১০ টাকায় এসি প্রাইভেটকারে মগবাজার থেকে মিরপুর!
শিরোনাম দেখে হয়তো আমাকে পাগলও ভাবতে পারেন। কিন্তু এটাই সত্যি। রাত দুপুরে নতুন একটি প্রো-ভক্স প্রাইভেটকারে করে মগবাজার থেকে মিরপুর-১ নম্বর ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে তো আপনি যাননি। বন্ধুকে নিয়ে আমিই গিয়েছি। আর টাকা তো আমার পকেট থেকে গিয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী দেয়ার কথা ছিল পাঁচ টাকাই। কিন্তু ভাঙতি ছিল না বলে চালককে দিলাম ১০ টাকার আস্ত একটি নোট।
বলতে ভুলে গেলে চলবে না, গাড়িটি ছিল একেবারে নতুন, চকচকে। শীতকাল বলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রটি ব্যবহার করা হয়নি। তবে উঠতেই চালক বলেছেন, ‘স্যার আপনি চাইলে এসি দিয়ে দেবো।’
সময় ৮ জানুয়ারি দিবাগত রাত দেড়টা। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফখরুল ইসলামের নবাগত বাচ্চার জন্য মগবাজারের আদ-দ্বীন হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে অপেক্ষায় আমরা। হঠাৎ পাশে থাকা আরেক বন্ধু শাহাদাতুল ইসলামের কাছে একটি দুঃসংবাদের ফোন। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হলো-মিরপুরের ডেলটা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তার বোন জামাইয়ের ভাই আর বেঁচে নেই।
এতো রাতে মিরপুর যাওয়া নিয়ে সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ। কারণ কোনো ব্যক্তিগত বাহন নেই। কিন্তু অভয় দিলেন শাহাদাত। বললেন,রাত হলেও খোঁজ নিয়ে দেখি উবারের কোনো গাড়ি পাওয়া যায় কি না।
ইতিমধ্যে অনেকেই উবার সম্পর্কে জেনে গেছেন। স্মার্টফোন অ্যাপ্লিকেশন (অ্যাপ) নির্ভর ট্যাক্সি পরিবহনসেবা উবার সম্প্রতি রাজধানীতে চালু হয়েছে। সহজেই যাত্রীদের নিরাপদ,নির্ভরযোগ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে এটি চালু হলেও বিআরটিএর পক্ষ থেকে একে অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু এটি ছিলো পুরোদমে। কারণ তাদের সেবায় স্বস্তিতে আছে যাত্রীরা।
পরে উবার চালু করে দেখা গেলো মগবাজারের আশপাশে ছয়টি গাড়ি রয়েছে। সবচেয়ে কাছে দেখা যায় সোনারগাঁও হোটেলের সামনে প্রো-ভক্স গাড়ি নিয়ে অপেক্ষায় আছেন চালক রেজাউল। দুরত্ব দেখানো হলো- আমাদের অবস্থানে আসতে তার সময় লাগবে ছয় মিনিট।
পরে তার কাছে রিকোয়েস্ট পাঠানোর এক মিনিটের মধ্যে উল্টো ফোন করে জানতে চাইলেন, ‘স্যার আমি উবার থেকে বলছি। আপনি কি মিরপুরে যাবেন?’ হ্যাঁ-বলার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আদ-দ্বীন হাসপাতালের মূল ফটকে এসে আবারো ফোন। বললেন, ‘স্যার আমি চলে এসেছি।’ এমন চিত্র দেখে সাথে থাকা অন্যরা তো অবাক!
সময় নষ্ট না করে শাহাদাতসহ উঠে পড়লাম উবারের গাড়িতে। চালক রেজাউল জানতে চাইলেন ‘স্যার, কোন দিক থেকে গেলে আপনার জন্য সুবিধা হবে।’
নিজের প্রথম অভিজ্ঞতা হলেও সাথে থাকা বন্ধুর একাধিকবার অন্য কারো সঙ্গে উবারের গাড়িতে চলাচলের সুযোগ হয়েছে। বললো- ‘দোস্ত দোয়া কর সহিসালমতে মিরপুর যাই। নেমে তোকে চমকে দিব।’ ঠিকই চমকে উঠেছি,তবে সে কথা পরে বলছি।
উবারে আয় কতো?
ফাঁকা রাস্তায় বেশ দ্রুতগতিতে কারওয়ান বাজার দিয়ে বসুন্ধরা মার্কেটের সামনে দিয়ে গিয়ে রাসেল স্কোয়ার পার দিয়ে মিরপুরে রোড়ে চলছে উবারের গাড়ি। ফাঁকে ফাঁকে উবার সার্ভিস নিয়ে কথা হচ্ছিল চালক রেজাউলের সঙ্গে। বললেন,খুবই ভালো এটা। প্রতিদিন মালিককে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা ক্যাশ দেন। আবার উবার থেকেও মালিক টাকা পান। মোটামুটি ভালোভাবে চললে মাসে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব বলেও জানালেন রেজাউল।
উবারের ব্যবসা লাভজনক জানিয়ে নিজের টাকা থাকলে একটি গাড়ি উবারে দেয়ার কথাও জানালেন রেজাউল। মিরপুরের ডেল্টা হাসপাতালের সামনে যখন পৌঁছলাম তখন সময় দুইটা ছুঁই ছুঁই।
ভাড়া কত আসছে- জানতে চাইলে নিজের কাছে থাকা উবারের দেয়া মোবাইল দেখিয়ে বললেন, স্যার ২৫৫ টাকা আসছে। কিন্তু দ্বিধায় পড়ে গেলো বন্ধু শাহাদাত। কারণ উবারে রেজিস্ট্রেশন করার পর প্রথমবার সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে ২৫০ টাকা পর্যন্ত কোনো ভাড়া দিতে হয় না যাত্রীকে। সে হিসেবে ভাড়া দেয়ার কথা পাঁচ টাকা। পরে অবশ্য চালকও ভুলের কথা স্বীকার করে বললেন,স্যার আপনি তো ডিসকাউন্ট পেয়েছেন ২৫০ টাকা। খেয়াল করিনি।
পরে নিয়ম না থাকলেও পাঁচ টাকার সঙ্গে আরো পাঁচ টাকা যোগ করে ১০টাকার একটা নোট চালকের হাতে দিয়ে আমরা হাসপাতালের ভেতরে গেলাম। চালক রেজাউলও খুশি মনে টাকা নিয়ে ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিলেন। আমরাও খুশি হয়েছি তবে দুঃসংবাদের জন্য মন খারাপ থাকায় আর আনন্দ প্রকাশ করা হয়নি।
তবে আজব শহর ঢাকায় এমন স্বস্তি ও আরামদায়ক স্বল্প সময়ের যাত্রার রাতটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আরেকটি কথা না বললেই না, আরামদায়ক প্রাইভেটকারে যে পথে যেতে ভাড়া উঠলো ২৫৫ টাকা, ফিরতি পথে একই দূরত্বের জন্য সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গুনতে হলো ২০০ টাকা। এটা অবশ্য চুক্তিতে।
আবার যাওয়ার পথে উবারের চালকের ভদ্র আচরণ, আর কথায় কথায় ‘স্যার’ সম্বোধনের কারণে বিব্রত হতে হয়নি ফেরার পথে। সিএনজি চালকের সঙ্গে দর কষাকষি করতেই আসলে তার গাড়িতে উঠার আগেই বিগড়ে গিয়েছিল মেজাজটা।
লেখক: সাংবাদিক, ঢাকাটাইমস