অতি সাধারণ এক সাংবাদিকের কথা-১৫

আলম রায়হান
 | প্রকাশিত : ১১ জানুয়ারি ২০১৭, ১৪:৫১

সাপ্তাহিক রিপোর্টারে প্রথম অ্যাসাইনমেন্টে আমার পারফর্মেন্সে সম্পাদক এরশাদ মজুমদার বেশ সন্তষ্ট হয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে জগন্নাথ হল ধ্বসের ফলোআপ রিপোর্ট কাজ করেছে প্রথম রাতে বিড়াল মারা প্রবাদের মতো। প্রথম আইটেম ঘটনাচক্রে প্রচ্ছদ রিপোর্ট হিসেবে ছাপা হওয়া কলিগদের মধ্যে একটা অবস্থানও সৃষ্টি হয়েছিল বাড়তি পাওনা হিসেবে। তবে অহম ভর করেনি। বরং আরও ভালো করার চাপ অনুভব করেছিলাম। সঙ্গে ছিল মোজাম্মেল ভাইর সীমাহীন সাপোর্ট। তিনি অবশ্য সবাইকেই সাপোর্ট দিতেন। গোবরে পদ্য ফুল কেবল নয়, পাথরেও ফুল ফোটাতে জানেন মোজাম্মেল ভাই, খন্দকার মোজাম্মেল হক।

এদিকে এরশাদ ভাই ছিলেন আইডিয়ার খনি। তিনি সবার সঙ্গে আইডিয়া শেয়ার করতেন। এরশাদ ভাইর আইডিয়া ও মোজাম্মেল ভাইর টিম চালানোর দক্ষতা- সবমিলিয়ে সাপ্তাহিক রিপোর্টার বেশ শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছিল।

তবে আমার জানামতে মোজাম্মেল ভাইর একমাত্র ব্যর্থতার উদাহরণ হচ্ছে মোজাম্মেল হক খোকন। সে সময়ে সাপ্তাহিক রিপোর্টারের সবার পারফর্মেন্স একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রায় থাকলেও মোজাম্মেল হক খোকন টিমের সঙ্গে একলয়ে চলতে পারছিলেন না। এতে সম্পাদক খুবই অসন্তষ্ট ছিলেন। বিষয়টি তিনি একাধিকবার প্রকাশও করেছেন। কিন্তু কোনো কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। এক পর্যায়ে সম্পাদকের মনে হলো, খোকন আসলে ঠিক মতো ব্রিফ পাচ্ছে না! এ ভেবে অথবা যে কারণেই হোক; একদিন সম্পাদক বললেন, মোজাম্মেল তোমাকে আর খোকনকে দেখতে হবে না; ওকে আমি দেখবো! উত্তরে মোজাম্মেল ভাই ইতিবাচক মাথা নাড়লেন এবং স্বভাবসুলভ কেবল একটু হাসলেন। মোজাম্মেল ভাইর হাসিটা এক অদ্ভূত বিষয়। দেখে বোঝার উপায় নেই, তিনি খুশি না কি বেজার।

মোজাম্মেল হক খোকন সরাসরি সম্পাদকের এখতিয়ারে চলে গেলেন। সম্পাদক আগের মতো সবাইকে ব্রিফ করার পরিবর্তে কেবল খোকনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। প্রতিদিন খোকনকে নানা বিষয়ে অনেক সময় নিয়ে ব্রিফ করা শুরু করলেন। এসময় মাননীয় সম্পাদক এমন একটি তৃপ্তি বোধ করতে শুরু করলেন যে, তিনি কাদামাটি দিয়ে ইমারত তৈরি করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যাচ্ছেন তিনি। এদিকে খোকনের মধ্যেও বেশ পরিবর্তন দেখা দিল। কথাবার্তাও সে শুদ্ধভাবে বলতে শুরু করলো, কিন্তু নোয়খালীর অনিবার্য মিশ্রণে খোকনের শুদ্ধ ভাষা অদ্ভূত রূপ পেল। এভাবে কয়েক সপ্তাহ কাটলো, কিন্তু খোকন তেমন প্রডাকশন দিতে পারছিল না। এরপরও সম্পাদক নাছোড়বান্দা হিসেবে লেগেই থাকলেন। যেনো এটা তার একটা চ্যালেঞ্জ। তবে শেষতক মাস দেড়েক পর তিনি ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন। দুই মাস পর দেখা গেল মোজাম্মেল হক খোকন আর অফিসে আসে না; হয় তার চাকরি গেছে অথবা হাইড্রোলিক প্রেসারে ছেড়ে দিয়েছে। এ সময় আমরা রসিকতা করে বলতাম, একটা মাটির হাড়িতে মোজাম্মেল ভাই টুকটাক করে সুর তুলছিলেন, কিন্তু এরশাদ ভাই মাটির জিনিসকে ঢোল ভেবে বাজাতে গিয়ে ভেঙেই ফেললেন!

এ বিষয়ে হার খুব সহজভাবে নিতে পারছিলেন না এরশাদ ভাই। একদিন বললেন, সবাইকে সাংবাদিক হতে হবে- এমন কোনো কথা নেই; দেখবা খোকন অন্য লাইনে ভালো করবে। শেষতক এরশাদ ভাইর কথাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। রাজধানীর মিরপুর এলাকার সংসদ সদস্য কামাল মজুমদারের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা হিসেবে মোজাম্মেল হক খোকন বেশ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন এবং দীর্ঘ সময় ধরে তার সঙ্গেই যুক্ত আছেন। শোনা কথা, মোহনা টেলিভিশন সৃষ্টির পেছনেও মোজাম্মেল হক খোকনের বেশ অবদান আছে। আসলে যারা সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় অবদান রাখার যোগ্যতাসম্পন্ন তারা প্রায় ক্ষেত্রেই সাধারণ কাজে খাপ খাওয়াতে পারেন না।

এরশাদ ভাই একটা কথা জোর দিয়ে বলতেন। তা হচ্ছে, লেখায় নিজের মতামত সরাসরি না চাপানো। তিনি অল্প শব্দে ছোট বাক্যে লিখতে বলতেন। যে বিষয়টি পরে নিশ্চিত করতে দেখেছি নাইমুল ইসলাম ও শফিক রেহমানকে আমাদের সময় ও যায়যায়দিনে কাজ করার সময়। প্রয়োজন হলে অন্যের বয়ানে দিতে বলতেন এরশাদ ভাই। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সাক্ষাৎকার ছাপার পক্ষে ছিলেন। আর এ বিষয়টি আমার বেশ ভালো লাগতো। ফলে এক পর্যায়ে ভিউজ পত্রিকা থেকে সাপ্তাহিক রিপোর্টার হয়ে গেল ইন্টারভিউ পত্রিকা। প্রায় দশ বছর পর ১৯৯৬ সালে চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর সরকারি বাসায় একজন সাংবাদিক আলাপচারিতায় সাপ্তাহিক রিপোর্টার-এর উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, কেবল সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি পত্রিকা হতে পারে। বন্ধ হয়ে যাওয়া সাপ্তাহিক রিপোর্টার প্রসঙ্গ ওঠায় আমি বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। এ প্রসঙ্গ তোলা এ সাংবাদিককে আমি আগে চিনতাম না। তবে তিনি হাসানাত পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কেউ হবে তা আঁচ করতে পারছিলাম। অবশ্য কে কার ঘনিষ্ঠ সে বিষয়ে আমার কোনো আগ্রহ কোনো সময়ই ছিল না। তবে তার বক্তব্য আমার প্রবণতার পক্ষে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যেই আমি ঘনিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিলাম অত্যন্ত সজ্জন এই মানুষটির সঙ্গে। পরে তার ছায়ায় আমি মাই টিভিতে কাজ করেছি; অবশ্য মাইটিভির সঙ্গে তার সংযোগ আমি সৃষ্টি করেছিলাম। খুবই মেধাবী, বেহিসেবী ও অভিমানী পরম শ্রদ্ধেয় এ সাংবাদিকের নাম আবু আল সাঈদ, ডাক নাম নান্টু। আমাদের প্রিয় নান্টু স্যার। তার প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত থাকবে মাই টিভি পর্বে।

পেশাগত জীবনের বর্তমানে আমার যা কিছু অবস্থান তা শামসুল হক আলী নূর সাপ্তাহিক রিপোর্টার সম্পাদক এরশাদ মজুমদারের সঙ্গে আমাকে সংযুক্ত করার সূত্র ধরে। এ ক্ষেত্রে প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন মোজাম্মেল ভাই, খন্দকার মোজাম্মেল হক এবং নিজাম ভাই, নঈম নিজাম। দৈনিক নবঅভিযান থেকে শুরু করে আমাদের সময়, বাংলারবাণী, দিনকাল, বাংলাবাজারপত্রিকা, যায়যায়দিন, বাংলাভিশন, মাইটিভি পর্যন্ত সবই সাপ্তাহিক রিপোর্টার-এর পরিচয়ের সূত্র ধরে।

সাপ্তাহিত রিপোর্টার-এ থাকাকালেই মোজাম্মেল ভাই সাপ্তাহিক আবির্ভাবে কন্ট্রিবিউট করার সুযোগ করে দেন, সম্পাদক ছিলেন কাশেম মজুমদার। এ সূত্রে দৈনিক সমাচারে আমি চিফ রিপোর্টার হই, এ সমাচারেই পরিচয় হয় বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার মোস্তফা ফিরোজের সঙ্গে। এ পরিচয়ের সূত্র ধরে অনেক পরে বাংলাভিশন-এ সুযোগ লাভ। সাপ্তাহিক রিপোর্টার পর্ব সমাপ্ত হবার পর মোজাম্মেল ভাই ইকবাল কবীরের মাধ্যমে খবর দিয়ে সাপ্তাহিক সুগন্ধায় নিয়েছিলেন চিফ রিপোর্টার করে। এ সুগন্ধার সূত্র ধরেই আবেদ খান, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, মতিউর রহমান চৌধুরী, আলতাফ মাহমুদ, সাজাহান সর্দার, নঈম নিজাম, সাইফুল আলম, আজিজুল হক বান্না, ওবায়দুল কাদেরসহ সে সময় লেখালেখিতে সক্রিয় সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। এদের মধ্যে নিজাম ভাই ২০০৪ সালে আমাকে সংযুক্ত করেন নাঈম ভাইর আমাদের সময়-এ এবং এসটিভি ইউএস-এর টকশো মুখোমুখি সঞ্চনালয়। সংক্ষেপে বললে, নিজাম ভাইর মাধ্যমেই প্রিন্ট মিডয়ার মূল ধারা ও টেলিভিশনে আমার সংযুক্ত হওয়া। শুধু তাই নয়, টেলিভিশনের টক শোর গেস্ট হওয়ার সূচনাও নিজাম ভাইর বদান্যতায়। এদিকে মিডিয়া লিডার হিসেবে তার শক্ত অবস্থান যখন অনেকের ঈর্ষার পারদে তুঙ্গে তখন ২০১৬ সালের বিদায়ী দিনে অনুষ্ঠিত জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাচনের ফলাফলে অনেকেই অবাক বিস্ময়ে বুঝলেন, নির্বাচনের কারিগর হিসেবেও নঈম নিজাম কয়েক ধাপ এগিয়ে।

লেখক: মাই টিভি প্রধান বার্তা সম্পাদক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :