দুর্বল হচ্ছে হাওরের অর্থনীতির ভিত্তি

অনুপম মাহমুদ
| আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:০৯ | প্রকাশিত : ১৮ জানুয়ারি ২০১৭, ১২:০৫

পূবালী বাতাসে বাদাম (নৌকার পাল) দেইখা চাইয়া থাকে গাঁয়ের বধূ, যদি ভাই আসে তাকে নাইওর (বাপের বাড়ি বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার রীতি) নিতে... এটা আমাদের চিরায়ত ভাটি বাংলার শাশ্বত রীতি। আষাঢ় মাসের পানিতে মেয়েরা যাবে বাপের বাড়ি নাইওর হয়ে, আত্নীয় স্বজনদের বাড়িতে জেয়াফৎ (দাওয়াত) খেয়ে ফিরে আসবে নতুন কাপড় নিয়ে সজল চোখে।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এই সাত জেলার প্রায় ৩৪ উপজেলা বিস্তৃত ৪১১ ছোট বড় হাওর নিয়ে আমাদের ভাটি এলাকা। প্রায় আট হাজার বর্গ কিলোমিটার, অর্থাৎ দেশের প্রায় সাত শতাং।

হাওর এক বিচিত্র এলাকা। দেশের অন্য যে কোন এলাকা থেকে এটা সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রম। এখানকার কৃষ্টি, সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু, ভাষা, খাদ্যাভ্যাস, বাহন সব কিছুই ব্যতিক্রম। বছরের প্রায় চার মাস গোটা এলাকা থাকে পানিতে নিমগ্ন।

পানি নিচের দিকে নামে এটাই পানির ধর্ম। উজান থেকে নেমে আসা পানি বৈশাখ-জ্যেষ্ঠ মাসে হাওরে অবস্থান করে ভাদ্র-আশ্বিন মাসের দিকে বিদায় নেয়। হাওর এলাকা একটা চায়ের কাপের পিরিচের মতো, যেখানে কয়েকমাস পানি জমে থাকে আর উজান থেকে পলি নিয়ে এসে ভাটির জমিকে করে উর্বর। এতে কৃষকের শ্রম ও সার কম লাগে।

এই জমিতে সত্যিই সোনা ফলে। উজানের দুই থেকে তিন ফসলের তুলনায় এখানে এক ফসলেই তার চেয়ে অনেক বেশি ফসল পাওয়া যায়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের পিতৃ পুরুষের কৃষি। দেশীয় বীজের স্থান দখল করেছে বহুজাতিক কোম্পানির বীজ। আর উচ্চফলনশীল (হাইব্রিড নামে অধিক পরিচিত) জাতের চাষ জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ফলন বেশি হওয়ায়। এই বীজের চাষাবাদের জন্য প্রয়োজন কীটনাশক, আর এই বিষ এর বাজারও আবার কোম্পানির দখলে। এ এক দুষ্টচক্র, এই এই ফাঁদের বাইরে যাবে এমন সাধ্য কার?

ভাটি এলাকার পেশা মূলত দুইটি। ১. কৃষি, ২. মৎস্য আহরণ। কৃষিপণ্যের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ধান। এছাড়া আছে গম, পাট, ভুট্টা, সরিষা, ধইঞ্চা, মরিচ, বাদাম। এই এলাকার ৯০ ভাগ মানুষ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে তাদের অধিকাংশ জমির মালিক নয়। বর্গা চাষ করে টিকে আছে, নানা প্রতিকূলতার মাঝে। কৃষি উৎপাদন ব্যায় যে হারে বাড়ছে সেই হারে কৃষক তার ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। মহাজন, দাদন, এনজিওর ক্ষুদ্রঋণ এর মায়াজালে বন্দি কৃষক তিন থেকে চার মাসের জন্য ৫০ শতাংশ হারে পর্যন্ত ঋণ নিয়ে থাকে।

সরকারি ও বেসরকারি তফসিলী ব্যাংক গুলো এখানে অপ্রতুল। শিক্ষা ও পর্যাপ্ত তথ্যবঞ্চিত প্রকৃত কৃষক এই সেবা পায় না। স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত কিছু সুবিধাবাদী ব্যক্তিবর্গ এই সুবিধাগুলো কুক্ষিগত করে রেখেছে। দিশেহারা কৃষক তার ভিটেমাটি ছেড়ে আজ শহরের পানে ছুটে চলছে অবিরাম।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের পানিতে টইটুম্বুর হাওর মৎস্য সম্পদের সুতিকাগার। এখানে দেশীয় প্রজাতির নানা জাতের মৎস্য প্রজননের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করে। এখানে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মাছ ও ২৪ প্রজাতির চিংড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া শিং, মাগুর, পুটি, বোয়াল, বাইন, টাকি, প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। দেশের মোট মৎস্য সম্পদের প্রায় ২৫ ভাগ মৎস্যের যোগান দেয় হাওর।

এছাড়া দেশের মোট গবাদি পশুর ২২ শতাংশ আসে এখান থেকে। এক সময় চাষের জন্য হালের গরু ছিলো একমাত্র ভরসা, এখন যন্ত্রের কাছে হালের বলদ বড্ড বেমানান। কিন্তু তার পরেও প্রায় বাড়িতেই গবাদি পশু দেখা যায়। এছাড়া উন্মুক্ত জলরাশি হাঁস মুরগি পালনের জন্য উপযুক্ত। আর এতে অনেকেই এখন লাভবান হচ্ছেন।

হাওর এলাকার জীব বৈচিত্র্যে ভরপুর। এখানে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী উদ্ভিদ দেখা যায়। যেমন: হিজল, তমাল, করচ, ভুই ডূমুর, জল ডুমুর, বরুণ, হোগলা, নল খাগড়া, বনতুলসী, বলুয়া ইত্যাদি। এছাড়া হাওরে প্রচুর শাপলা, শালুক, ঢ্যাপ ইত্যাদি জলজ গুল্ম আছে প্রচুর।

হাওরের পলি মাটির নরম মানুষেরা আজ নগরের তপ্ত রাজপথে বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। গাঁয়ের কুলবধূর নরম হাতে আজ তৈরি পোশাক শিল্পের সূচের ঘাইয়ে ক্ষত বিক্ষত। এক সময় ধান কাটার মৌসুমে ভাটিতে উজানের মৌসুমী শ্রমিকের ঢল নামতো। এলাকার স্কুল, বাজার, সম্ভ্রান্ত কৃষকের বাড়ির দাওয়ায় তাদের স্থান সংকুলান হতো না। নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধে চাঙ্গা হয়ে উঠতো ভাটির অর্থনীতি। হাঁটে মাঠে ঘাটে নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলা বসাতো ভাসমান ব্যবসায়ীরা। পণ্য কেনাবেচা হতো তখন কাঁচা ধানের বিনিময়ে। এই দৃশ্য এখন সত্যিই বিরল। এখন ভড়া মৌসুমেও শ্রমিকের অভাবে ক্ষেতের পাকা ফসল গোলায় তুলতে হিমশিম খেতে হয় প্রান্তিক কৃষকদের।

কৃষিপ্রধান গ্রামীণ অর্থনীতির স্থান দখল করেছে এখন তৈরি পোশাক শিল্প। তরুণ প্রজন্ম এখন ব্যাপকভাবে শহরমুখী। রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের দিক থেকেও তৈরি পোশাক প্রথম স্থানে থাকলেও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মৎস্য খাত। এখানে আমাদের হাওরের ভূমিকা অন্যতম। খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে আগের চেয়ে বহুগুণ, এর জন্য কারণ হলো, আধুনিকতার ছোঁয়া, উন্নত মানের বীজ, কীটনাশকের বহুল ব্যবহার।

তবে কৃষিতে ক্ষতিকর কীটনাশকের ব্যবহার নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে। বিশেষ করে কৃষিতে ভর্তুকি নিয়ে এখনই চিন্তার কালো মেঘ দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে উন্নত দেশ গুলো একটি চুক্তি করেছে, সেটা হলো ২০৩০ সালের পর থেকে কৃষিতে ভর্তুকি দেয়া যাবে না। বাংলাদেশ সেই প্রটোকলে সই করেছে।

১৯৭৪ সালে খাদ্যের অভাবে দেশে দেখা দিয়েছিলো দুর্ভিক্ষ, কারণ আমাদের চাহিদার ঘাটতি পূরণ হতো দেশের বাইরে থেকে আসা খাদ্যে। বিদেশিরা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিলেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির কূট কৌশলের ফলশ্রুতিতে। কিন্তু আজ আমাদের জনসংখ্যা দিগুণের বেশি হলেও আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটা সত্যিই আশ্চর্যয়ের বিষয়, আজ আমরা বিদেশে খাদ্য রপ্তানি করি। কিন্তু লজ্জা ও দুঃখের বিষয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক ফসল ফলায় তারা বঞ্চিত হচ্ছেন ন্যায্য পাওনা থেকে। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আজ তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন পরিবার পরিজন নিয়ে। এছাড়া উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও অকাল বন্যায় তলিয়ে যায় জমির ফসল। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ক্ষুদ্র কৃষক, যারা কর্জ (ধার) করে চাষাবাদ করেন।

জলমগ্ন হাওরেও পানি প্রয়োজন হয় ফসল ফলাতে, আর এর জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের দেখা মেলা কঠিন। তাই ভরসা হলো ডিজেলনির্ভর সেচ যন্ত্রের উপর। অথচ বর্তমানে আমাদের পেট্রোলিয়াম করপোরেশন লাভবান হলেও, এমন কি আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও সেই হারে কমছে না তেলের দাম। কারণ ডিজেলের দাম কমার আগে কমে ফার্নেস তেলের দাম। ফার্নেস তেলের দাম কমলে লাভ শিল্পপতিদের। অথচ ডিজেল এর দাম কমালে কিছুটা খরচ কম হতো কৃষকের। আর এমন সময় দাম কমে যখন জল সেচের প্রয়োজন শেষ।

শহরমুখী স্রোতের বিপরীতে এখনো দেশের সিংহভাগ মানুষ বাস করে গ্রামীণ এলাকায়। আর গ্রামীণ জনপদের একটা বিশাল এলাকা জুড়ে আছে হাওর। হাওরের অর্থনীতি টিকে আছে কৃষি ও মৎস্য আহরণের উপর ভিত্তি করে। তাই এই বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে এখনই ভেবে দেখতে হবে।

হাওরে ত্রুটিপূর্ণ ভূমি ব্যবস্থাপনা ও জলমহালের উপর প্রভাবশালীদের দাপটে প্রকৃত জেলেদের নামে বন্দোবস্ত নিয়েও জলমাহাল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে দুষ্ট রাজনৈতিক চক্র। হাওরে প্রতিনিয়ত রক্তের হোলি খেলায় রঞ্জিত হয় ভাটির স্বচ্ছ পানি।

আমাদের বাংলা সাহিত্যে ময়মনসিংহ গীতিকা একটা বিশাল অংশ জুড়ে বিদ্যমান, যার মূল ভিত্তি হলো ভাটি এলাকা। উপমহাদেশের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতী, মহুয়া মলুয়া, হাছন রাজা, শাহ আব্দুল করিম, উকিল মুন্সি ও হুমায়ুন আহমেদ, কবি নির্মলেন্দু গুণ অন্যতম। তাদের সাহিত্যেও ফুটে উঠেছে ভাটির চালচিত্র।

পৃথিবীর তাবৎ পর্যটন জমে উঠেছে জলের কিনারায়। জলমগ্ন হাওর হতে পারে এই পরিবেশ বান্ধব বা ইকো ট্যুরিজমের একটা উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। দরকার শুধু অবকাঠামো উন্নয়ন। ডিজিটাল এই বাংলাদেশে যদি আমরা প্রকৃতি প্রদত্ত সুবিধাগুলো ব্যবহার করতে পারি, তবে হাওর এলাকার প্রাণচাঞ্চল্য আবার ফিরে আসবে। কারন কর্মসংস্থানের অভাবেই মানুষ আজ শহরমুখী। কৃষি-মৎস্য-পর্যটন এই তিন উৎস হতে পারে সোনার বাংলা গড়ার অন্যতম প্রধান উৎস।

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :