শিল্পবিপ্লবের সম্ভাবনা দেখছে ডব্লিউইএফ, কী পাবে বাংলাদেশ?

শেখ আদনান ফাহাদ, ঢাকাটাইমস
| আপডেট : ২২ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:০০ | প্রকাশিত : ২২ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৩৬

বিশ্বসভ্যতা কি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে? সদ্য সমাপ্ত দি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভা শেষে অংশগ্রহণকারীরা কিন্তু তাই ভাবছেন। শিল্প-বিপ্লবের সম্ভাবনার পাশাপাশি প্রযুক্তি-নির্ভর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের নেতিবাচক নানা দিক নিয়েও সম্মেলনে আলোচিত হয়েছে পাঁচ দিন ধরে।

বার্ষিক সভার উদ্বোধনী দিনেই একটি বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের পাশাপাশি ৫০ লাখ মানুষ নিজেদের চাকরি হারাতে পারেন। তবে প্রযুক্তিক্ষেত্রের শীর্ষ ব্যক্তিদের অনেকেই দাবি করেছেন, এমন আশংকা অমূলক, বরং প্রযুক্তির স্পর্শে বিশ্বব্যাপী মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম দারুণ সাফল্য পাবে।

ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভাগুলো অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন থেকে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা এবং বৈচিত্র্যের দিক থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্যের। অন্যান্য সম্মেলনে যেমন বিশেষ একটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করে আয়োজন করা হয়, ইকোনমিক ফোরাম সেখানে ব্যতিক্রম। অর্থনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান, চলচ্চিত্র তারকা, ক্রীড়াবিদসহ নানা বৈচিত্র্যময় ক্ষেত্রের অগ্রগণ্য ব্যক্তিবর্গকে ফোরামের পক্ষ থেকে নিমন্ত্রণ করা হয়।

ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার এবং দারিদ্র বিমোচনে দারুণ সাফল্য দেখানোয় বাংলাদেশ থেকে এবারই প্রথম কোনো নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোরামের বার্ষিক সভায় বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক।

১৭-২০ জানুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বার্ষিক সভায় শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বেশ কয়েকটি প্লেনারি সেশনে অংশগ্রহণ নিয়ে রাষ্ট্র হিসেবে নানাক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরেন। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ দমন, ডিজিটাল প্রযুক্তির বিপ্লব, নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, কৃষি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের সাফল্য সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আলোচিত হয়।

বার্ষিক সভার সমস্ত আয়োজন শেষে ইকোনমিক ফোরাম তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিশ্ব ব্যক্তিত্বদের নানা গুরুত্বপূর্ণ মতামত ও মন্তব্য নিয়ে একটা লেখা প্রকাশ করে। এরই আলোকে ঢাকাটাইমসের এই প্রতিবেদন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদরা চতুর্থ বিপ্লবের সম্ভাবনার পাশাপাশি নিম্ন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হারানোর বিষয়েও সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন।

যেমন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক আইটি প্রতিষ্ঠান সেলসফোর্সের প্রধাননির্বাহী মার্ক বেনিওফ সভার শেষদিনে বললেন, 'নতুন এক যুগে প্রবেশ করছে বিশ্ব সভ্যতা'।

ফোরামে অংশগ্রহণকারীদের মুখে সম্ভাবনার পাশাপাশি উঠে এসেছে কিছু প্রশ্নও। তারা বলছেন, শিল্প বিপ্লবের সম্ভাবনা যেমন তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, সম্ভাব্য বিপ্লবের প্রভাব কি পুরো বিশ্বের সব শিল্পে সমানভাবে পড়বে? এর সুফল কি সব সমাজ এবং রাষ্ট্রের মানুষেরা পাবে নাকি পৃথিবীজুড়ে সম্পদ এবং ভোগের বর্তমান অসম পরিস্থিতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে?

উন্নয়ন কর্মযজ্ঞের ভালো-মন্দের বিষয়ে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা এবং বর্তমান নির্বাহী চেয়ারম্যান অধ্যাপক ক্লাউস শোয়াব পাঁচ দিনব্যাপী বার্ষিক সভায় বেশ মজার এক মন্তব্য করেন। তিনি বলেছেন, শুধুই সমৃদ্ধির কিংবা শুধুই বিপদের সম্ভাবনাপূর্ণ সময় পৃথিবীতে কখনো আসেনি'।

সমৃদ্ধি আর ধ্বংসের সমান সম্ভাবনাপূর্ণ প্রযুক্তি- নির্ভর পৃথিবী প্রসঙ্গে উত্তর আমেরিকার উন্নত দেশ কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডেয়ু'র করা একটি মন্তব্য ইকোনমিক ফোরামের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে তুলে ধরা হয়েছে। সম্মেলনের প্রথম দিন কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ' শুধু চাকচিক্যের জন্য আমরা প্রযুক্তি চাই না। আমরা নিত্যনতুন প্রযুক্তি চাই, কারণ এর ব্যবহারে মানুষের জীবন-যাপনের মান উন্নত হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, আসলে কি প্রযুক্তি মানুষের জীবনের শুধুই উন্নয়ন ঘটায়?

বার্ষিক সভায় শুরুতে ফোরামের ২০১৭ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, প্রাযুক্তিক উৎকর্ষের ফলে ২০২০ সালের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ তাদের চাকরি হারাবে! একদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং সেবার মান উন্নত হওয়ার হাতছানি, অন্যদিকে লাখ লাখ মানুষের চাকরি হারানোর শঙ্কা। কী ভাবছে বিশ্বের শীর্ষ সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট?

ফোরামের সভার একটি প্যানেল আলোচনায় মাইক্রোসফটের প্রধান নির্বাহী সত্য নাদেলা এ বিষয়ে বলেছিলেন, 'আমি আশাবাদী থেকেই কাজ করতে চাই। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্তও হবে।’

বার্ষিক সভায় এক বিশেষ বক্তৃতায় মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও প্রযুক্তির উৎকর্ষের বিপদের দিকটি তুলে ধরেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, প্রযুক্তির উন্নয়ন নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, কিন্তু এর ফলে কর্মজীবী মধ্যবিত্ত আবার হারিয়ে যাবে না তো? সমাজে অসমতা বাড়বে নাতো?

তিনি ভাষণে বলেন, 'আমি বিশ্বাস করি প্রাযুক্তিক পরিবর্তন ভালো কিছু করার জন্যই হয়। কিন্তু বাস্তবে সবসময় এমনটা নাও হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির বদলে যন্ত্রণা আসতে পারে। যেমন ধরুন ওয়েরহাউজে কর্মরত শ্রমিকদের অথবা সেলসম্যানদের কথা। এরা নানা পণ্য বাজারজাত প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত থাকে। প্রযুক্তির ফলে এদের যদি আর কাজ না থাকে, তাহলে কী হবে ভাবুন!'

ফেসবুকের চিফ অপারেটিং অফিসার শেরিল কারা সান্ডবার্গ ফোরামের ভাষণে বলেছেন, প্রাযুক্তিক বিপ্লবের প্রভাবকে ব্যষ্টিক পর্যায় থেকে না মূল্যায়ন করে, বৈশ্বিক পর্যায়ে বিশ্লেষণ করতে হবে। সান্ডবার্গ প্রযুক্তির উন্নয়নের পাশাপাশি বৈশ্বিক নানাবিধ ঝুঁকির দিকটি তুলে ধরতে গিয়ে 'সন্ত্রাসবাদী' সংগঠন আইসিসের প্রসঙ্গ এনেছেন। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তির ভালো দিক-খারাপ দিক থাকবেই, এরজন্য অগ্রযাত্রা বন্ধ রাখা যাবে না। বিশ্বের নানা সন্ত্রাসবাদী সংগঠন নিজেদের তৎপরতার প্রচার করতেও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে, তাই বলে তো সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। অপরাধীদের চিহ্নিত ও দমন করতেও প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই থাকবে।

তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বাণী শুনিয়েছেন ভিয়েনা সেন্টার ফর ডিজআর্মামেন্ট অ্যান্ড নন-প্রফিলারেশনের সিনিয়র ফেলো এংগেলা কেইন। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তির বিকাশের সাথে সাথে বিশ্বে নানা প্রান্তের যুদ্ধ পরিস্থিতিরও নেতিবাচক পরিবর্তন আসবে। তিনি বলেছেন, প্রযুক্তির বিকাশের সুযোগে বিশ্বে চলমান যুদ্ধক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ শুধুমাত্র কয়েকটি পক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না।

লাখ লাখ মানুষ চাকরি হারাবে বলে যে শঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তার সাথে সম্পূর্ণ বিরোধিতা করেছেন এমআইটি ইনিশিয়েটিভ ফর দ্যা ডিজিটাল ইকোনমি'র ডিরেক্টর ইরিক ব্রিঞ্জলফসন। তিনি এক প্লেনারি সেশনে বলেছেন, রোবট জাতীয় প্রযুক্তি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমিয়ে দেবে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, সেটি নিতান্তই অতিরঞ্জন।

তবে বিশ্ব রাজনৈতিক নেতারা প্রযুক্তির ইতিবাচকতা আর নেতিবাচকটার বিতর্কে না গিয়ে ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামকে স্ব স্ব দেশের অগ্রগতি তুলে ধরার প্লাটফর্ম হিসেবে দেখেছেন। আর্জেন্টিনার নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মরিকো মেক্রি বলেছেন, ডাভোস সম্মেলনের মাধ্যমে আর্জেন্টিনা বিশ্বকে দেখাতে পেরেছে যে দেশটি আর কোনোদিকেই পিছিয়ে নেই।

বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক ফোরামে অংশগ্রহণ করে প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি নিজ দেশের সাফল্যের দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিসহ অনেকের সাথেই তার আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক আলাপ হয়েছে। ইতিবাচক বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং করার চেষ্টা করেছেন তিনি।

ঢাকাটাইমস তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় অংশগ্রহণ করে কী পেয়েছে বাংলাদেশ? উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকারপ্রধান ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় দাওয়াত পেয়ে অংশগ্রহণ করেছেন। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য এটি একটি দারুণ অর্জন। পুরো বিশ্ব জেনেছে বাংলাদেশ আর পিছিয়ে পড়া কোনো রাষ্ট্র নয়। সবাই জেনেছে, বর্তমান অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে দারিদ্র বিমোচন ও সোনার বাংলা গঠন সময়ের ব্যাপার মাত্র।’

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, বিশ্ব নেতারা জেনেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এবং তার আইসিটি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কীভাবে তড়িৎ গতিতে ডিজিটাল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণা বাস্তবায়িত হচ্ছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির বিকাশের পাশাপাশি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নেও বাংলাদেশের সাফল্যগাঁথা বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে মুগ্ধ করেছে বলে পলক মন্তব্য করেন।

পলক বলেন, 'ইকনোমিক ফোরামের সভায় অর্জিত অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক কাজে দেবে'।

ইকোনমিক ফোরামের ২০১৭ সালের 'ইনক্লোসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট ইনডেক্স (আইডিআই)'প্রতিবেদনে বলা হয় 'অন্তর্ভুক্তিকর'প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে যথাক্রমে ২৪ ও ১৬ ধাপ এগিয়ে আছে বাংলাদেশ।

ফোরামের রিপোর্টে বলা হয়েছে,সামগ্রিক উন্নয়নের মানদণ্ডে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬তম। অন্যদিকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দেশ ভারতের অবস্থান ৬০ এবং পাকিস্তানের ৫২তম।

'আইডিআই' অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে হিমালয়ের দেশ নেপাল। প্রতিবেদন অনুযায়ী নেপালের অবস্থান ২৭তম।

(ঢাকাটাইমস/২২জানুয়ারি/এসএএফ/জেবি)

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :