ঢাকা-কিশোরগঞ্জ রুটে ট্রেনের সেবার মান বাড়ান প্লিজ

অনুপম মাহমুদ
| আপডেট : ১০ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:০৩ | প্রকাশিত : ১০ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৪৪

ঝক্কর ঝক্কর মাইমেনসিং, ঢাকা যাইতে কতদিন... ছোটবেলায় আমরা অনেকেই ছড়া কাটতাম, তবে এটাও নিশ্চয়ই সত্য, তখন অনেক সময় লাগতো, আর আমাদের তৎকালীন মহকুমা শহর কিশোরগঞ্জ এর জেলা ছিলো আজকের ময়মনসিংহ। জমিজমা নিবন্ধন, কোর্ট কাচারি, উচ্চশিক্ষা আর অতি প্রয়োজনের চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ আসতেই হতো। ঢাকা তো অনেক দূরের পথ। বিজ্ঞান, প্রযুক্তি আর যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে আমরা অনেকটা অগ্রসর হলেও বাড়ি গেলে মনে হয় আমরা এখনো এতটা এগিয়ে যাইনি।

আকাশ পথে আপনি যেতে পারেন, প্রাইভেট হেলিকপ্টারে এখন অনেকেই যাচ্ছেন, তবে তা সাধারণের নাগালের বাইরে। গাড়ি অনেকেরই আছে, চাইলে যখন খুশি যেতে আসতে পারেন। আবার নিজের না থাকলেও সমস্যা নেই আপনি ভাড়ায় পাবেন, কিন্তু যাত্রীসেবা বা পেশাদারিত্ব, সেটা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। নৌপথ এখন নেই বললেই চলে, তাই সেদিকে আমরা না যাই।

তবে ভাটি এলাকা থেকে এখনো ট্রলারে করে নারায়ানগঞ্জ/সিলেট যাওয়া আসা করে অনেকেই। বাকি আছে সড়ক পথ, সেটাও দুই ভাগে বিভক্ত: ১. সড়ক ও জনপথের হাইওয়ে (আন্তঃজেলা) আর ২. ব্রিটিশ আমলের রেলপথ। আমরা মানে আমি নিজে অতি সাধারণ শ্রেণির নাগরিক। যাই হোক কথা হচ্ছে কীভাবে যাবো বাড়ি, সাকুল্যে একমাত্র এই সড়ক পথই আছে আমাদের মতো সাধারণদের জন্য উন্মুক্ত বাড়ি যেতে বা জীবিকার তরে রাজধানীতে আসতে।

আজ থেকে প্রায় আটশ বছর আগে আমাদের জঙ্গলবাড়ি ছিলো ঈশা খাঁর অস্থায়ী রাজধানী। আমরা এখন বর্তমান রাজধানী থেকে মাঝে মাঝে সাবেক অস্থায়ী রাজধানীতে যেতে চাই। সড়ক পথে বাসে যাবেন? সেখানেও রাস্তা দুইটি: ১. সায়েদাবাদ-ভুলতা-গাউছিয়া-নরসিংদী-ভৈরব-কুলিয়ারচর-কটিয়াদি হয়ে কিশোরগঞ্জ(১১৪ কিলোমিটার) আর অপরটি ২. মহাখালী-উত্তরা-টঙ্গী-রাজেন্দ্রপুর-কাপাসিয়া-টৌক-পাকুন্দিয়া-চৌদ্দশত হয়ে কিশোরগঞ্জ (১০৭ কিলোমিটার)। ময়মনসিংহ হয়ে কিছু কিছু বাস হয়তো এখনো যায়, এছাড়া উপজেলা পর্যায় থেকে প্রায় প্রতিটি উপজেলা (হাওর উপদ্রুত উপজেলা ছাড়া) ঢাকা আসা যাওয়া করা যায়, তবে জনপ্রিয় ও সর্বাধিক ব্যবহৃত রাস্তা এই দুটোই।

এবার আসা যাক রেলপথ নিয়ে। ঢাকা থেকে মাত্র ১৩৫ কিলোমিটার। সার্ভিস গুলো হচ্ছেঃ

আন্তঃনগর, লোকাল, মেইল ইত্যাদি। ট্রেনে আমাদের পথপরিক্রমা: ঢাকার কমলাপুর থেকে

বিমানবন্দর-নরসিংদী-ভৈরব-কুলিয়ারচর-বাজিতপুর-সরারচর-মানিকখালী-গছিহাটা-যশোদল

হয়ে কিশোরগঞ্জ। বলা যায় ভৈরব এর পর আন্তঃনগর ট্রেনগুলো লোকাল ট্রেনের মতোই

আচরণ করে। সবগুলো স্টপেজে যাত্রী উঠা নামা ও অপরাপর ট্রেন গুলোকে সাইড দেয়ার

জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয় স্টেশনের বাইরে।

লোকাল ট্রেন ও মেইল ট্রেনগুলো বাদ দিলে আন্তঃনগর ট্রেন আছে এখন তিনটি। ১. এগারসিন্ধুর প্রভাতী, ২. কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ও ৩. এগারসিন্ধুর গোধূলী। প্রায় তিন দশকের এই আন্তঃনগর ট্রেন আমাদের ভীষণ পছন্দের, প্রথমত এর সহনশীল ভাড়া ও আরামদায়ক ভ্রমণ (যদি টিকেট নামের সোনার হরিণ আপনি পেয়ে থাকেন)।

গোটা বাংলাদেশে যতগুলো আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস আছে তাদের ভেতর আমাদের বাসগুলো নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বাজে। বাজি ধরে বলতে পারি আমাদের বাসের অবকাঠামো থেকে শুরু করে যাত্রী সেবা দুটোই অত্যন্ত নিম্নমানের। ইঞ্জিনসহ চেসিস আমদানি করে মালিকদের পছন্দ মতো গ্যারেজে ২৪ সিটের মিনিবাসকে বানানো হয় ৩৬+ সিটের বাস। চালকের সাথে, ঠিক পেছনে ও ইঞ্জিনের উপর কায়দা করে বনেটের উপর আরো বসানো হয় গোটা ছয়েক যাত্রী। বাসে বসে পা রাখাটা মাঝারি উচ্চতার মানুষদের পক্ষেও অসম্ভব, তবে শিশু-কিশোর হলে কিছুটা ঠিক আছে।

ভাড়া নিয়ে কথা বলাটা অরুচিকর, তবে সেটা যে অন্যায্য এটা সুনিশ্চিত। ঈদ-পূজা-পার্বণ হলে তো কথাই নেই, ভাড়া যায় বেড়ে। ভাড়া দিতে আপত্তি ছিলো না, যদি বাসের মান ও সেবা ভালো হতো। আমার মনে হয় আমাদের রুট ছাড়া আর কোন রূটেই হেল্পার/কন্ট্রাকটর/গাইডম্যান অবলিলায় আপনাকে ‘মামা’ বা ‘বড়ভাই’ বলে ডাকবে না।

আর বাসে তিল ধারনের ঠাঁই না থাকলেও তারা যেখানেই যাত্রী পাবেন, সেখান থেকেই উঠাবেন, আপনি যতই অনুযোগ করুন না কেন।

ঢাকা আসার সময় অন্য কোন আন্তঃজেলা বাস ভৈরব বা টঙ্গীর পর থেকে যাত্রী না উঠালেও আমাদের বাসগুলোতে তা উঠাবেই উঠাবে। মাঝে মাঝে বাসগুলো দুর্ঘটনার কবলিত হলেও মালিকপক্ষ্য থাকেন নির্বিকার। ফোন করেও সাড়া পাওয়া যায় না। এখানে আপনার নিরাপত্তা আপনাকেই নিতে হবে। কিন্তু কি আর করা, আমাদের আম জনতার যেহেতু দ্বিতীয় আর কোন পথ খোলা নেই তবে চলুন চেষ্টা করে দেখি ট্রেনের জন্য।

আটটার ট্রেন কয়টায় আসবে? এটা আমাদের দেশের জন্য একটা কৌতুক হলেও পাশের দেশে খবর এর হেডলাইন। কারন ওদের দেশে ট্রেন চলে ঘড়ির কাঁটা মেপে। ‘ইস্টিশনের রেলগাড়িটা, মাইপ্পা চলে ঘড়ির কাঁটা’ আমাদের জন্য শুধুই গানের কথা। তার পরেও আমরা ট্রেনেই চড়ি। তিনটি ট্রেন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ আসা-যাওয়া করলেও আপনি আমি রেলওয়ে স্টেশনে গেলে টিকিট পাবো না কাউন্টারে।

তবে ট্রেন ছাড়ার আগে ব্ল্যাকারদের কাছে বা যাদের ভালো যোগাযোগ আছে উপর মহলে তাদের কাছে টিকেট হাজির। টাকায় নাকি বাঘের চোখ পর্যন্ত মেলে। সমস্যা হলো আমাদের অনেকেরই পর্যাপ্ত টাকাটাই নেই শুধু। টিকেট কালোবাজারি কারা করে, কীভাবে করে, কাদের আস্কারায় করে ও এখনো বহাল তবিয়তে আছে সেটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্টিস্ট হওয়া অপ্রাসঙ্গিক!

আমাদের অবস্থা এতটাই নাজুক বা আমরা এতটাই অপাঙক্তেয় যে, আমাদের একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কামরা নেই এই তিনটা ট্রেনের একটাতেও। প্রথম শ্রেণির নামে অন্যন্য রূটের বাতিল বগিগুলো জুড়ে দেয়া হয় আমাদের জন্য। আগে কমলাপুর-বিমানবন্দর থেকে সোজা ভৈরব এসে থামতো, কারণ এখানে ইঞ্জিন ঘুড়িয়ে তবেই আমাদের কিশোরগঞ্জ এর দিকে যেতে হতো। কিন্তু কোন যুক্তিতে যে নরসিংদী আমাদের স্টপেজ হলো, সেটা বোঝা বেশ মুশকিল!

শোনা যায়, এই ট্রেনগুলো সরকার ইজারা দিয়েছে বেসরকারি কোম্পানির কাছে, সেই কোম্পানির মালিকের বাড়ি সেখানে, তাই স্টপেজ হবে! আবার ঢাকায় থাকেন কিন্তু অফিস নরসিংদী, তাদের জন্য এই স্টপেজটা ভীষণ কার্যকরী। এটাই কি আমাদের কিশোরগঞ্জবাসীর আন্তঃনগর সেবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য?

এখন এ কথা সবারই জানা, ঢাকার অসহনীয় যানজটের জন্য মতিঝিল থেকে উত্তরা যাওয়ার সহজ ও জনপ্রিয় মাধ্যম হচ্ছে রেলপথ, সেক্ষেত্রে আন্তঃনগর ট্রেনগুলো এই স্বল্পপাল্লার যাত্রীদের কাছে ভীষণ পছন্দের। এতে এইসব খুচরো যাত্রীদের উপকার হলেও আমাদের কিশোরগঞ্জবাসীদের মোটেই উপকার হচ্ছে না, বরং স্ত্রী সন্তান নিয়ে এই ট্রেনগুলোতে আমরা অস্বস্তিবোধ করছি। আর এই সব স্বার্থান্বেষী যাত্রীরা এটেন্ডেন্টদের সাথে যোগযাজসে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমন করে আমাদের বিরক্ত করার পাশাপাশি সরকারকে ঠকাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সড়ক পথে সরকার অসহায় মালিকপক্ষের কাছে, এসি বিয়ারটিসি বাস দেয়ার পরেও টিকিয়ে রাখতে পারেনি, আর তা হবেও না। কারন আমরা দুষ্টু মালিকদের সিন্ডিকেটের খেলার পুতুল বা তাদের মুনাফার অনেক বড় খরিদদার, আমরা ওদের সোনার ডিম দেয়া হাঁস। এই মালিকপক্ষের বিরাট এক অংশ আবার ভীষণ ধর্মভীরু, তবে শুনেছি উনারা নাকি প্যাকেট দেন আমাদের রেলওয়েতে, যেন যাত্রী সেবা আরো বাজে হয় (এমনিতেই বাজে সার্ভিস, তার উপর উপঢৌকনের টোপ...) এবং তারা সফল।

কিশোরগঞ্জে অবস্থান করেন, কিন্তু অনেকেই চাকরি করেন যারা এই ট্রেনে করে ভৈরব পর্যন্ত আসা যাওয়া করেন। তবে আরেকটু অগ্রসর হয়ে যদি মাননীয় সরকার বাহাদুর একটু সদয় হতো, তবে আমরা কিশোরগঞ্জ থেকে ঢাকা অফিস করে আবার মায়ের কোলে ফিরে যেতে পারতাম অনায়াসেই।

ঢাকায় এমন কিছু মধু নেই, যে আমরা পড়ে থাকবো। শুধু এই দূরত্বটুকু জয় করতে পারি না বলেই এই যান্ত্রিক নগরে নিত্য বসবাস আর প্রাণ করে হাঁসফাঁস। এতে ঢাকার উপর যেমন চাপ কমতো তেমনি আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠতো তাদের বাপ দাদার চিরচেনা নগরে আপন ভুবনে। আমাদের সংস্কৃতি হতো আরো ঋদ্ধ। আমাদের বৃদ্ধ বাবা মায়েরা পেতো জীবন সায়াহ্নে আপনজনের ছোঁয়া।

তাই ঢাকা টু কিশোরগঞ্জ সরাসরি ট্রেন চাই, ভায়া শুধুই ভৈরব...

তিনটি আন্তঃনগরের মধ্যে দুইটি ট্রেন অন্তত ভোরে ও সন্ধ্যায় চালু করা যেতেই পারে...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :