"ধান ভানলে কুঁড়ো দেব"
ছোট বেলার কবিতায় ছিল- 'ধান ভানলে কুঁড়ো দেব, মাছ কাটলে মুড়ো দেব, কালো গাই- এর দুধ দেব'... আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে ধান ভাঙার জন্য একটি করে ঢেঁকি থাকত। নতুন ধান উঠলে নবান্ন উৎসবের জন্য মায়েরা চালের গুঁড়া তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটাতেন। নানা গানের ছড়া কেটে তালে তালে ঢেঁকিতে পাড় দিতেন। বিশেষ করে শীতকালে পিঠা-পায়েসের জন্য ঢেঁকিঘরে মায়েরা বেশি ব্যস্ত থাকতেন। কেরোসিন তেলের কুপি জ্বালিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত চলত চালের গুঁড়া তৈরির কাজ। আর সকাল বেলা তৈরি করা হতো হরেক রকমের মজাদার পিঠা। তারপর খেজুরের রসে ভিজিয়ে রাখা হতো। সে পিঠার কথা মনে হলে এখনো জিভে জল আসার অবস্থা হয়।
মুড়ির চাল তৈরি, চিড়া তৈরি, চালকুমড়ার বড়ি তৈরিতে কখনো কখনো সারা রাত ঢেঁকির শব্দ শোনা যেত। তবে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঢেঁকিঘর এখন বিলুপ্তিপ্রায়। গ্রামে এখন কালেভদ্রে দু-একটি ঢেঁকির দেখা মেলে।
হঠাৎ করেই সেদিন গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। বিকেল বেলা গ্রামের ভেতর বেড়াতে বের হয়েছিলাম। গ্রামের সহজ সরল মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন। গ্রাম এখন অনেক বদলে গেছে। আগের মতো সেই মাটির বাড়ি নেই বললেই চলে। সেই গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ কেবল বইয়ের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাওয়া, সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করা। সবাই বসতে বলছেন। অনেকেই কিছু মুখে না দিয়েই চলে যাওয়ার জন্য আদুরে অভিমানও করছেন। এর মধ্যে কানে এলো সেই চিরচেনা শব্দ।
মাটির তৈরি রান্না ঘরের পাশে এক চালা ঢেঁকিঘর। শীতের পিঠা তৈরির জন্য চালের গুঁড়া কোটা হচ্ছে। কাছে যেতেই একজন গ্রাম্য সম্পর্কের চাচী আদর সমাদর আর অভিমানের কথা শুনিয়ে কাঠের পিঁড়ি এগিয়ে দিলেন বসার জন্য। খোঁজখবর নেওয়ার পাশাপাশি চোখ আটকে থাকলো ঢেঁকির তালে তালে পাড়ের দিকে। ঢেঁকির ছিয়া ছন্দে ছন্দে গড়ের ভেতর পড়ছে আর উঠছে। আর সেই তালে তালেই একজন চাল গড়ের ভেতর ঠেলে দিচ্ছে। পাশেই একজন চালের গুঁড়া চালার কাজে ব্যস্ত। আনন্দমুখর সময়ের মাঝে ছোট বাচ্চাটি মায়ের আঁচল ধরে টানাটানি করছে।
আবহমান গ্রাম বাংলার চিরাচরিত এ দৃশ্য এখন দুর্লভ। ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রাম। সেখানেই দেখা মিলেছিল গ্রাম্য ঐতিহ্য। এখনো এখানের মানুষ মাটির উঠানে তৈরি চুলায় রান্না করে। সন্ধ্যাবেলা নদীর পানি এনে রান্না করে। লাউ মাচা, ঘরের চালের উপর কুমড়া লতা, পুই লতা এখনো লতিয়ে বেড়ায়।
ঢাকাটাইমস/২৩ জানুয়ারি/শেখ সাইফ