিবি। তবে ভুলত্রুটি পরিকল্পিত কি না তা এখনো নিশ্চিত নয় সংস্থাটি।

এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নিজেদের মধ্যে পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা দেখব পাঠ্যবই প্রণয়নে কোন স্তরে ভুলগুলো হয়েছে। সে বিষয় আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপনা করব।’ পরবর্তী নির্দেশনার আলোকে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান অধ্যাপক নারায়ণ।

এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক সাহা বলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের ভুল পরিকল্পিত কি না সে বিষয়ে আমরা এখনই কিছু বলতে পারছি না। তবে সবকিছু মাথায় রেখেই আমরা বিষয়টি পর‌্যালোচনা করছি।’

ভুলত্রুটি পর্যালোচনার জন্য এনসিটিবির সদস্য (অর্থ) কাজী আবুল কালামকে প্রধান করে গঠিত তিন সদস্যের কমিটির অন্যরা হলেন- এনসিটিবির ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম ও গবেষণা কর্মকর্তা সহযোগী অধ্যাপক শাহ আলম।

যেসব ভুল পর্যালোচনায় কমিটি

নতুন বছরের প্রথম দিন সারা দেশে উৎসব করে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে নতুন পাঠ্যবই দেয় সরকার। শিক্ষার্থীদের হাতে যাওয়ার পর শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ে ভুলভ্রান্তি ধরা পড়তে শুরু করে। প্রথম বিতর্ক শুরু হয়, প্রথম শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর বর্ণ শিখি অধ্যায়ে ‘ও’ বর্ণ শেখাতে গিয়ে একটি কন্যাশিশুর গায়ে ওড়না জড়িয়ে থাকার ছবি নিয়ে। ছবির নিচে লেখা হয় ‘ওড়না চাই’। প্রথম শ্রেণির একটি শিশুকে এ ধরনের পোশাক দিয়ে বর্ণ শেখানোর চেষ্টা নিয়ে সমালোচনা ওঠে নানা মহলে। একই বইয়ের ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘আ’ দিয়ে ‘আম’ শেখাতে একটি ছাগলকে গাছ থেকে আম খাওয়ার ছবি ছাপানো হয়েছে। এ নিয়ে আছে বিতর্ক।

তৃতীয় শ্রেণির ‘আমার বাংলা বই’-এর ৬৮ পৃষ্ঠায় কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’কবিতায় লাইনের ভেতর শব্দ যেমন উলট-পালট ছাপা হয়েছে, তেমনি ভুল শব্দও ছাপা হয়েছে। এক জায়গায় ‘চায়’ছাপা হয়েছে ‘চাই।

নতুন ইংরেজি বইগুলোর পেছনে ‘...বাই দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ’ লেখা। এটা ‘গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ হওয়ার কথা। তৃতীয় শ্রেণির হিন্দু ধর্ম শিক্ষা বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘DO NOT HEART ANYBODY’। আঘাত (hurt) বোঝাতে গিয়ে `হৃদয়’ করে ফেলা হয়েছে।

(ঢাকাটাইমস/৭জানুয়ারি/মোআ)

সংবাদটি শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিবেদন বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন এর সর্বশেষ

এই বিভাগের সব খবর

শিরোনাম :