স্যালুটকাণ্ডে পিরোজপুরে ‘একঘরে’ সাঈদীপুত্র

সৈয়দ মাহ্ফুজ রহমান, পিরোজপুর থেকে
| আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩১ | প্রকাশিত : ১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:২১

পিরোজপুরের বিজয় কুচকাওয়াজে মানবতাবিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছেলে মাসুদ সাঈদীর সালাম গ্রহণ নিয়ে তোলপাড় হয়েছে সারা দেশেই। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদেরও এই ঘটনায় চাপের মুখে থাকতে হয় বেশ কিছু দিন। এই কাণ্ডের পর এলাকার কোনো অনুষ্ঠানে আর দাওয়াত দেয়া হয়নি তাকে। এলাকাতেও প্রকাশ্যে দেখা যায়নি সাঈদীপুত্রকে।

পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু তার নির্বাচনী এলাকা (জিয়ানগর) সফরে উপজেলা চেয়ারম্যান সাঈদীপুত্রের সরব উপস্থিতি থাকত সব সময়। তবে গত ৪ জানুয়ারি মন্ত্রীর সফরের দিন মাসুদ সাঈদী অনুপস্থিত ছিলেন। ৯ জানুয়ারি উন্নয়ন মেলায় উপস্থিত হলেও উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র পরিচালিত ২৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ্যাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচির বার্ষিক উন্নয়ন কর্মশালার অনুষ্ঠানেও তিনি ছিলেন উপেক্ষিত।

১২ জানুয়ারি উপজেলার সেতারা স্মৃতি বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবীনবরণ ও পিঠা উৎসবের অনুষ্ঠানেও সাঈদীপুত্রকে দেখা যায়নি। এ ব্যাপারে ইন্দুরকানী (জিয়ানগর) উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মতিউর রহমান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘উপজেলা চেয়ারম্যান পূর্বে কখনোই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননা জানাননি। তবে গত ১৬ ডিসেম্বর আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাহেব ভারতে অবস্থান করার সুযোগে তিনি স্থানীয় প্রশাসনের কর্মচারী, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ও ডেপুটি কমান্ডারের যোগসাজশে ওই দিনটিকে বিতর্কের মধ্যে ফেলে দেন। এর পর থেকে তিনি আমাদের কোন প্রোগ্রামে আসেন না, আমরাও যাই না, দাওয়াতও দেই না।’

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মৃধা মনিরুজ্জামান বলেন, ‘আমরা তাকে বয়কট করেছি। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে যে কা- ঘটিয়েছেন তাতে তার সঙ্গে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা সম্ভব নয়। আমাদের কথা ছিল তিনি কোন মুক্তিযোদ্ধাদের অনুষ্ঠানে থাকতে পারবেন না। কিন্তু তিনি উপজেলা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রেস্ট দিয়েছেন। আমাদেরকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানালে আমরা সেই অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। এরপর থেকে তিনি আর কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছেন না।’

তবে মাসুদ সাঈদী ঢাকাটাইমসকে উপজেলা চেয়ারম্যান মাসুদ সাঈদী ঢাকাটাইমসকে বলেন, তার এসব অনুষ্ঠানে না যাওয়ার সঙ্গে ১৬ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠানের যোগসূত্র নেই। তিনি বলেন, ‘কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়া না হওয়া নিয়ে সরকারি কোন বিধি নিষেধ নেই। আমি মনে করি, আমাদের সকলে মিলেই উন্নয়ন করতে হবে।’

সাঈদীপুত্র বলেন, “আমাদের মন্ত্রী মহোদয় (পরিবেশমন্ত্র) একটি কথা প্রায়ই বলেন, আমি সেটাই ধারণ করি। তা হলো ‘রাজনীতি যার যার, উন্নয়ন সবার’। গত ৪ জানুয়ারি ঢাকায় থাকার কারণে মন্ত্রীর অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এ বিষয়ে মন্ত্রী সাহেব আসার আগেই তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। এ ছাড়া, আমি প্রতিদিন অফিস করি এবং প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি।”

গত ১৬ ডিসেম্বরের পর থেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক কেমন-জানতে চাইলে সাঈদীপুত্র বলেন, ‘ভাল যাচ্ছে, আমি এখনও যে কোন অনুষ্ঠানের তাদের আমন্ত্রণ জানাই। তাকে কার্পণ্য করি না।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার কথা উল্লেখ করে সাঈদীপুত্র বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সম্পাদক শিক্ষিত ও সম্মানিত মানুষ। তাদের অনেক অবদান আছে, এটা অস্বীকার করা যাবে না। আমার মৃত্যু হলে তারাই আমাকে দাফন দিতে এগিয়ে আসবেন, তাদের সাথে দ্বিমত কীসের। ১৬ ডিসেম্বর নিয়ে তারা হয়তো দলীয়ভাবে জেলা কমিটির চাপে পড়ে কিছুটা দূরত্বে থাকার চেষ্টা করছেন।’

মাসুদ সাঈদী ১৬ ডিসেম্বরের আগে কোন অনুষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে নিয়মিত ফেসবুক বিভিন্ন ছবি ও স্ট্যাটাস দিতেন। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বরের পর প্রায় এক মাস তিনি কোনো স্ট্যাটাস দেননি। সবশেষ গত ১৪ জানুয়ারি একটি স্ট্যাটাস দেন। তার লেখাটি ছিল এমন:

যখন ভাল কাজ গুলি বাঁকা চোখে দেখা হয়,

তখন বুকের ভেতর গভীর কষ্টকর এক ব্যাথা অনুভূত হয়।

মন খারাপ হয়ে যায়,

হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়,

মানুষ জানতে চায় কি হয়েছে,

খুব সহজে হাসি মুখে বলে দিই কিছুই না!

কিন্তু আমার তো অনেক কিছুই বলার ছিল।

২০১৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তৎকালীন জিয়ানগর উপজেলায় জিতে যান মাসুদ সাঈদী। জামায়াতের নেতা হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন দলের সঙ্গে বরাবর সুসম্পর্ক বজায় রেখে আসছেন সাঈদী। গত তিন বছরে তেমন কোন সমস্যার মুখোমুখী না হয়ে নির্বিঘ্নেই উপজেলা পরিষদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। কিন্তু গত বিজয় দিবসের পর থেকে পাল্টে গেছে পরিস্থিতি।

১৬ ডিসেম্বর জিয়ানগর (বর্তমানে ইন্দুরকানী) উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মাননা ও পুরস্কার বিতরণ করেন মাসুদ সাঈদী। বিজয় কুচকাওয়াজের স্যালুটও দেয়া হয় তাকে। অনুষ্ঠানে সাঈদী পুত্রের পাশে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সম্পাদকও উপস্থিত ছিলেন। রাজাকারপুত্রকে সালাম দেয়া আর তার হাত থেকে মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা গ্রহণের পর শুরু হয় তোলপাড়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাদেরকে কড়া ভাষায় সতর্ক করে। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা সংবাদ সম্মেলন করে এই ঘটনায় নিজেদের দায় অস্বীকার করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসব সংবাদ প্রচারের পর প্রথমে জিয়ানগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মিজানুল হককে প্রত্যাহার করার আদেশ আসে। এরপর প্রত্যাহার করা হয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জাকির হোসেন বাচ্চুকে।

এই ঘটনার পর থেকে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা এক ধরনের শিক্ষা পেয়েছেন। ফেসবুকে ছবি পোস্ট এবং স্ট্যাটাসের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করছেন। জামায়াত বা বিএনপি ঘরানার নেতাকর্মীদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে ছবি তোলা বা চায়ের আড্ডাও এড়িয়ে চলছেন তারা। এই ঘটনার পর থেকে সতর্ক উপজেলা প্রশাসনও। স্থানীয় কোনো অনুষ্ঠানে আর মাসুদ সাঈদীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। প্রশাসনের সূত্র জানায়, একাধিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু বাধা দেন আওয়ামী লীগ নেতারা। একটি অনুষ্ঠানে মাসুদ সাঈদী থাকলে আওয়ামী লীগ নেতারা থাকবেন না-এমন ঘোষণা দেয়া হলে সাঈদীপুত্রকে আর আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

ঢাকাটাইমস/১৭জানুয়ারি/প্রতিনিধি/ডব্লিউবি

সংবাদটি শেয়ার করুন

বাংলাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :