৫ জানুয়ারির পরে...

মাসুদ কামাল
 | প্রকাশিত : ০৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৪

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ৫ জানুয়ারি একটা মাইলস্টোন। আমি এটাকে মাইলস্টোনই বলব। কারণ গণতন্ত্র কিংবা ভোটের রাজনীতিতে এখান থেকেই যেন নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার একটা বিষয় থাকে। নির্বাচনে যারা অংশ নেন, সরকার পরিচালনায় যারা যেতে চান, প্রতি পাঁচ বছর পর পর তারা অন্তত একবার করে হলেও জনগণের সামনে যান। যেতে হয়। নতুন করে ভোট পেতে চাইলে জনগণের কাছে যেতে হয়। ভোট প্রার্থনা করতে হয়, ভোট পেলে কি করবেন সেই প্রতিশ্রুতি দিতে হয়। যারা আগেও নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদেরকে জবাবদিহি করতে হয়। ভোট পেতে কি বলেছিলেন, ভোট পেয়ে কি করেছিলেনÑ সেই হিসাব মিলিয়ে দিয়ে আসতে হয়। হিসাব অনেক সময় মেলে না, অনেক সময় এতে গোঁজামিল থাকে, কিন্তু তারপরও শারীরিকভাবে যেতে হয় ভোটারের কাছে। ৫ জানুয়ারি যেন সেই ধারাটার অবসান ঘটিয়ে দিয়েছে।

তিন বছর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি কি হয়েছিল? সেদিন এই দেশে একটা নির্বাচন হয়েছিল। জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনটা ছিল কেবলই নিয়ম রক্ষার, কারণ জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সেদিন নির্বাচন হয়েছিল মাত্র ১৪৬ আসনে। বাকি আসনগুলোতে একজনের বেশি প্রার্থীই ছিল না, ফলে তারা কোনো প্রকার ভোট ছাড়াই নির্বাচিত হয়ে গেছেন। তাদেরকে ভোটারের কাছে যেতে হয়নি, বরং বৈধ প্রার্থী হিসাবে টিকে থাকার জন্য নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়েছে। এভাবেই তিনশ আসনের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কোনো ভোটারের মতামত ছাড়াই। সে হিসাবে বর্তমান জাতীয় সংসদে জনগণ হচ্ছে সংখ্যালঘিষ্ঠ। কিন্তু এমনটি হলো কেন? সেটাও সবাই জানেন। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং সহযোগী দলগুলো এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। কেবল নেয়নি নয়, তারা এই নির্বাচন বর্জন করেছে। আরও বড় কথা, নির্বাচনের একেবারে আগে আগে এসে তারা নির্বাচন প্রতিরোধের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছে। সেই ঘোষণার কিছু প্রতিফলনও দেখা গেছে। কোথাও কোথাও ভোটকেন্দ্রে আগুন দেওয়া হয়েছে। নির্বাচন বর্জনের বিষয়টা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। যে কোনো ব্যক্তি বা দল নির্বাচন বর্জন করতেই পারে। এটি তাদের রাজনৈতিক কৌশল। ১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচন, যে নির্বাচনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ জনগণের নিরঙ্কুশ ম্যান্ডেট পেয়েছিল, সেটিও কিন্তু মাওলানা ভাসানি বর্জন করেছিলেন। সেই বর্জনে আওয়ামী লীগের কোনো ক্ষতি হয়নি, গণতন্ত্রের কোনো ক্ষতি হয়নি। বর্জন করলেও তারা কিন্তু নির্বাচন প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি। ২০১৪ সালে প্রতিরোধের চেষ্টা হয়েছে, রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে। কেবল নির্বাচনের দিনই নয়, বেশ আগে থেকেই চলছে এই প্রতিরোধের রাজনীতি। প্রতিরোধ মাঝেমধ্যেই সহিংসতায় রূপ নিয়েছে। যাত্রী বোঝাই বাসের মধ্যে বোমা মারা হয়েছে, পুড়ে মরেছে নিরীহ মানুষ। এই যে সহিংস প্রতিরোধ, একে আর যা-ই হোক গণতান্ত্রিক আচরণ বলা যাবে না। অগণতান্ত্রিক কর্মকা-ের মাধ্যমে গণতন্ত্র যে অর্জন করা যায় না, এসব ঘটনাবলীর মাধ্যমে সেটা আবারো প্রমাণ হলো।

এই সবই ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগের বা নির্বাচনকালীন কথা। প্রশ্নটা হচ্ছে, কি হলো নির্বাচনের পর? এটা খুবই স্বাভাবিক চিন্তা যে, এরকম ভোটারবিহীন একটা নির্বাচনের ফল কখনো শুভ হতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি, আমার নিজেরও ধারণা ছিল ওই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের আয়ু বেশিদিন হবে না। দ্রুতই হয়তো তাদেরকে নতুন একটা নির্বাচনে যেতে হবে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। তারা নির্বাচন বর্জন করেছিল। তাদেরকে বাদ দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও সরকারে টিকে থাকতে পারেনি বিএনপি। জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসতে পেরেছিল মাত্র চারদিন। তারপরই তাদেরকে সংসদ ভেঙে দিয়ে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। ২০১৪ সালে এসে হয়তো সেই উদাহরণটা বিএনপির মাথাতেও থেকে থাকবে। তবে বাস্তবে সেরকম কিছু হয়নি। ১৯৯৬ এবং ২০১৪ সালের দুই বিরোধী দলের কৌশল ও কর্মকা-ে কিছু পার্থক্য অবশ্য ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করলেও প্রতিরোধ করার মতো হঠকারী সিদ্ধান্তে যায়নি। তারা আন্দোলনটা বেগবান করেছে নির্বাচনের পর। আর বিপরীত দিকে ২০১৪ সালে দেখা গেল নির্বাচনের পর বিএনপি ঘোষণা দিয়েই আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাল। মুখে অবশ্য বলছে যে, কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে পরে আবার তারা আন্দোলনে নামবে। সেই নামাটা আর হয়নি। হবে যে না, সেটা বোঝাই গিয়েছিল। কারণ, আন্দোলন তো বলে কয়ে হয় না। এটা হয় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে। আন্দোলন যে করবেন, সেই জনগণ কোথায়? তাদেরকে তো আগেই আপনারা ভয় দেখিয়ে রেখেছেন। ফলে জনগণকে যেমন পাওয়া যায়নি, এমনকি তেমনি পাওয়া যায়নি দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদেরও। অনেকে এখনো মনে করেন, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এবং পরের বছর ৫ জানুয়ারিকে কেন্দ্র করে দেশে যে অরাজকতা তৈরি হয়েছিল, সেটার পিছনে যতটা না বিএনপি ছিল, তারচেয়েও অনেক বেশি ছিল জামায়াতে ইসলামী। তাদের সেই হঠকারী সিদ্ধান্ত ও কর্মকা-ের বদনাম বহন করতে হয় বিএনপিকে। কেবল বদনামই নয়, পরিণতিও এখন পর্যন্ত বিএনপিকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

বলছিলাম ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরের কথা। যে দিনটিকেও মাইলস্টোন হিসাবে বিবেচনা করি, কি কি পরিবর্তন এলো তার পর থেকে? পরিবর্তন আমরা দু ধরনেরই দেখলাম। কিছু নেতিবাচক, কিছু ইতিবাচক। শুরুতে মনে হয়েছিল, এমন একটি নির্বাচনের মাধ্যমে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই বুঝি কিছুটা বিব্রত। সেই সময়ও মধ্যবর্তী নির্বাচনের কথাও শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু এর পর থেকেই বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী দ্রুতই দুর্বল হতে শুরু করল। বিরোধী দলগুলো যত দ্রুত দুর্বল হতে থাকল, ততই দ্রুত বিব্রতভাব কাটতে থাকল সরকারি দলের মধ্যে থেকে। নিয়ম রক্ষার নির্বাচন পরিণত হলো পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার নির্বাচনে। নেতারা তারস্বরে বলতে শুরু করলেন, ২০১৯ সালের আগে আর কোনো নির্বাচন নয়। আর দুর্বল হতে হতে বিরোধীদল এতটাই নেতিয়ে পড়ল যে, এইসব কথার প্রতিবাদ করার ক্ষমতাও যেন হারিয়ে ফেলল। নব্বইয়ে এরশাদ পতনের পর তিন দফা ক্ষমতায় যাওয়া পরাক্রমশালী দলটি রাতারাতি যেন পরিণত হলো বিবৃতিসর্বস্ব দলে। আর এই সুযোগে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দুটো বেসিক কাজ করল। প্রথমত, তারা তাদের প্রধান দুই বিরোধী রাজনৈতিক দলকে যতদূর সম্ভব চাপে রাখল। আর দ্বিতীয়ত, ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকা-ের মাধ্যমেও কম গণতন্ত্র বেশি উন্নয়ন তত্ত্বটিকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করল।

আওয়ামী লীগের এই যে দুটি লক্ষ্য, মানতেই হবেÑ দুই ক্ষেত্রেই তারা দৃশ্যমান সাফল্য পেয়েছে। বিএনপির স্থায়ী মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে তারা বলতে গেলে একরকম নিশ্চিহ্নই করে দিতে পেরেছে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একে একে ফাঁসি হয়ে গেল। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, জামায়াত নেতাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রথম ফাঁসি দেওয়া হয় কাদের মোল্লাকে। সেটা ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। তারিখটা বহুল আলোচিত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের এক মাসেরও কম সময় আগের। নেতার ফাঁসির রায় আর দলের অংশগ্রহণ ব্যতীত নির্বাচনÑ এই দুই ইস্যুকে একসঙ্গে মিলিয়েই তখন মাঠে নেমেছিল জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা। নেতাকে রক্ষার লক্ষ্যেই হয়তো তখন তারা অনেকটাই বেপরোয়া হয়ে পড়েছিল, অনেক ক্ষেত্রেই যা নৃশংসতায় রূপ নিয়েছিল। এতে করে ফল হয়েছে হিতে বিপরীত। মানুষের মন থেকেই ওঠে গেছে তারা। আওয়ামী লীগও এই বিষয়টিকে সুপরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে। প্রথমত তারা এটাকে ব্যবহার করেছে জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের একের পর এক ফাঁসিতে ঝুলাতে, আর দ্বিতীয়ত, দেশ থেকে বিরোধী রাজনীতিকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে।

দেশে কার্যত এখন আর কোনো বিরোধী দল নেই। জাতীয় সংসদে যে বিরোধী দল নামধারী কতিপয় আছেন, তাদেরকেও গৃহপালিত বললেও কম বলা হয়। এতে ক্ষতি যেমন হয়েছে, লাভও তেমনি হয়েছে কিছুটা। আমাদের এই দেশে বিরোধী রাজনীতি বলতে এতদিন জনগণ যেটা দেখেছে সেটা আসলে প্রতিহিংসার রাজনীতি ছাড়া আর কিছু নয়। সরকারি দল যা কিছুই করুক না কেন, কি ভালো কি মন্দ, বিরোধী দলের রাজনীতিই হচ্ছে চোখ বন্ধ করে তার বিরোধিতা করা, তাকে প্রতিরোধ করা। যমুনা নদীর ওপর একটা সেতু হবে, যা হলে পুরো উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দেশের সহজ যোগাযোগ তৈরি হতে পারবে, অথচ সেই সেতুর অর্থায়নের জন্য যখন বিদেশি প্রতিনিধিরা আসবে তখন বিরোধী দল হরতাল দিয়ে বসেছে। এমন দৃশ্যও এই দেশে আমাদের দেখতে হয়েছে। তাই এবার যখন বিরোধ দলের দুর্বলতম অস্তিত্ব দৃশ্যমান হলো, সরকারকেও দেখা গেল এই সুযোগে বেশ কিছু উন্নয়ন কর্মকা-ে হাত দিতে। এবং সন্তোষের বিষয় হচ্ছে, এর কিছু ইতিবাচক ফলও পাওয়া গেল। আজকাল অনেকেই বলতে শুনি, বিরোধী দল যদি এখন শক্তিশালী থাকত, তাহলে হয়তো চারদিকে এত এত ফ্লাইওভার, সেতু দেখতে হতো না। এ কথার সত্য-মিথ্যা নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে, তবে সাধারণ মানুষের অনুভূতিটা এমনই, তা বলা যায় নির্দ্বিধায়।

৫ জানুয়ারি, ২০১৪ সালের পর তিন বছর পার হয়ে গেছে। সামনে উঁকি দিচ্ছে আরও একটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর সেই কারণেই বোধকরি ৫ জানুয়ারির প্রাসঙ্গিকতা আবার সামনে চলে এসেছে। আগামী নির্বাচনও কি সেই আগের পদ্ধতিতেই হবে? ২০১৪ সালের মজা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়ে গেছে। এত সহজেই যদি ক্ষমতায় যাওয়া যায়, তাহলে আর নির্বাচনের ঝুঁকিতে যাওয়া কেন? আর একবার মসনদে বসতে পারলে যে এই বিরোধী দলের পক্ষে আন্দোলন করা সম্ভব নয়, সেটাও তো প্রমাণিত। কিন্তু এতে যে দীর্ঘ মেয়াদে দেশের এবং গণতন্ত্রের বড় একটা ক্ষতি হতে পারে, সেই বিষয়টাও বিবেচনায় রাখা দরকার। দমন পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী মতকে কিছু সময়ের জন্য দমিয়ে রাখা যায়, চিরদিনের জন্য যায় না। কার্যকর কোনো বিরোধী দল না থাকলে যে আপাদমস্তক একটা গণতান্ত্রিক দলও দ্রুতই স্বৈরতান্ত্রিক দলে পরিণত হতে পারে, তার উদাহরণ তো বিশ্ব ইতিহাসে একেবারে কম নেই। আমাদের এই ভূখ-েও দেখেছি। কে জানে, হয়তো আগামীতে দেখতে হতে পারে।

মাসুদ কামাল : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :