বইয়ে ভুল, অসহায় শিক্ষামন্ত্রী

মাহবুব রেজা
 | প্রকাশিত : ১৭ জানুয়ারি ২০১৭, ১৫:৩৭

শিক্ষামন্ত্রীর কপালটাই খারাপ। তিনি দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে যুগান্তকারী কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন যার জন্য নানা মহলে প্রশংসিত। কিন্তু ওই যে বললাম কপাল মন্দ হলে তিনি আর কি করবেন! সাম্প্রতিককালে নতুন পাঠ্যপুস্তকে ভুল আর উলটা-পালটা লেখা নির্বাচন নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দোষ না করেও শিক্ষামন্ত্রীকে এর দায়ভার নিতে হয়েছে। কারণ মন্ত্রী হিসেবে তিনি পার পেতে পারেন না। তবে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা পাঠ্যপুস্তকে সীমাহীন ভুলত্রুটিকে একটি মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করে সংশয় প্রকাশ করে জানান, এর মাধ্যমে মুক্তমনা, উদার চিন্তার মানুষ সর্বোপরি সৎ ও সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত নুরুল ইসলাম নাহিদকে বিতর্কিত করার কোনো অভিপ্রায় মহলটির আছে কি না তা খতিয়ে দেখা দরকার ।

একই সঙ্গে তারা এও বলছেন, শিক্ষামন্ত্রীকে যদি সব বিষয়ের জন্য সংবাদ সম্মেলন করে এর জন্য ফিরিস্তি দিতে হয় তাহলে বুঝতে হবে তিনি যাদের ওপর দায়িত্ব দিয়েছেন তারা অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না। তারা অনেকটা দায়সারাভাবে সেই কাজ করছেন যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে পাঠ্যপুস্তকে ভুল আর উলটা-পালটা লেখা নির্বাচন যার কাফফারা দিতে হচ্ছে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদকে। বিগত বছরগুলো পর্যালোচনা করলে এর ধারাবাহিকতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। বিষয়টিকে তারা উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছেন।

শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলে বলছেন, দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা কিছু চিহ্নিত, সুবিধাবাদী শিক্ষাবিদের কবলে পড়ে গেছে যা দুঃখজনক। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সর্বাঙ্গীণ উন্নয়নে বিদেশি আদলে কিছু কিছু পরিবর্তন হয়ত আমাদের দরকার তাই বলে প্রেসক্রাইব শিক্ষাব্যবস্থার কি আদৌ প্রয়োজন আছে কি না সেটাও এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে বলে তারা মনে করেন। সাম্প্রতিককালে পাঠ্যপুস্তক ঘিরে যে বিতর্ক দেখা দিয়েছে এর জন্য তারা চিহ্নিত, সুবিধাবাদী শিক্ষাবিদদের মোটা দাগে দায়ী করেছেন।

যদিও শিক্ষামন্ত্রী পাঠ্যপুস্তকে ভুলের জন্য এর সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বিভিন্ন বইয়ে ভুলের জন্য দায় স্বীকার করে শিক্ষামন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়ে পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, আমি এ রকম (ভুল) আশা করিনি। কিন্তু তারপরও যারা এই ভুল করেছেন তারা কোনোভাবেই রেহাই পাবেন না। সংবাদ সম্মেলনে পাঠ্যপুস্তকে এ ধরনের ভুলভ্রান্তি নিয়ে এনসিটিবির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে ভুল! একসময় এরকম কোনো বিষয় ভাবাই যেত না। পাঠ্যপুস্তকে ভুল বিষয়টিকে শিক্ষার্থীরা তো বটেই অভিভাবকসহ সবার কাছে প্রায় চিন্তারও অতীত বলে মনে করা হতো। তখন পাঠ্যপুস্তকে ভুল বানান, বিতর্কিত বিষয়ে লেখা ছাপা হওয়াকে এক ধরনের অন্যায় হিসেবে গণ্য করা হতো।

পাঠ্যপুস্তকে ভুল ছাপা, নীতিবিরোধী বিকৃত বিষয় ছাপা কোনোভাবেই উচিত নয় বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট লেখক, শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি পাঠ্যপুস্তকে ভুলভ্রান্তি নিয়ে বলেন, এ সব বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। কারণ এতে করে শিক্ষাখাতে যতটুকু সুনাম হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কমিটি গঠন করে পাঠ্যবইয়ে বিষয় নির্বাচনে ঘন ঘন পরিবর্তন করলে শিশুদের ওপর তার বিরূপ প্রভাব পড়ে। এসব কমিটির যোগ্যতা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলে বলেন, নিজে বানিয়ে কিছু লিখে দিলাম সেটা উচিত নয়। ভাষারও একটা স্বকীয়তা আছে, সেটা না জানলে সমস্যা। এই স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ পাঠ্যপুস্তক থেকে যুক্তাক্ষর তুলে দেওয়ার তীব্র নিন্দা করে বলেছেন, ‘পাঠ্যবই থেকে যুক্তাক্ষর তুলে দেওয়া অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত।’ এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সব কিছুকেই কেন সহজ করতে হবে? একটি শিশু ছোটবেলা থেকে যদি যুক্তবর্ণ না শেখে তাহলে সে কখন শিখবে।’

দুই. প্রশ্ন উঠেছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের এসব বইয়ের পাঠ্যসূচি, লেখা নির্বাচন, সম্পাদনা এবং সর্বশেষে কিভাবে তা ছাপা হয়। জানা যায়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বইয়ের পা-ুলিপি তৈরির পর তা সম্পাদনা ও মানোন্নয়ন এনসিটিবির দায়িত্ব। বিশেষজ্ঞ শিক্ষকরা এর সঙ্গে জড়িত থাকেন। এনসিটিবির প্রধান সম্পাদক চূড়ান্তভাবে সই না করলে এসব বই ছাপা হয় না। এখানেই মোটা দাগে প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্ট শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা। প্রাথমিক পর্যায়ে ভুলত্রুটি কিংবা বুঝতে না পারার সীমাবদ্বতা থাকতেই পারে কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনঃযাচাই-বাছাই না হলে তার পরিণাম যে কি ধরনের ভয়াবহ হতে পারে তার নমুনা এনসিটিবি গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে দিয়ে চলেছে বলে মত প্রকাশ করেছেন তারা।

অভিযোগ পাওয়া গেছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে নিজেদের ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করাতে কিছু মুখচেনা (এদের মধ্যে নবীন-প্রবীণ অনেকেই আছেন) রাজনৈতিক সমর্থনপুষ্ট কবি-সাহিত্যিককে নির্লজ্জভাবে সংসদ সদস্য-সচিব-মন্ত্রী পর্যন্ত দৌড়ঝাঁপ করতে ব্যস্ত দেখা যায়। এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা এদের অপতৎপরতায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একাধিক ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে জানা যায়, পাঠ্যবইয়ে ছাপা হয়ে যাওয়া ভুল ও বিতর্কিত বিষয়ে তিনি সংশ্লিষ্টদের ব্যাপারে প্রচ- বিরক্ত। মন্ত্রী তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, যাদের ওপর কোমলমতি শিশুদের জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করার পবিত্র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সেই তারাই যদি আমাদের সর্বজনবিদিত বিখ্যাত কবি কুসুমকুমারী দাশের বহুল পঠিত ‘আদর্শ ছেলে’ সঠিকভাবে না জানে সেই দুঃখ রাখার জায়গা কোথায়? মন্ত্রী এই জ্ঞানীদের ব্যাপারে মারাত্মকভাবে রুষ্ট। কুসুমকুমারী দাশের আদর্শ ছেলের মূল সংস্করণের প্রথম লাইনটি হলোÑ ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে।’ অথচ তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইতে সংশ্লিষ্ট জ্ঞানীরা নিজেদের জ্ঞানের বহর দেখাতে কার্পণ্য করেননি। এই জ্ঞানীরা কুসুমকুমারী দাশের এই লাইনকে লিখেছেÑ ‘আমাদের দেশে সেই ছেলে কবে হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক সূত্র জানায়, আমাদের ভাগ্য ভালো যে, কুসুমকুমারী দাশ আজ বেঁচে নেই। তিনি বেঁচে থাকলে নির্ঘাত তার কবিতা বিকৃতির দায়ে মন্ত্রী, এনসিটিবির বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করতে পারতেন ।

শপিংমলগুলোতে এখন স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যে আইটেমটি বিক্রি হচ্ছে তার নাম ওড়না। জামাকাপড় বিক্রেতারা হঠাৎ করে তাদের দোকানে ওড়না বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় মহাখুশি। মাহবুব রেজা : সিনিয়র সাংবাদিক, কথাসাহিত্যিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :