সুন্দরগঞ্জের অশ্রু, গুলশানের অনল

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
 | প্রকাশিত : ০৯ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৪১

তার নাম রমজান আলী। ঢাকায় থাকেন। রামপুরায়। তিন চাকার বাহনে শ্রম দিয়ে যা রুজি হয় তা দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলে সংসার। মা এতদিন গ্রামের বাড়িতেই ছিলেন। ঢাকায় এনেছেন মাস ছয় হচ্ছে। আয় কিছু বেড়েছে। বৃদ্ধা মাকে গ্রামে কষ্টে রেখে ছেলে তো আর স্ত্রী নিয়ে ঢাকায় ভালো থাকতে পারে না। তাই গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থেকে মাকে ঢাকায় এনেছেন রমজান। তার সঙ্গে পরিচয় তিন চাকার পথ ধরেই। জেঁকে বসা শীত থেকে বাঁচতে তার বেশ আয়োজন। গায়ের সোয়েটারটা বেশ পুরো। গলায় মাফলার আর কানটুপি দিয়ে বাতাস ঠেকানোর চেষ্টা। মুখটা বেরিয়ে আছে গোল হয়ে। পেছন ফিরে সেই মুখ দেখিয়ে বললেন, ‘কোন দ্যাশত আছি বাহে। এই হামার দ্যাশ!’ কথা বলার পর বেশ কিছু সময় কেটে গেল। আমার চিন্তায় তখন অন্যকিছু। তার কথা শুনলাম, কিন্তু জবাবে কিছু বলতে হবে—এমন তাগিদ বোধ করলাম না।

ব্যাগ থেকে বের করে মাফলারটা গলায় জড়িয়ে কানে প্যাঁচানোর আগে আবার শুনলাম। ‘ভাই, হামার দ্যাশত আইন-বিচার নাই হয়া গ্যাছো, কন তো?’ রমজান বললেন। ‘ঘরত ঢুকি হামার ভাইক মারি ফেলল। থানা-পুলিশ নিরুপায়!’

জানতে চাইলাম, ‘কোথায় আপনার ভাইকে মেরে ফেলেছে?’

: তুমি জানেন না বাহে? গাইবান্ধায়, সুন্দরগঞ্জে এমপি লিটন খুনের কথা শুনেন নাই?

: হ্যাঁ।

: এই যে গাড়ি চালায় ভাত খাই, মাওক খাওয়াই, বউক খাওয়াই—লিটন ভাই হামাক টাকা না দিলে হামার ভিক্ষা করা লাগতো বাহে।

রমজান জানালেন তার এই রিকশা কেনার টাকা দিয়েছেন ‘লিটন ভাই’ (নিহত সাংসদ মনজুরুল ইসলাম লিটন)। তাও বছর খানেক আগের কথা। লিটনের মৃত্যুর খবর শুনে ঢাকা থেকে গ্রামে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। যে মানুষটার কারণে তার জীবিকার ব্যবস্থা হয়েছে তার জন্য মন কাঁদে এখনো।

মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার পর সপ্তাহ পার হয়েছে (এই লেখা পর্যন্ত)। এখন পর্যন্ত খুনের কারণ (মোটিভ) খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ আছে অন্ধকারে বলাই যায়। তবে তদন্ত চলছে। মাঠ পর্যায়ে। জেলার পুলিশ সুপার মো. আশরাফুল ইসলাম জানিয়েছেন, তদন্ত চলছে। তবে বলার মতো অগ্রগতি হয়নি। এভাবে ঘরে ঢুকে সংসদ সদস্যকে হত্যা নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে প্রকাশ্যে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরও কিছু হচ্ছে না। উল্টো নিরাপত্তা শঙ্কায় আছেন নিহত সাংসদের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান। তিনি ঢাকায় আছেন। পরিবারের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার জন্য তিনি পুলিশ চেয়েছেন।

২০১৫ সালের ২ অক্টোবর সুন্দরগঞ্জে একটি শিশুর পায়ে গুলি নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন সাংসদ লিটন। ওই ঘটনায় হত্যাচেষ্টার মামলা হয়েছে। জামিনে ছিলেন সাংসদ।

গত ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যার ঘটনা। সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গার মাস্টারপাড়ায় নিজ বাড়িতে আওয়ামী লীগের এ সংসদ সদস্যকে গুলি করা হয়। পরে রাত সাড়ে সাতটার দিকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা যান। ২০১৩ সালে গাইবান্ধায় চার পুলিশ সদস্য খুন হয়েছিলেন সহিংসতায়। সেই হত্যা মামলার অগ্রগতিও নেই। এখন সাংসদ হত্যার রহস্য কতদিনে উন্মোচিত হবে? রমজান আলীর মতো অনেকেরই এ প্রশ্ন।

দুই. ফেরি করে দোকানে দোকানে কাগজের ব্যাগ সরবরাহ করতেন শাহজাহান মিয়া। দীর্ঘ পাঁচ বছর এই ব্যবসায় সংসারের চাকা ঘোরে তার। আজ পাঁচদিন ধরে অনেকটা বেকার দিন কাটছে তার। বিক্রি বন্ধ। আগুনে পুড়ে গেছে স্বপ্ন। গত ২ জানুয়ারি রাতে আগুন লেগেছে রাজধানীর ডিএনসিসি মার্কেটে। সেই আগুনে পুড়েছে শাহজাহানের জীবিকা। এখন তাকে ব্যাগ বিক্রির জন্য নতুন বাজার খুঁজতে হবে। কম বেশি সব মার্কেটেই কেউ না কেউ ব্যাগ সরবরাহ করে। সেখানে নতুন করে তার বাজার সৃষ্টি করা সহজ হবে না। এখনো তিনি প্রতিদিন সকালে বাসা থেকে বের হন। আসেন গুলশান-১ নম্বরে ডিএনসিসি মার্কেটে। আগুনে পুড়ে ধসে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে চোখের পানি ফেলেন। আগুন লাগার তিনদিন পরও ধোঁয়া বের হচ্ছে ধ্বংসস্তূপ থেকে। ধিকিধিকি জ্বলছে অনল। যে অনল রাতের অন্ধকারের বুক চিড়ে আলোতে পৌঁছার আগেই কোটিপতি থেকে নিঃস্ব করে দিয়েছে শত শত ব্যবসায়ীকে। পথে বসিয়ে দিয়েছেন হাজারো মানুষকে। যাদের জীবন-জীবিকা ছিল ওই মার্কেট ঘিরে। শীত এলেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে।

এসব দুর্ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত সঠিকভাবে বের করা যায়নি। তবে পথে বসে যাওয়া মানুষের মুখ দেখে বোঝা যায়, হলুদ অনল কতটা ক্ষত এঁকে গেছে তাদের বুকে। এমন ভয়াবহ অগ্নিকা- থেকে বেঁচে থাকার পথ আমরা বের করতে পারিনি এখনো। কিংবা আগুন লাগার পর তা সহজে নিভিয়ে ফেলায় আমাদের অদক্ষতার চিহ্ন আরও গভীর হচ্ছে।

পুনশ্চ: রিকশাচালক রমজান আলীর সঙ্গে দেখা হয় ডিএনসিসি মার্কেটের অপর পাশের রাস্তায়। গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ নম্বরে আসার পথে। যাত্রীর অপেক্ষায় পোড়া মার্কেটের ধ্বংসস্তূপের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিলেন তিনি। আর সড়ক বিভাজনের ওপর মাথায় হাত রেখে বসে ছিলেন শাহজাহান মিয়া। কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল ফুরিয়ে গেছে। লাল হয়ে আছে চোখ দুটো। চোখে পানি আছে রমজান আলীর। কিন্তু তার জল ডিএনসিসির আগুন নেভানোর জন্য নয়, ‘ভাই লিটনের’ জন্য। কী অসহায় চোখের জল। না পারে খুনিদের খুঁজে বের করতে, না পারে নেভাতে আগুন।

হাবিবুল্লাহ ফাহাদ : সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :