এক মুঠো সবুজের খোঁজে...

অনুপম মাহমুদ
| আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ০৯:২৫ | প্রকাশিত : ২৪ জানুয়ারি ২০১৭, ০৮:৪২

ইট কাঠ সিমেন্টের জঙ্গলে বসবাস। ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি সেই কবেই। বুক ভরে কবে যে শেষবারের মতো বিশুদ্ধ নিঃশ্বাস নিয়েছিলাম, ভুলেই গেছি। পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে না, শুনি না বৃষ্টির শব্দ। মধ্যরাতের বিধ্বংসী জোছনা, সেও অতীত। মুখে কিছু গুঁজে দিয়েই পা বাড়াই ব্যস্ত রাজপথে, ঘড়ির কাটা ঘুরলেই অফিসের গাড়ি মিস, শুরু হবে যুদ্ধ। অফিসে পৌঁছানোর তাড়া। সূর্য চড়াও হবার আগেই বেড়ে যাবে রক্তচাপ! স্থবির রাজপথে বসে থাকা অগণিত মানুষের ভিড়ে একা আমি...

প্রযুক্তি আর গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটছে নগরায়নের পাগলা ঘোড়া। পল্লীর মেঠোপথ ছেড়ে আমরা সবাই উন্নয়নের মহাসড়কে ম্যারথন রেসে দৌড়াচ্ছি। কেউ কারো দিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করতে সম্মত নই। এ যেনো ‘ছুটে চলাই জীবন’ এর নামান্তর। জীবনকে সাজাতে ও রাঙাতে নিজেকেই সময় দিতে অপারগ আমরা! চাবি দেয়া পুতুলের মতোই হেলেদুলে পুতুলনাচে নিমগ্ন আমরা, জানি না শুধু, সূতোটা কার হাতে? কবে সাঙ্গ হবে এই ভবের যাত্রা।

দুচোখ যেদিকে যায়, শুধুই রাঙা ইটের স্তম্ভ, কর্মব্যস্ত সরু গলি আর সাইরেন বাজিয়ে রাজপথ, সর্বত্রই তীব্র শব্দ দানব আর ধোঁয়াচ্ছন্ন মেঘলা আকাশ। ক্রমবর্ধমান এই নগরে গড়ে উঠছে অট্টালিকা দিবানিশি। পাল্লা দিয়ে আকাশের পানে মাথা তুলে বাড়ছে সুউচ্চ ইমারত। মাথা গোঁজার ঠাঁই হলেও নেই চিরনিদ্রার সুযোগ। একটি আদর্শ গ্রাম বা মহল্লার পূর্বশর্ত কী হতে পারে? কী কী সুযোগ সেখানে থাকতে পারে?

১। সুপরিসর সড়ক যোগাযোগ ব্যাবস্থা

২। মুক্ত বায়ু চলাচলের সুযোগ

৩। অতি অবশ্যই উন্মুক্ত মাঠ (বাচ্চাদের খেলাধুলা ও বিনোদনের জন্য)

৪। চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল

৫। পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

৬। বাজার, শপিংমল

৭। কমিউনিটি স্পেস

৮। ধর্মীয় উপাসনালয়য়

৯। কবরস্থান/শ্নশানঘাট। ইত্যাদি...

কিন্তু দুঃখের বিষয় এইসব গালভরা বুলি আউরালেও বাস্তবে আমাদের আবাসন ব্যবস্থা অত্যন্ত অমানবিক। বাচ্চাদের জন্য নেই খেলার মাঠ আর নেই কবরস্থানের মতো অতি জরুরি স্থানটুকুও। মুনাফার ফাঁদে আকটে আছে আমাদের নাগরিক জীবন।

প্রতিবেশী কে, কী তার পরিচয়? জানি না আমরা। ইদানীং জঙ্গি উত্থানের আতঙ্কে আমরা প্রতিবেশীদের দিকেও ভয়াতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। গলিপথে বাসায় ফেরার সময় ল্যাম্পপোস্টে নিজের ছায়া দেখেও চমকে উঠি।

ফ্ল্যাট কালচার এখন শহুরে নতুন কমিউনিটি। এখানে বিশালাকার দৈত্যের মতো ঢাউশ সাইজের অট্টালিকায় আছে অগুনতি ফ্ল্যাট বাড়ি। একেকটি ছোট্ট ছোট্ট একক বাড়ি। বাণিজ্যিকভাবে এই ব্যবসা বেশ পুরনো ও যথেষ্ট জনপ্রিয়। নানা আকারের ফ্ল্যাট বাড়ি এখন বিকোয় মানুষের প্রয়োজন অনুসারে। ছোট বড় যাই হোক, আছে নানা ডিজাইন। মাস্টার বেড, চাইল্ড বেড, লিভিং রুম, এটাচড বাথ, সাথে বারান্দা, চাইলে মেইড/ সারভেন বেডও হবে। কখনো কি শুনেছেন প্যারেন্টস বেড এর কথা? আমাদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে আর্কিটেক্টরাও এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছেন। এই যাদুর শহরে ইউটোপিয়ার মতোই বৃদ্ধ, প্রবীণেরা অপাংক্তেয়।

কবুতরের খোপের মতো কুঠুরিতে কোন মানব শিশু বড় হয়ে উঠবে এটা হয়তো দুই/তিন পুরুষ আগে কেউ ভাবেননি। বংশ পরম্পরায় মুরুব্বীদের স্নেহ মমতায়, মা-বাবা, ভাই-বোন, পাড়া মহল্লার প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলেমিশে কঠোর সামজিক অনুশাসনে গড়ে উঠা এই মানব সভ্যতা আজ পথ হারিয়েছে।

ঠুনকো সামজিক বন্ধনে নড়বড়ে হয়ে যাচ্ছে আন্তঃব্যাক্তিক সম্পর্কগুলো। নিঃশ্বাসের নেই বিশ্বাস। হঠকারী সন্তানের হাতে পিতা-মাতার রক্ত, কিংবা বাবা-মায়ের কাঁধে উঠছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভারী বস্তু। কখনো বা সন্তানদের হত্যা করে নিজেরাও অপমৃত্যুর খাতায় নাম লিখিয়ে মিডিয়ায় আসছেন নিয়মিত। এ কীসের আলামত? নিজের সৃষ্টির প্রতি এ কেমন ভালোবাসা?

পাড়া মহল্লায় গড়ে উঠছে ওয়েস্টার্ন ধাঁচের গ্যাং কালচার। কিশোর তরুণেরা হয়ে উঠছে আগ্রাসী। পরোয়া করে না সমাজ, আইন, পরিবারের শাসন-বারণ, তুচ্ছ করে মৃত্যু উপত্যকায় মেতে উঠছে আগামীর এই প্রজন্ম। অযাচিত সম্পর্কের দায়ে ভাঙছে সংসার, প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা। শিশু সামিউল, কিশোর রকিব এর কথা ভীষণ মনে পড়ে। এই বিপর্যয়ের দায় সমাজ ও রাষ্ট্র এড়িয়ে যেতে পারে না, তেমনি ক্ষয়িষ্ণু পারিবারিক বন্ধন এর জন্য কোন অংশেই কম দায়ী নয়।

ক্রববর্ধমান নগরায়ন ও একক পরিবারের উত্থানে শিশুরা যেমন বড় হচ্ছে কোন প্রকারের দিকনির্দেশনা ছাড়া, তেমনি ঝুঁকির মুখে আছে পবিবারের প্রবীণ সদস্যরা। বৃদ্ধ বয়সে রোগ শোকে কাতর হয়ে আপনজনের ভালোবাসা বঞ্চিত দেহ যাত্রা করে অমরত্বের পথে। গোটা জীবন দিয়ে নিজেদের সবকিছু উজার করে সন্তানদের মানুষ করলেও, অনেক বাবা মায়েরই নিজ সন্তানদের সাথে থাকার ভাগ্য হয় না। গ্রামের বাড়িতে না হয় বৃদ্ধাশ্রমই হয় শেষ ঠিকানা, কারো কারো নিয়তি আরো করুণ। আমরা ব্যর্থ হচ্ছি প্রবীণদের অভিজ্ঞতা নিজেদের সন্তানদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে। ঠাকুমার ঝুলি বা ঈশপের গল্প এখন দাদু-নানুর মুখে শুনতে পায় না আজকের শিশুরা। তাদের সময় কাটে ট্যাবলেট, গ্যাজেট হাতে নিত্য নতুন এপ্লিকেশনে। ভিডিও গেইমস কখনোই খোলা মাঠে ছুটে বেড়ানো, গোল্লাছুট, দাড়িয়াবান্দা, ফুটবল, ক্রিকেট এর বিকল্প হতে পারে না।

রিমিক্স বা ফিচারিং কিংবা উদ্দাম ডিজের বিটের তালে লালন-হাসন-শাহ আব্দুল করিম আজ নির্বাসনে। বাশুরিয়ার বাঁশিতে আজ সুর বাজে না, সফটওয়্যারের কম্পোজিশনেই মাতোয়ারা আমরা। এফএম রেডিও র আরজেদের কথা আর কি বলবো? না হয় বাংলা না হয় বাংলিশ (বাংলা+ইংলিশ)। ইদানীং ভিনদেশি তারকাদের টানে পঙ্গ পালের মতোই ছুটে চলি হুল্লোড়ে মাতোয়ারা হলরুমে। মানহীন দেশীয় অনুষ্ঠানের স্থান দখলে নিয়েছে বিদেশি সিরিয়াল। এক ‘পাখি ড্রেস’ কিনে না দেয়ায় কত বাঙালি নারীর অকাল মৃত্যু হয়েছে, তার কি কোন সঠিক পরিসংখ্যান আছে? কিরণমালা, পটল কুমার কিংবা দুর্গা এসবই এখন ড্রইং রুমের আলোচনার বিষয়বস্তু। বাংলায় ডাবিং করা সুলতান সুলেমান, হাতিম, ইউসুফ জুলেখা রাতের ঘুম হারাম করেছে দেশীয় তারকাদের।

ত্রুটি বিচ্যুতি আগেও ছিলো, ভবিষ্যতেও থাকবে হয়তো। কিন্তু ইদানীং এর মাত্রা ও হার দুটোই বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। মানুষ তার মনুষত্ব্য হারিয়ে পশুর সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে মানব সম্প্রদায়ের নামের প্রতি সুবিচার করতে চূড়ান্ত রুপে ব্যর্থ হয়েছে। শিশু, কিশোর, তরুণ, যুবা সবারই ক্রমহ্রাসমান বিবেক বোধের এই পতনে নেপথ্যের কারণ কি? ভেবে দেখার এটাই সময়।

লাভ-ক্ষতির সম্পর্ক যে কোন বন্ধন কে নিয়ে যায় সংঘাতের দিকে। নির্লোভ যোগাযোগ এখন নেই বললেই চলে। প্রত্যাশার পারদের এই উঠানামার বলি হচ্ছে কত প্রাণ।

ছোট থেকে বড় হবার যে পথ পরিক্রমা, এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয় এই যে, আমরা একটা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। তিন পুরুষের বিবর্তনে প্রযুক্তি থেকে শুরু করে গতির লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছি আমরা বারবার, শুধু হারিয়েছি আবেগ, অনুভূতি, বিবেক। সময়ের প্রয়োজনে কোমল অনুভূতিগুলো বিসর্জন দিয়ে ভোঁতা হয়ে গেছে সেই কবেই। গ্রামের মেঠোপথের ধুলোয় লুটোপুটি, দূরের বিদ্যালয়ে দল বেঁধে যাওয়া আসা, উচ্চ শিক্ষার তাগিদে বহু দূরের যাত্রা, এসব কিছুই আজ আর দেখা যায় না। কষ্টের বদলে এসেছে আরাম আয়েশের নানা উপকরণ।

যে শিশু পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে, আজ তারই শিশু শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে স্কুলে যায়। প্রতিটি স্কুল কলেজেই মাঠ ছিলো অত্যাবশ্যক, আজ একই ছাদের নিচে অগুণতি পাঠশালা, মাঠ সে তো সোনার হরিণ! শিক্ষা এখন পণ্য বটে! ছাত্র-শিক্ষকের ভূমিকা আর শ্রদ্ধায় মোড়ানো নয়, কারণ শিক্ষক নিয়োগে আছে ব্যাপক অস্বচ্ছতা। পাসের হার বেড়েছে যত ঠিক তার উল্টো ফল দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রকাশিত ফলাফলে।

কেন যেন মনে হয় এর জন্য দায়ী আমাদের ধূসর দৃষ্টিভঙ্গি। যেদিকেই চোখ যায়, শুধুই বিবর্ণ ধূসর ধোঁয়া, শব্দ দূষণ, কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত জলাশয়ের পানীয় জল। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে আরাধ্য সবুজের দেখা মেলা ভার। চিরহরিৎ অরন্যের হাতছানি দিয়ে ডাকে, ফিরে আয়...

তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা হয়তো সবাই এখন এক মুঠো সবুজের খুঁজে...

লেখক: উন্নয়ন ও অধিকার কর্মী

সংবাদটি শেয়ার করুন

মতামত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

বিশেষ প্রতিবেদন বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিনোদন খেলাধুলা
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত

শিরোনাম :