মেয়ে ফুটবলারদের আনতে বিমানবন্দরে কেউ গেলেন না কেন?

শেখ আদনান ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:৪১

দেশ নিয়ে সচেতেন মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, মগজে ঝড়। বাংলাদেশ আদৌ কি কোনদিন উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছতে পারবে? দেশের বয়স বেশি না, মাত্র ৪৫ বছর। তার উপর জন্মলগ্ন থেকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হত্যা আর ষড়যন্ত্রের প্রায় নিয়মিত উপস্থিতি। নানা সূচকে দেশ সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বটে। কিন্তু যতটুকু হওয়ার কথা ছিল, সেটা কি হয়েছে? না হয়ে থাকলে কেন হচ্ছে না? কিছু উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে, সমস্যা যতখানি অর্থনৈতিক তার চেয়ে ঢের বেশি মানসিক দারিদ্র্য, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার। সমস্যা আমাদের উদ্যোগ আর উদ্যমহীনতায়।

খেলাধুলা দিয়েই আলোচনা শুরু করা যাক। নতুন বছরেও বাংলাদেশ দেখল, এদেশের নতুন প্রজন্ম দেখল; কীভাবে রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা অবহেলা, উদাসিনতা আর দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় প্রতিভা ধ্বংসের রাস্তা তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করলেন!

নারী ফুটবল টিমের কথা বলছি আমি। বাংলাদেশ জাতীয় পুরুষ ফুটবল দল যখন ইদানিং ভুটানের সাথেও জিততে পারে না, সেখানে আমাদের নারী ফুটবল দল সাফে ভারতের কাছে লড়াই করে হেরে রানার আপ হয়ে দেশে ফিরেছে। কিন্তু এদেরকে সামান্য ফুল দিয়েও অভ্যর্থনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরে ছিলেন না কোনো বাফুফে কর্মকর্তা। বাফুফের কি ফুল কেনার টাকার অভাব? ফুল দিবে কেন শুধু? বাফুফের কর্মকর্তারাতো ঠিকই দামি গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ান। রাষ্ট্রের কিংবা ফিফার টাকায় দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান। তাদের নিজেদের ছেলে-মেয়েরা যখন বিদেশে অনেক টাকায় পড়াশুনা করে মাঝে মাঝে সাময়িক কারণে দেশে ফেরেন, তখন তো সরকারি গাড়িতে এই কর্মকর্তারা ঠিকই বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জ আগে থেকেই দখল করে রাখেন। তাহলে যে মেয়েরা দেশের নাম উজ্জ্বল করল তাদের জন্য কেউ বিমানবন্দরে গেলেন না কেন? অভাব কীসের? অভাব মনের, মানসিকতার। অভাব তাদের মগজে।

এই মেয়েগুলো সাধারণ কোন মেয়ে নয়। দেশের পতাকা নিয়ে বিদেশে যান। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে গায়ে গতরে ফুটবল খেলে অন্যদেশকে পরাজিত করে দেশের সুনাম বৃদ্ধি করেন। অথচ, সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা নিজেরা স্বশরীরে উপস্থিত থেকে একটু দেখভাল করা, স্টেডিয়ামে বসে একটু হাততালি দিয়ে অনুপ্রেরণা দেয়ার কাজটা করতে পারেন না। এবার কি তাহলে শিলিগুড়িতে টুর্নামেন্ট হয়েছে বলে কেউ যাননি? ইশ! এই টুর্নামেন্ট যদি আজ নিউইয়র্কে কিংবা লন্ডনে হত! তাহলে হয়তো দুই একটা খেলোয়াড় কমিয়ে হলেও তারা যেতেন।

দক্ষিণ এশীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা ছিল এটি। সেখানে বাফুফের প্রেসিডেন্ট, ভাইস-প্রেসিডেন্ট কিংবা তাদের কোন প্রতিনিধি সেখানে যাননি। ভাবুন এরা সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে এবং দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সেখানে ভিড় করেছে। বাফুফের কর্মকর্তারা তাহলে যে ক্যামেরায় নিজেদের বদন প্রদর্শনের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠতেন, এতে কোন সন্দেহ নেই। ক্যামেরায় শুধু ধরা পড়ত বাফুফের অকর্মণ্য সব কর্মকরতারা। আশেপাশে বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন আমাদের কোচ- খেলোয়াড়রা!

সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দলের সাথে ছিল না কোন মিডিয়া কর্মকর্তা। ভাগ্যিস দেশের কিছু সংবাদমাধ্যম নিজেদের প্রতিনিধি পাঠিয়েছিল। না হলে তো আমরা জানতেই পারতাম না, আমাদের মেয়েরা বিদেশে গিয়েও কত ভালো ফুটবল খেলে! ফিফার অন্য কোন টুর্নামেন্ট যদি ইউরোপ, আমেরিকায় হয় তাহলেও কি বাফুফে এই কাজ করত? কী মনে হয় পাঠক? আমার বিশ্বাস, যে কর্মকর্তা মিডিয়ার কিছুই বুঝেন না উনিও মিডিয়া কর্মকর্তা সেজে যেনতেন ভাবে সেখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। ইউরোপে গিয়ে সাদা-কালো টাকা দিয়ে শপিং করে, মওজ –মাস্তি করে আবার দেশে ফিরতেন।

দেশের ক্রীড়া কর্মকর্তাদের এমন লজ্জাজনক দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নজির ভুঁড়ি ভুঁড়ি। গত বছর আমাদের মেয়েরা যখন এএফসি কাপের বাছাই পর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে দেশ-বিদেশের মানুষের মাঝে সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন, তখনও এই বাফুফে নিজেদের নির্লজ্জ চেহারাটা প্রকাশ করেছিল। এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপের বাছাই পর্বে স্বদেশকে চ্যাম্পিয়ন করে নারী দলের ৯ খেলোয়াড় যখন তাদের ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কলসিন্দুরের বাড়িতে ফিরছিলেন, তখন দেশবাসী দেখেছে আমাদের বাফুফে কর্তৃপক্ষ কী পরিমাণ কর্তব্যজ্ঞানহীন হতে পারে!

এদেশের মন্ত্রী-এমপিরা, নারীবাদীরা কথায় কথায় নারীর জাগরণ এবং ক্ষমতায়নের কথা বলেন, যে নারীরা ফুটবলে ইতিহাস সৃষ্টি করল, যে নারীরা ইরান, ভারত, তাইওয়ানের মত দেশের মেয়েদের মাঠে নাস্তানাবুদ করল, তাদের কিনা বাড়িতে পাঠানো হল লোকাল বাসে! দেশের মানুষকে এত আনন্দ দিয়ে, আত্মবিশ্বাস দিয়ে এই মেয়েগুলো কি একটু ভালো গাড়িতে গ্রামের বাড়িতে যেতে পারতনা? কত টাকা লাগত? দশ/বিশ হাজার টাকাও সরকারি তহবিলে নাই? এত টাকার বাজেট পান আপনারা। টাকা যায় কোথায়?

সর্বশেষ এসএ গেমসের কথা মনে আছে? ভারত তো ইদানিং অলিম্পিকেই নিয়মিত পদক জিততে শুরু করেছে। সর্বশেষ ব্রাজিল অলিম্পিকেও ব্যাডমিন্টন ও কুস্তিতে পদক জিতেছে ভারত। জিমন্যাস্ট এর একটি ইভেন্টে অল্পের জন্য পদক পায়নি। ভারত এখন সাফ গেমসকে পাত্তা দিতে চায়না। অনেক ক্ষেত্রে সাফের মত আসরে দ্বিতীয় সারির খেলোয়াড় নামিয়ে দিচ্ছে। তাতেও ধারেকাছে থাকতে পারছেনা বাংলাদেশ।

এসএ গেমসে ভারোত্তলনে স্বর্ণ জয়ী বাংলাদেশি মেয়ে মাবিয়া আক্তারের কথা এতদিনে নিশ্চয় ভুলতে শিখেছে দেশের মানুষ। মাবিয়া স্বর্ণ জিতে জাতীয় সংগীতের সুরে পদক আনতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। সেই মাবিয়া যখন স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে আসলেন, তখন বিস্মিত হলেন, সাথে সাথে কিছুটা লজ্জিতও। সীমান্তে কেউ ছিল না তাঁকে একটু বরণ করার! লজ্জা, বিস্ময় নিয়ে তিনি মিডিয়ার কাছে মন্তব্য করেছিলেন- ‘নিশ্চয়ই কোনো ভুল-বোঝাবুঝি হয়েছে দেখে আমাদের ফেরার দিনটা কারও মাথায় ছিল না। দেশকে সোনার পদক জিতিয়েছি, এটাই আমার আনন্দ। সোনার পদক জিতেই আমি অনেক সম্মানিত। বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে একটা ফুলের মালা না হয়, না-ই বা পেলাম’!

দেশের জন্য স্বর্ণ জিতে মাবিয়া ভেবেছিলেন, সরকারের উচ্চপদস্থ কেউ তাঁকে ফোন দিয়ে অভিনন্দন জানাবেন। কিন্তু সে ফোন কেউ করেনি। কষ্ট পেয়ে মাবিয়া সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘দেশ থেকে উচ্চ পর্যায়ের কারও একটা ফোন পেলে খুব ভালো লাগত। আমরা তো দেশের জন্যই খেলি। সব সময় সঙ্গে থাকে লাল-সবুজ পতাকা। কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেনি। হয়তো তাঁদের সময় হয়নি। তবে কারও বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই।’

মাবিয়া বলতে গেলে ঢাকার এক বস্তি থেকে উঠে এসেছেন। আমাদের ধনীর দুলাল/দুলালীরা যেখানে গুলশানে সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে দেশের, জাতির নাক কেটে দিয়েছেন, সেখানে মাবিয়াদের মত গরিব ঘরের ছেলে-মেয়েরা দেশের সুনাম বয়ে আনে। কিন্তু আরও সুনাম বয়ে আনার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছেন সমাজের বিত্তবান এবং প্রভাবশালীরাই। এ কেমন অদ্ভুত আত্মঘাতী দেশ আমাদের!

ব্রাজিল অলিম্পিকে বাংলাদেশ টিমের সাথে এক সাঁতারু গিয়েছিল। সে সাঁতারুর কাছে গল্প শুনেছি ওখানে কর্মকর্তারা কী করেছেন! টিমের সাথে কোনো কোচ, ম্যানেজার ছিল না। ছিলনা কোনো ফিজিও। এভাবে পেটে-ভাতে চলে আমাদের খেলোয়াড়রা অলিম্পিক থেকে পদক এনে দিবেন, এমন ভাবনা যারা ভাবেন তারা হয় বোকা না হয় অপরাধী। কর্মকর্তারা পদক জিতলে এক/দুই কোটি টাকা পুরষ্কারের ঘোষণা দেন! এত বড় ঘোষণা তারা দেন, কারণ ধুর্ত এই কর্মকর্তারা ভালো মতই জানেন, আমাদের খেলোয়াড়রা এই প্রশিক্ষণ, সেবা দিয়ে কোনোভাবেই পদক জিততে পারবেন না।

ভারতের দীপা কর্মকার নামে একটি মেয়ে ব্রাজিল অলিম্পিকে জিমন্যাস্টের একটি ইভেন্টে অল্পের জন্য ব্রোঞ্জ পদক পায়নি। এই দীপার পরিবার আমাদের মাবিয়ার মতই গরিব। বাড়ি আগরতলা। আগরতলা কিন্তু ভারতে এক টুকরো বাংলাদেশ। যারা আগরতলা সম্পর্কে জানেন তারা আমার কথা বুঝতে পারবেন। সাধারণ একটি মেয়ে অসাধারণ হয়ে গেছে নিজের এবং তাঁর কোচের অক্লান্ত পরিশ্রম আর সাধনার ফলে। সরকারও তাদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ দেয়ার আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ সুবিধা দিয়ে রেখেছে। দীপার সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁকে দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি কাছে ডেকেছেন। আপ্যায়ন করেছেন। শচিন টেন্ডুলকার, অমিতাভ বচ্চন দীপাদেরকে ডেকে নিয়ে উপহার দিয়েছেন। অলিম্পিকে যাওয়ার আগে নানা প্রোগ্রাম করে এদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। ভারত পারলে আমরা কেন পারব না? ক্রিকেটের উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। সমস্যা অবশ্যই টাকার না। দারিদ্র আমাদের মনে।

একসময় হকি ছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা। সেই হকিকে ইচ্ছে করলে এখনো বিশ্বমানের করা যায়। হকি দিয়েও আমরা বিশ্বজয় করতে পারি। আমাদের কাবাডি টিম ভারতে গত বছর বিশ্বকাপে দেখিয়েছে, একটু দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ পেলে সারা বিশ্বে এক নম্বর হতে পারে।

প্রতিটি খেলায় আমাদের প্রতিভা আছে। নাই শুধু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এবং সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ভাবনা ও পরিকল্পনা। দেশে প্রধানমন্ত্রী একা সব সামলাবেন আর অন্যরা জনগণের টাকায় আয়েশে দিন কাটাবেন তা হয় না। আমাদের সকলেরই দায়িত্ব আছে। খেলাধুলা দিয়ে পুরো সমাজকে বদলে দেয়া সম্ভব। আমাদের তথাকথিত শিক্ষিত, সচেতন গোষ্ঠী আসলে কী চায়? তাদের ছেলে-মেয়েদের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে বিদেশের জন্য তৈরি করে বিদেশে ছেলে-মেয়ে বউ, অর্থ সম্পদ পাচার করে দিয়ে তারা হয়তো ভাল থাকবেন। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের কী হবে?

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :