ডাক্তারদের জন্য হাইকোর্টের প্রেসক্রিপশন

মাসুদ কামাল
| আপডেট : ১৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:২০ | প্রকাশিত : ১৬ জানুয়ারি ২০১৭, ১৯:১৪

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের হাইকোর্ট একটা রায় দিয়েছে। বিষয়টি দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট। আদালত বলেছে এখন থেকে ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশন বা ব্যবস্থাপত্র অস্পষ্ট হস্তাক্ষরে দেওয়া চলবে না। উচ্চ আদালতের এই রায় আমাকে খুশি করেছে, কিন্তু আশ্বস্ত করতে পারেনি। কেন আশ্বস্ত করতে পারেনি, সেটা পরে বলছি, আগে বরং সন্তুষ্টির কথাটি বলে নিই।

এই প্রেসক্রিপশনে ডাক্তারদের দুর্বোধ্য হাতের লেখা নিয়ে সাপ্তাহিক এই সময়-এ একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল গত ২০ নভেম্বর ২০১৬ । ‘ডাক্তারদের দুর্বোধ্য প্রেসক্রিপশন কার স্বার্থে’ শিরোনামে আমার সেই লেখাটি প্রকাশের প্রায় এক মাস পর, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তায় ‘দুর্বোধ্য ব্যবস্থাপত্র/ ভুল ওষুধ গ্রহণের ঝুঁকিতে রোগীরা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর গত ৯ জানুয়ারি ২০১৭ হাইকোর্ট থেকে আসে সেই নির্দেশনাÑচিকিৎসকদের ক্যাপিটাল লেটারে অথবা এমনভাবে ব্যবস্থাপত্র লিখতে হবে যাতে তা সহজেই পড়া যায়। এই মর্মে আগামী ত্রিশ দিনের মধ্যে সার্কুলার জারি করার জন্য সরকারকে নির্দেশনা দেয় হাইকোর্ট। সন্দেহ নেই দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই আদেশ অবশ্যই আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একটা বড় পদক্ষেপ। অনেক অনিয়ম আর অপচিকিৎসার হয়ত অবসান হবে এই নির্দেশ বাস্তবায়িত হলে।

উচ্চ আদালত এই আদেশটি দিয়েছে গত ৯ জানুয়ারি সোমবার। আদেশ অনুযায়ী আর ২৬ দিনের মধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত সার্কুলার জারি করতে হবে। সার্কুলার জারি হলে চিকিৎসকদের জন্য এটি মেনে চলা বাধ্যতামূলক হবে। আদেশের পর এরই মধ্যে কয়েকদিন অতিক্রান্ত হয়েছে। আদেশটি যে জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়, তা নিয়ে কারও মধ্যেই আমি দ্বিধা দেখিনি। এমন বেশ কয়েকজন ডাক্তারকে আমি চিনি, যাদের হাতের লেখা প্রেসক্রিপশন মাঝেমধ্যেই দুর্বোধ্য বলে স্বীকৃতি পেয়েছে, তারা পর্যন্ত বলেছেনÑ আসলেই প্রেসক্রিশনের লেখা ওষুধের নাম ও নির্দেশনা স্পষ্ট হওয়া উচিত। লেখা পড়তে না পারলে ফার্মেসির লোকজন ওষুধ দেবে ধারণার ওপর নির্ভর করে। আর নির্দেশনা বুঝতে না পারলে রোগীর পক্ষে সেই ওষুধ গ্রহণ করাও যথাযথ হবে না।

এতসব উপলব্ধি সত্ত্বেও আদালতের নির্দেশনার তিনদিন পরও ওই ডাক্তার সাহেব কিন্তু তার দেওয়া প্রেসক্রিপশনের ধারা এখনো আগের মতোই রেখেছেন। জানিয়েছেন, আগামীতে হয়ত একটা ল্যাপটপ এবং প্রিন্টার নিয়ে নেবেন, যাতে প্রিন্টেড প্রেসক্রিপশন দেওয়া যায়। যতদিন সেটা নেওয়া সম্ভব না হবে, ততদিন বরং ক্যাপিটাল লেটারেই প্রেসক্রিপশন লিখবেন। এতসব তিনি ভাবছেন। এখনো রয়েছেন সেই চিন্তা-ভাবনার স্তরেই, বাস্তবায়নে যাননি। আরও দু-একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, তারাও সবাই অপেক্ষা করছেন সরকারি সার্কুলেশনের জন্য। বলেছেন, দেখি না সরকার কি করে। তারা তো বিষয়টি নিয়ে আপিলও করতে পারেন।

ডাক্তার সাহেবদের এমন চিন্তা আমাকে হতবাক করেছে। এর কি তাহলে কেবল আইনি বাধ্যবাধকতাটাই দেখেছেন, নৈতিক বিষয়গুলো তাদের কাছে কোনোই গুরুত্ব পাচ্ছে না? ধরা যাক ঠা-াজনিত সমস্যা নিয়ে একজন গেছেন ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার সাহেব তার প্যাঁচানো হাতের লেখায় লিখে দিয়েছেন ঞৎড়ভবহ, লেখার দুর্বোধ্যতার কারণে ফার্মেসির আনাড়ি বিক্রেতা ‘টি’কে মনে করলেন ‘পি’। ট্রোফেনের পরিবর্তে রোগী কিনে নিয়ে এলেন প্রোফেন। যা নিয়ে এলেন সেটি ঠা-ার কোনো কাজেই আসবে না, এটা ব্যথানাশক ওষুধ। অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই ওষুধ খেলে নানা ধরনের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। প্রায় সমুচ্চারিত নাম কেন থাকে বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধের? এমন প্রশ্নও আসতে পারে। এর উত্তরও সহজ। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন কোম্পানির সব মিলিয়ে প্রায় ২৭ হাজার ওষুধ রয়েছে। এই সবকটি ওষুধেরই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বাণিজ্যিক নাম। তো এই ২৭ হাজার নাম মুখস্থ রাখা কিভাবে সম্ভব? আর ওষুধগুলোর নামেরও কিন্তু প্রায়ই কোনো অর্থ হয় না। অর্থ না থাকার কারণে সেগুলোর বানানও সবসময় মনে রাখা সহজ হয় না। ফলে কেবল যে অস্পষ্ট হাতের লেখাই একমাত্র সমস্যা তা কিন্তু নয়, বরং বানান ভুলের বিষয়টাও থেকে যাচ্ছে।

একজন ওষুধ ব্যবসায়ী এ প্রসঙ্গে আমাকে একটা কথা বললেন। (এই কথাটাই লিখব বলে কথা দিয়েছিলাম আমি ২০ নভেম্বর এই সময়-এ প্রকাশিত লেখার একেবারে শেষ দিকে।) তিনি এত এত ওষুধের নাম ও বিচিত্র বানানের সঙ্গে প্যাঁচানো দুর্বোধ্য লেখার একটা যোগসূত্রও দেখালেন। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে খাপছাড়া মনে হলেও তার যুক্তিগুলো বেশ গ্রহণযোগ্য মনে হলো। তিনি বললেন, দেখুন এত এত নাম, যে নামের কোনোই অর্থ হয় না, সেগুলোর সঠিক বানান সবসময় লিখতে পারা দুরূহ কেবল নয়, রীতিমতো অসম্ভব। তাই এ রকম একটা কাজ যদি স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লিখতে যায়, তাহলে হয়ত বানান ভুলের বিষয়টি ধরা পড়ে যাবে। সে কারণেই তারা এমন জড়ানোভাবে লিখেন যে, বানানের ভুলটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে না! আমি জানি, এসব কথা হয়ত খুবই হাস্যকর ঠেকবে, কিন্তু এছাড়া আর কি যুক্তিই বা থাকতে পারে? এসব কারণেই মনে হয়, জটিল এ সমস্যা থেকে উত্তরণে ওষুধ কোম্পানিগুলোরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। এই অবধারিত ভূমিকার কথা এবার আদালতও কিছুটা বলে দিয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে স্পষ্টভাবে প্রেসক্রিপশন লেখার পাশাপাশি ওষুধের ব্র্যান্ড বা বাণিজ্যিক নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম লেখার কথাও বলা হয়েছে। কেন প্রেসক্রিপশনে জেনেরিক নাম লেখা হবে না এই মর্মে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শাতে বলেছে। জেনেরিক নামে ডাক্তাররা যদি প্রেসক্রিপশন লিখেন, তাহলে তাদের স্মরণশক্তির উপরও বাড়তি চাপ পড়বে না। তাকে আর ২৭ হাজার অর্থহীন বিচিত্র নাম মুখস্থ করতে হবে না। ৯০ শতাংশ নামই হারিয়ে যাবে রাতারাতি। তবে ডাক্তারদের এই কাজটি আরও সহজ হবে যদি ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেরাই জেনেরিক নামে ওষুধ বাজারজাত করতে শুরু করে। কিন্তু সেটা কি আদৌ সম্ভব? ওষুধ কোম্পানিগুলোর মধ্যে কি অতটা দায়িত্বপূর্ণ মানসিকতা আদৌ রয়েছে? নেই যে, তার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।

গত কয়েক মাস ধরেই একটা বিষয় আমার খুব চোখে পড়ছে। ফার্মেসির লোকেরা যে কাগজের প্যাকেটটিতে ওষুধ ভরে দেন, সেই প্যাকেটটি আসলে একটি বিজ্ঞাপন। প্যাকেটের দুদিকেই কোনো না কোনো ওষুধের বর্ণনা, সেটি কি কি রোগের জন্য কাজ করে, কেন সেটি একই ধরনের অন্য অনেক ওষুধের চেয়ে ভালোÑ সেসব লেখা রয়েছে বিস্তারিত। যতদূর জানতাম দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়া বেআইনি। তাহলে এ ধরনের বিজ্ঞাপন কেন? বেশ কিছুদিন এ রকম বিজ্ঞাপনের প্যাকেট অবাধে চলার পর সম্ভবত এই নীতিহীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বজ্ঞান আরও লোপ পেয়ে গেল। এবার তারা প্রকাশ্যে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করল। চলতি সপ্তাহেই দেশের প্রধান একটি দৈনিকে এ রকম একটা ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখলাম। বিজ্ঞাপনে লেখা রয়েছে ওষুধটি নাকি এসিডিটি ও গ্যাস্ট্রিক আলসার চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়। কোন ওষুধটি কি রোগে ব্যবহার করা হয়, সেটি যদি পত্রিকার বিজ্ঞাপনেই দেওয়া থাকে, তাহলে মানুষ আর ডাক্তারের কাছে কেন যাবে?

পরিচিত একজন চিকিৎসকের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এভাবে পত্রিকায় কোনো ওষুধের বিজ্ঞাপন দেওয়াটা কি ঠিক? বিজ্ঞাপনের একটা ছবিও আমি তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছবিটি দেখে তিনি খুবই অবাক হলেন। বললেন, ইসমোপ্রাজোল তো একেবারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন কোন ওষুধ নয়। এটি গ্রহণ করতে হলে ডাক্তারের পরামর্শক্রমেই করা উচিত। এ ওষুধ এভাবে কসমেটিকসের মতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রয় করা ঠিক নয়। বিজ্ঞাপনটির মধ্যে কিছু চাতুর্য অবশ্য ছিল। মার্জিনের বাম দিকে অতি ছোট হরফে লেখা রয়েছে যে, এই বিজ্ঞাপনটি নাকি ওষুধ প্রশাসন পরিদপ্তরের অনুমোদনক্রমে প্রকাশ করা হয়েছে। এই অনুমতি এই পরিদপ্তর কি করে দিল, সেটা নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। বিজ্ঞাপনটির একেবারে নিচেও একটা নোট রয়েছে, সেখানে বলা হয়েছেÑ‘শুধুমাত্র রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র মোতাবেক নিয়মিত এন্টিবায়টিক সেবন/গ্রহণ করুন।’ এই নোটটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু একই সঙ্গে স্থানিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও বিভ্রান্তিকর। ইসমোপ্রাজলের বিজ্ঞাপনের নিচে এন্টিবায়টিক বিষয়ে এমন নোট থাকায় অনেকে মনে করতে পারেন যে, গ্যাস্ট্রিকের এই ওষুধটি চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াও যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে। আসলে সমস্যাটা এখানেই। আমাদের দেশে যারা ওষুধ বানাচ্ছে, তারা টয়লেট্রিজও বানাচ্ছে, ইলেকট্রনিক্স দ্রব্যাদিও বিক্রি করছে। তাদের খাবারের দোকানও রয়েছে। তাদের কাছে ওষুধ আর দশটা পণ্যের মতোই। যেকোনো উপায়ে এর বিক্রি বাড়ানোই মূল লক্ষ্য, কিভাবে বাড়ানো যাবে আরও মুনাফাÑ তা নিয়েই তাদের যত চিন্তা। আর দুর্ভাগ্য আমাদের, কোম্পানিগুলোর এ অনৈতিক কর্মকা সহযোগী ভূমিকায় অবতীর্ণ এখন দেশের চিকিৎসক সমাজের বড় একটা অংশ। এর চেয়ে হতাশার আর কি থাকতে পারে!

এত হতাশার মধ্যে স্বস্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে হাইকোর্টের এই রায়টি। কিন্তু শুরুতেই আমি বলেছি, এই রায় আমাকে খুশি করতে পেরেছে, কিন্তু আশ্বস্ত করতে পারেনি। তার কারণ আর কিছু নয়, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার গাছাড়া মনোভাব। নির্দেশনা তো আদালত দিয়েছে, সে অনুযায়ী সরকার হয়ত সার্কুলারও জারি করবে, কিন্তু বাস্তবায়িত কি হবে? উদাহরণ কি বলে? এই উচ্চ আদালত তো একবার এমন আদেশও দিয়েছিল যে, ঢাকার রাজপথে ফুটপাত দিয়ে মোটরবাইক চালানো যাবে না। সে আদেশ কি বাস্তবায়িত হয়েছে? সেদিন তো এক পুলিশকেই দেখলাম ফুটপাতের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে যেতে! প্রেসক্রিপশন বিষয়ক রায়েরও যেন এমন মর্মান্তিক পরিণতি না হয়, সেই প্রার্থনাই করতে পারি আমরা।

মাসুদ কামাল : লেখক ও জেষ্ঠ্য সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :